ক্ষুদ্রকাঠি-হোসেনপুর ট্রাজেডি : ইতিহাসের এক নির্মম গণহত্যা

 

সত্য মিথ্যা, হক বাতিলের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। সুন্দর অসুন্দর, সভ্য অসভ্য, উচিত অনুচিত, খাঁটি ভেজাল, ভালো মন্দ কখনো একত্র হতে পারেনা। উভয়ের পরস্পর বিপরীতমুখী ধারা সমাজ সভ্যতার শুরু থেকে বিদ্যমান। মধ্যযুগের বরিশালের মাটিতেও আমরা তাই দেখতে পাই অন্ধকার আলোককে সহ্য করতে পারছে না। অন্ধকার পৌত্তলিক বা সেকুলারদের সাথে আলোকরশ্মি ইমানদারদের সংঘাত সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। বাকলা চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী ক্ষুদ্রকাঠি-হোসেনপুরে ১৫৯৭-১৫৯৮ সালে নির্মম গণহত্যার শিকার হয় মুসলমান নারী পুরুষ, শিশু কিশোররা। শ্রী কন্দর্প নারায়ণ ও শ্রী রামচন্দ্রের জঙ্গি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সেদিনকার বরিশালের তাওহিদের পতাকাবাহী সমাজ সমূলে ধ্বংস হয়। দক্ষিণাঞ্চল থেকে মুসলিম নিধনের সে এক করুণ ইতিহাস, বেদনাদায়ক ট্রাজেডি।

বাকলা চন্দ্রদ্বীপের বর্তমান নাম বরিশাল। প্রাচীন ও মধ্যযুগে এটি একটি স্বতন্ত্র দেশ ছিলো। মধ্যযুগে এ অঞ্চল শাসন করত কায়স্থ রায় রাজারা। দনুজমর্দ্দন দে ছিলো এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা যার রাজধানী ছিলো বাউফলের কচুয়া। দুনজমর্দ্দন দের উত্তরসূরী কন্দর্প নারায়ণ রায় (১৫৮৪-১৫৯৮) ছিলেন এ বংশের অষ্টম রাজা। ১৫৮৪ সালে জগদানন্দের মৃত্যুর পর তার পুত্র কন্দর্প নারায়ণ সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি প্রথমে রাজধানী কচুয়া থেকে বাকেরগঞ্জের বিশারিকাঠিতে নিয়ে আসেন। কিছুকাল পরে পুনরায় রাজধানী বিশারিকাঠি থেকে ক্ষুদ্রকাঠি স্থানান্তর করেন।

দুর্গাসাগর: অসাধারণ দর্শনীয় স্পট; কিন্তু এর অতীত ইতিহাসে রক্তধারা বহমান ?

ক্ষুদ্রকাঠি বর্তমানে বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলাধীন। এ সময় খানপুরা, ক্ষুদ্রকাঠি, রহমতপুর, হোসেনপুর, ডহরপাড়া, গাজিরপাড়, গুঠিয়া প্রভৃতি গ্রাম মুসলমান অধ্যুষিত ছিলো। ক্ষুদ্রকাঠি সংলগ্ন খানপুরা গ্রামে খাঁ পদবির পাঠান মুসলমানদের বাস ছিলো। রহমত খাঁ মুসলমানদের সর্দার ছিলেন। তাঁর সাথে কন্দর্প নারায়ণের সংঘর্ষ হয়। কন্দর্প নারায়ণ রহমত খাঁ ও তাঁর ভ্রাতাকে হত্যা করেন। আধুনিক যুগে রহমত খাঁর নামানুসারে রহমতপুর এবং খাঁ পদবির মুসলমানদের স্মৃতি রক্ষার্থে খানপুর নামকরণ হয়েছে। কন্দর্প নারায়ণ এ অঞ্চল থেকে মুসলমানদের নির্মূল করে ক্ষুদ্রকাঠিতে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে তার রাজত্ব সুসংহত করেন। রাজা রায় অতি নির্মম নির্দয়ভাবে মুসলিম বসতির ওপর গণহত্যা চালায়। কায়স্থ রাজাদের আগ্রাসন-নৈরাজ্য আজও মানুষকে শিহরিত করে।

রাজা কন্দর্প নারায়ণ রায় ক্ষুদ্রকাঠিতে ঘাঁটি গড়ে মুসলমান সরদারকে তার অনুচরগণসহ এলাকা ত্যাগ করতে বলেন। কিন্তু সরদার তেমন সহজ লোক ছিলেন না, তার যথেষ্ট লোকবল ও কিছু যুদ্ধোপকরণ ছিলো। সরদার পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে অস্বীকার এবং রাজার আদেশ প্রত্যাহার করলেন। উভয়পক্ষে প্রথম তুমুল সংঘর্ষ হয় খানপুরা গ্রামে। রাজা কন্দর্প নারায়ণ রায়ের যুদ্ধ অভিযানে মুসলমান সরদার সদলবলে নিহত হলেন। অনেক মুসলমান ভীত ও ত্রাসিত হয়ে অন্যত্র প্রস্থান করেন। উত্তর পূর্বে দুই মাইল পরিমাণ স্থান মুসলমান শূণ্য হয়।

মুসলমানরা লাখুটিয়া, রহমতপুর, ডহরপাড়া ও গাজিরপাড়ে ঘাটি স্থাপন করেন। কন্দর্প নারায়ণ মুঘল সেনাপতি মানসিংহের সাথে ইতোমধ্যে সন্ধি করে দিল্লির বশ্যতা স্বীকার করেন। কন্দর্প নারায়ণ চুক্তি অনুসারে হোসেনপুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করেন। হোসেনপুর যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে মুসলমানরা ডহরপাড়া ও গাজিরপার থেকে পশ্চাতপসরণ করেন। যুদ্ধে উভয়পক্ষে অনেক সৈন্য হতাহত হয়। অনেক মুসলমানকে বাকলা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করা হয়। কন্দর্প নারায়ণ গাজিরপাড় যুদ্ধে গুরুতরভাবে আহত হয়। আহত অবস্থায় ক্ষুদ্রকাঠি ফিরে আসেন। এখানে পৌঁছেই রাজা দেহত্যাগ করেন।

তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে রামচন্দ্র রায়ের (১৫৯৮-১৬৬৮) নবম রাজা হিসেবে অভিষেক ঘটে ১৫৯৮ সালে। কন্দর্প নারায়ণ জীবিতকালে রাজধানী হোসেনপুরে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। রামচন্দ্র সিংহাসনে আরোহণ করেই হোসেনপুর রাজধানী নির্মাণ শুরু করেন। পঞ্চনদীর সঙ্গমস্থলের পশ্চিমপাড়ে হোসেনপুর। তিনি নদীর পশ্চিম পাশে দীঘি খনন করে কালিমন্দির নির্মাণ করেন। রামচন্দ্র ১৬০২ সালে রাজধানী হোসেনপুর থেকে মাধবপাশায় স্থানান্তর করেন। সিংহাসনে বসেই রামচন্দ্র রায় হোসেনপুর পুরোপুরি মুসলিম শূণ্য করে তদস্থলে হিন্দু আবাস গড়ার প্রজ্ঞাপন জারি করেন। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক বৃন্দাবন চন্দ্র পূততু- তাঁর ‘চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাস’ বইয়ে বলেন, ‘হোসেনপুরের মুসলমান অধিবাসীগণকে বিতাড়িত করে রাজা রামচন্দ্র রায় রাজধানীর চতুর্দিকে নানা শ্রেণির ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, উচ্চ ও নি¤œ শ্রেণির কায়স্থ, শঙ্খবণিক, গন্ধবণিক, মালাকার, কুম্ভকার রাজ, পাটনী, কাহার, তৈলিক, কর্মকার প্রভৃতি জাতির বসতি করান।’ (বৃহত্তর বাকরগঞ্জের ইতিহাস, সংগ্রহ ও সম্পাদনায়: তপংকর চন্দ্রবর্তী ও সিকদার আবুল বাশার, পৃ ৫৪৯-৫৫১) এই হলো বরিশালের দর্শনীয় স্থান দুর্গাসাগর ও মাধবপাশার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট!

তথ্যপঞ্জি :
১. বৃহত্তর বাকরগঞ্জের ইতিহাস, সংগ্রহ ও সম্পাদনায়: তপংকর চন্দ্রবর্তী ও সিকদার আবুল বাশার, আনন্দধারা, প্রথম প্রকাশ, ১লা জানুয়ারি ২০০৪, বাংলাবাজার ঢাকা ১১০০
২. সিরাজ উদদীন আহমদ: বরিশাল বিভাগের ইতিহাস প্রথম খ-, ভাস্কর প্রকাশনী, বরিশাল-ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ জুলাই ২০০৩
৩. ছবি: ইন্টারনেট থেকে গৃহীত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>