আল আমীন
আমাবস্যার কুচকুচে কালো রাত পেরিয়ে পৃথিবীতে এখন আলোয় রাঙা সকাল। রোদ উঠেছে এ বাড়ি-ও বাড়ির ছাদে। চারদিকে পাখিদের কিচিরমিচির ডাকাডাকি। বাড়ির পেছনদিকের কাঁঠাল গাছের ভেতর থেকে ভেসে আসছে দোয়েলের শিস। আহা, কি সুন্দর ঝরা সকাল। আমি চার হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে বিছানায় কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করার পর ওঠে বসলাম। শুনতে পাচ্ছি রান্নাঘরে মায়ের থালা-বাসন নাড়ানাড়ির শব্দ।
একটু মনোযোগ বাড়িয়ে শুনলে মনে হচ্ছে স্টুডিও তে অঞ্জন দত্ত ঝনঝন শব্দে গানের রিয়ার সেল করছেন। এই সকাল নিয়ে অঞ্জন দত্তের খুব সুন্দর একটা গান আছে। গানে সকালে চায়ের দোকানে ধোঁয়া ওড়া থেকে শুরু করে পুরো কলকাতা শহরের একটা বিবরণ দিয়ে শেষ হয়েছে যেখানেই মানুষ আছে সেটাই তো মানবজমিন বলে। বহুবার শুনেছি গানটা।
আমার বাড়িতে উচ্চবিত্ত মানুষদের মত ঝি-চাকরের সুবিধা নেই। সুতরাং আরমান আমার বেডরুমে এক কাপ চা দাও বলে গলা ফাটিয়ে চিল্লিয়েও লাভ হবে না। তবে ভীষণভাবে এক কাপ চায়ের প্রয়োজন বোধ করছি। তাই উঠে রান্নাঘরে গেলাম। নিজ হাতে চিনি কম দিয়ে এক কাপ দুধ চা বানিয়ে নিয়ে ঘরে আসলাম। তারপর জানালা খুলে দিয়ে জানালার পাশে হেলান দিয়ে থাকা চেয়ারে বসলাম। মুহুর্তেই চার দেয়ালের এই ছোট্ট ঘরটার ভেতর দখল নিলো কোথাকার কোন সমুদ্র থেকে লাগামহীন ভাবে ছুটে আসা ঠান্ডা বাতাস। সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। ভোরের বাতাস এমনিতেই একটু ঠান্ডা প্রকৃতির হয়। তবে এই বাতাস যেনো অন্যরকম এক ঠান্ডা।
চায়ে এক চুমুক দিতে না দিতেই সন্ধ্যামনির মুখটা চায়ের কাপের ভেতর ভেসে উঠছে। কাঁদো কাঁদো চোখ। তার সমস্ত ললাট জুড়ে কপট অভিমানের ছাপ। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে হাতের কাছে পেলেই আমাকে খামচে দেবে। এই খামচে দেওয়ার একটা বিশেষত্ব আছে। গতরাতে সন্ধ্যামনির সাথে আমার একটু মন কষাকষি হয়েছে। তাই সে আমার উপর একটু মনঃক্ষুণ্ন।
সে গতরাতে আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলো। বোধহয় আমি তার কাক্ষিত জবাবটা দিতে পারিনি। তার প্রশ্নটা ছিলো-
সন্ধ্যামনিঃ আচ্ছা আপনি আপনার ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি কি চান?
আমিঃ কান্না।
সন্ধ্যামনিঃ কি? কান্না?
আমিঃ হ্যাঁ। কান্না।
সন্ধ্যামনিঃ মানুষ তার ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে কতকিছু চায়। যেমনঃ বৃষ্টি হলেই হাতে হাত রেখে ভিজতে ভিজতে বহুদূর হাঁটতে চায়। সন্ধ্যায় ছাদে এসে সূর্য ডোবা দেখতে চায়। রাতে কে.এফ.সি তে বসে মজার মজার খাবার খেতে চায়।
পহেলা বসন্তে সাদা কাগজে কালো কালি দিয়ে আদুরে হাতে লেখা একখানা প্রেমপত্র পেতে চায়। অথবা লাল পাড়ের সাদা সাফেদ শাড়ী পড়ে হঠাৎ সামনে এসে চমকে দেওয়ার জন্য বলতে চায়। আর বিশেষ করে সবাই সারাজীবন পাশাপাশি থাকতে চায়।
এতকিছু রেখে আপনি কিনা ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে কান্না চান?
আর ইউ ক্রেজি?
আমিঃ হ্যাঁ। সবকিছুর পরেও আমি কান্নাই চাই। তোমার সুক্ষ্ম ভাবে দেওয়া বর্ণনার ওসব কিছুর কিছুই একদম লাগবে না আমার। বলতে পারো রবী ঠাকুরের গানের মত- ‘তোরা যে যা বলিস ভাই,
আমার সোনার হরিণ চাই’ এই টাইপ।
এই কথা শোনার পর সন্ধ্যামনি কাঁদতে কাঁদতে ফোন নামিয়ে রেখেছে। ভেবেছিলো হয়তো পরবর্তীতে আবার ফোন করে আমি তার রাগ ভাঙাবো। অথবা আমার চাওয়ার বিষয় বদলাবো। কিন্তু তার কিছুই করিনি আমি।
সারারাত নিজেই নিজের সাথে কথা বলেছি। নিজেই নিজেকে নানান প্রশ্নে বিদ্ধ করেছি। মনে মনে সহস্রবার বলেছি-
আচ্ছা সবাই কেনো ভালোবেসে সুখ চায়? পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটতে চায়? প্রকাশ্যে হাসতে চায়?
আচ্ছা একবার ডীপলি চিন্তা করে দেখেন তো-
আমরা প্রিয় মানুষটার সাথে কিছু সময়ের জন্য হলেও হয়তো সুখী মানুষের তালিকায় নিজের নাম লিখিয়েছি। হয়তো বসন্তের বিকেলে আগুন ঝরা কৃঞ্চচূড়ার নিচ দিয়ে বহুপথ হেঁটেছি। হয়তো প্রিয় মানুষকে নিজের করে পাওয়ার উন্মাদ আনন্দে প্রকাশ্যে হেসেছি।
কিন্তু কেউ শখ করে হলেও তাকে একটি বারের জন্য হলেও জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি?
নিশ্চয়ই কাঁদিনি।
একবার ভেবে দেখেছেন?
পৃথিবীতে প্রায় সব কিছু নকল হয়। এমনকি হাসিও নকল হয়। বুকের ভেতর দমফাটা কষ্ট লুকিয়ে রেখেও নকল হাসি হাসা যায়।
কিন্তু কখনো নকল কান্না করা যায় না। ভালোবাসাটা যেমন ভেতর থেকে আসে। তেমন কান্নাটাও ভেতর থেকেই আসে।
এসব ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যামনির ফোন। রিসিভ করতেই বললো দেখো বাইরে কি সুন্দর সকাল। রোদ্দুরে রুপোর মত জল।
আমি বললামঃ হুম দেখছি।
সন্ধ্যামনিঃ কি মনখারাপ করেছো আমার উপর?
আমিঃ একটুও না।
সন্ধ্যামনিঃ গতরাতে তুমি ওভাবে কেনো বললে?
জানো?
আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। সারারাত কেঁদেছি। মনে মনে অনেকক্ষণ তোমাকে বকাবকি করেছি। সেজন্য নিজেকে ভীষণ দোষী মনে হচ্ছিল তাই সকাল সকাল ফোন করলাম।
কি এখনো চুপ করে থাকবে?
আমি কিছুই বলছি না। রবীন্দ্র প্রেমীর মত জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। ভেতরে ভেতরে বলছি- খুব ভালোবাসার মানুষের সাথে সবকিছু বলতে নেই। কারন- তাতে নিজে অনেক বেশী শূন্যতা বোধে ডুবে যেতে হয়।
সন্ধ্যামনি জবাব না পেয়ে হ্যালো, হ্যালো করছে।
আমি আরো খানিক চুপ করে থেকে বলে উঠলাম-
সন্ধ্যামনি দেখো বাইরে গর্তে জমে থাকা পানিতে একজোড়া শালিক স্নান করছে।
দেখে মনে হচ্ছে ওরাও একে-অপরের দিকে তাকিয়ে কান্না চাইছে!
One comment on “ছোটগল্প : শুধু কান্না চাই”
nice