‘আবার তোরা জাগ’ বাংলা ছড়া কবিতায় এক টুকরো আশার আলো

ফিরোজ মাহমুদ ।।

কবিতা কবির মতো কিংবা কবি কবিতার মতো। এ চরম সত্য কথাটি ধারণ করেই একজন লেখক বা কবি অবিরাম লিখে চলেন তার একান্তই নিজস্ব চিন্তা-চেতনা আর ধ্যান-ধারণাকে উপজীব্য করে। আর এ লেখাতেই চিত্রায়িত হয় একজন লেখক বা কবির আহরিত বিষয়ের সামগ্রিক প্রতিফলন। কবির এ লেখা ধারণ করে কখনো প্রেম-ভালোবাসা, সমসাময়িক বিষয়ের ছন্দবদ্ধ বয়ান, রাজনৈতিক বিষয়ের নিঁখুত বিশ্লেষণ, স্বদেশ প্রেম, দ্রোহ আর অনাবিল শান্তির ইস্তেহারসহ জীবন ঘনিষ্ঠ অনেক বিষয়। একজন কবির দৃষ্টিভঙ্গীর সৃজণশীল প্রতিভার প্রতিফলন ঘটে তার লেখায়।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে কবি-লেখকদের মধ্যে যে কয়জন কবি-লেখক বাংলা ছড়া কবিতায় ঈর্ষণীয় সফলতা লাভ করে পাঠক হৃদয় জয় করে চলছেন, পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন, তাদের মধ্যে কবি রিতা ফারিয়া রিচি অন্যতম। সৃজণশীল প্রতিভার বিকাশে অতি অল্প সময়ে এ ছড়াকার ঈর্ষণীয় সফলতা লাভ করেছেন এ কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। কবিরা শব্দ বিনির্মাণের কারিগর। শব্দ নিয়ে খেলা করতে করতেই একজন কবি সাহিত্যে অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠেন। শব্দের যাদু দিয়েই কবি নির্মাণ করেন কবিতার সু-উচ্চ মিনার, স্বাস্থ্যল শরীর। আর এভাবেই একজন কবি তার সৃষ্টির মাধ্যমে বেঁচে থাকেন অনন্তকাল।

রিতা ফারিয়া রিচি ইতোমধ্যে ছড়া-কবিতায় তার প্রচন্ড শক্তিমত্তার জানান দিয়েছেন বিস্ময়করভাবে। বিষয় নির্বাচন একজন লেখকের অন্যতম গুণ। এ ক্ষেত্রে রিচি পুরোপুরি সফল। লেখার ধরণ, ছন্দ জ্ঞান, শব্দ চয়ন, উপমা, উৎপ্রেক্ষা এবং অন্ত্যমিলের চমৎকার আর অপূর্ব সমন্বয় পাঠককে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছে রিতা ফারিয়া রিচির লেখা ছড়া-কবিতাগুলো।

আর দশজনের মতো রিতা ফারিয়া রিচির লেখার সাথে আমার ও পরিচয় ঘটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণে, কখনো পত্র-পত্রিকা এবং সাহিত্য সাময়িকীর মাধ্যমে। অল্প সময়েই তার লেখার মুগ্ধ পাঠক হয়ে তার ছড়া-কবিতার প্রেমে পড়ে যাই। বিমুগ্ধ চিত্তে পাঠ করি তার লেখা। বিশেষ করে সমসাময়িক বিষয়ে কবির লেখাগুলো কখনো হৃদয়ে বৈশাখী তান্ডব সৃষ্টি করে। কবি লিখেন-

‘বজ্রকথার হুংকারে তাই

মারবো ওদের কষে,

রাঘব বোয়াল ধরে ধরে

বারুদ দেবো ঘষে।’

(জাগুন সবাই জাগুন)

 

‘গর্জে ওঠার সময় এখন

আর করোনা দেরি,

কেন তুমি পরে আছো

পায়ে দ্বিধার বেড়ি?’

(দাও জ্বালিয়ে)

আকর্ষণীয় বয়নের কারণে কিছু সাধারণ বিষয় অসাধারণ হয়ে ওঠে কবির দক্ষ হাতের ছোঁয়ায়, যেমনটি লক্ষ্য করা যায় রিচির কবিতায়, কবি বলেন-

‘সীমান্তে কোন শালায় রে!

ধূতি পরে পালায় রে!

ওই শালারা মাঝে মাঝে

এপার এসে জ্বালায় রে!

ওদের হয়ে কথা বলে

এই দেশি এক খালায় রে!’

(সীমান্ত কোন শালায় রে)

‘দু-নম্বরী বন্ধ করো

বর্ণচোরা অন্ধ করো

দূর্নীতিবাজ দাগাও

ঘুষবাজিটা জব্দ করো

চুপ থেকো না শব্দ করো

ঝাঁটারবাড়ি লাগাও।’

(চুপ থেকো না শব্দ করো)

বয়সে নবীন এ কবির কলমে কখনো আগুনের ফুলকির মতো লক্ষ্য করি দ্রোহ আর বিক্ষোভের অগ্নিঝড়া কবিতার শব্দ বুনন। কবির ভাষায়-

” আমরা হলাম বাংলাদেশের

রক্তদাতা বীর,

যাই এগিয়ে রক্তদানে

উচ্চ করি শির।

এই জীবনের মূল্য অনেক

তাইতো সবাই আজ,

বেছে নিলাম রক্ত দেয়া

কর্মসূচির কাজ।”

(রক্তদাতা বীর)

স্বদেশ প্রেমে বুঁদ হওয়া কবি দেশের স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের জন্য লিখেন অনবদ্য কবিতার ছন্দমালা –

‘স্বাধীনতা বিরোধীদের

হালকা করে ভাবলে,

রক্তে কেনা এই পতাকা

ফেলবে খেয়ে খাবলে।

শত্রু তাড়াও, সবাই যদি

দেশকে নিয়ে ভাবো,

স্বাধীনতার সত্যিকারের

অর্থ খুঁজে পাবো।’

(পতাকা)

সমাজ বাস্তবতার নির্মম চিত্র যখন কবিতার বিষয় হয়ে ওঠে, কবি আর কবিতা তখন অপরিহার্য হয়ে ওঠে পাঠকের নিক্তিতে। তসবির দানার মতো হৃদয়ের আবেগে পাঠক তখন জঁপতে থাকেন কবিতার পংক্তিমালা। তেমনি কয়েকটি কবিতার চরণ তুলে ধরছি।

‘ঘুষের টাকায় বাড়ী গাড়ি

দামি খাবার খাচ্ছি

দিনে দিনেই অধঃপতন

ভাবছি কোথায় যাচ্ছি।’

(ভাবছি কোথায় যাচ্ছি)

 

‘ভার্সিটি আর হলগুলোতে

কুকুরগুলোই হিরো,

ওদের হাতেই সব ক্ষমতা

বাকী সবাই জিরো।

অথবা

‘আসল ইস্যু পাশে রেখে

উল্টো পথে চলো,

রাজনীতি ক্যান ভার্সিটিতে

সুশীল সমাজ বলো।’

(রাজনীতি ক্যান ভার্সিটিতে)

‘থানা পুলিশ কব্জা করে

বানান টাকার খনি,

এক জীবনে আর কতটা

চান হতে ভাই ধনী?’

অথবা,

‘লুট করেছেন দেশের টাকা

বাদ কি দিলেন সোনা?

বাদ গেলোনা পাশের বাসার

মিষ্টি হাসির মোনা।’

(নীতির নেতাই দুর্নীতিবাজ)

বৈষয়িক জীবনের হাজারো কষ্ট আর ঘাত প্রতিঘাতকে সাগর সঙ্গমে জলাঞ্জলী দিয়ে কবি রিতা ফারিয়া রিচি মেতে ওঠেন প্রভূর নামের বন্ধনায়। তার লেখায় আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করি গোলা বারুদের মতো তীব্র ঝাঁজ আবার কখনো তার লেখা গোলাপী সুগন্ধে ভরিয়ে দেয় আমাদের চেতনার আরশি। রিতা ফারিয়া রিচি হৃদয়ের কোণে জমে থাকা বিশাল বক্তব্যের অনুভূতিকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে শব্দের নিপূণ ছোঁয়ায় নির্মাণ করেছেন কবিতার উর্বর জমিন।

রিতা ফারিয়া রিচির প্রতিটি ছড়া কবিতায় বিপন্ন মানবতা আর অস্থির সমাজ বাস্তবতার জ্বলন্ত চিত্র আমাদের হৃদয়কে আন্দোলিত করে তীব্রভাবে। তার প্রতিটি লেখায় কোন না কোন শিক্ষামূলক বার্তা আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়। সামাজিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনৈতিকতা, দেশপ্রেম, প্রেম- ভালোবাসা, শৈশব স্মৃতি, নদ-নদী আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নান্দনিক এবং সাবলীল উপস্হাপনায় তার প্রতিটি লেখাই চমৎকার এবং বলিষ্ঠ উচ্চারণ।  রিতা ফারিয়া রিচির ছড়াগুলোর তুমূল জনপ্রিয়তা প্রমান করে তার লেখার শিল্পমান কতটা উন্নত এবং শক্তিশালী!

শব্দের নিপূণ কারুকাজ, বিষয়ের বৈচিত্রতা, বক্তব্যের বলিষ্ঠতা, নান্দনিক উপস্থাপন কৌশল রিচির কবিতাকে ভিন্ন মাত্রায় অভিষিক্ত করেছে। ছড়া-কবিতায় প্রতিনিধিত্ব করার মতো বেশ কিছু মানোত্তীর্ণ লেখায় ঋদ্ধ রিতা ফারিয়া রিচির আবার তোরা জাগ নামক একক ছড়া গ্রন্থটি। জীবনের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া জীবন ঘনিষ্ঠ প্রতিটি লেখাই সুখপাঠ্য।

একজন লেখকের কাজ লিখে যাওয়া। পাঠক আর সময় নির্ণয় করবে কোন লেখাটি কালের বিচারে টিকে যাবে আর কোনটি হারিয়ে যাবে। আমরা প্রচন্ডভাবে আশাবাদী পাঠক আর সময়ের বিবেচনায় বাংলা ছড়া-কবিতায় টিকে যাবে রিতা ফারিয়া রিচির লেখা। বইটির সফলতা কামনা করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *