বাসকলতা

আল-আমীন

গোধূলির আবির রাঙা প্রহর শেষে বাসক’লতার নিন্দিত কলঙ্ক ঢেকে দিতে ফণিমনসার ঝোপ থেকে ধেয়ে এলো কুচকুচে কালো আঁধার। শ্রাবণের আকাশ হঠাৎ নেই হয়ে গেছে। ধুলো আর পরসা পরসা বৃষ্টির সঙ্গমে পল্লীর রাস্তায় কর্দমের ছড়াছড়ি।
মানবশূন্য পল্লীর জনপদ। মৃত্যুর ভয় উপেক্ষা করে জোনাকিরা বের হয়নি ঘর ছেড়ে। বাতাসে এখন একাকিত্বের যন্ত্রণা লাঘব করতে না পারার শোকে কাতর হয়ে চুপচাপ বসে থাকা ঈশ্বরের দীর্ঘশ্বাসের মত ভারী ভাব।
বিষধর সর্পের বিষমাখা দংশনের ভয়ে সন্ধ্যায় ঘরের সাথে লাগোয়া ফুল বাগিচায় একটাও হাসনাহেনা ফোটেনি। ‘এসো পড়ি’ রাত্রিকালীন বিদ্যাপিঠ স্কুলের একজন বয়স্ক ছাত্র-ছাত্রীও আসেনি আজ!

সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে মাঠ ফেরত এক বৃদ্ধের গরুর গাড়ি আটকে গেছে মৃধা বাড়ির খামারে। আমি ঘরে বসে তার সকল হা-হুতাশ শুনতে পাচ্ছি। কেউ নিজের সাহায্যের কোমল হাত এগিয়ে দিচ্ছি না তার দিকে। হয়তো অপরকে কষ্ট পেতে দেখলে নিজের ভেতর সাচ্ছন্দ্য বোধটা উপচে ওঠে তাই। অনেক টানা ছেঁড়া করে শেষমেশ উনি নিজেই উঠলেন। তারপর নিজের বুকপকেট থেকে সস্তা চুরুট বের করে তাতে আগুন লাগিয়ে চাপাকন্ঠে গান গাইতে গাইতে ফের গন্তব্যের দিকে রওনা দিলেন।
বৃদ্ধের গাওয়া গানটা ছিলো- ‘তোরা কেউ যাইস নে ও পাগলের কাছে, পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি বুঝবি শেষে!’

অনেকদিন হলো, প্রকাশ, অঙ্কন, তমাল, কিরণ, সবুজ, সুহাস, এদের কারো সাথে একত্রে বসা হয়নি। সবাই একজোট হয়ে বর্ষাকালের মেঘ পেরিয়ে গিয়ে বসা হয়নি মিল্টন মামার চায়ের দোকানের শতছিন্ন টিনের ছাউনির নিচে। শীতল বুকের ভেতর ঢেলে দেওয়া হয়নি গরম চায়ের উঞ্চ পরশ। কতদিন সুহাসের ব্যর্থ প্রেমের পান্ডুলিপি পড়ার পর একজন আরেক জনের শরীরের উপর ঢলে পড়া হয়নি।
সুহাস খুব অল্পভাষী টাইপের ছেলে। অনেকটা জয় গোস্বামীর কথার মত- ‘আমি মুখে কিছু বলতে পারিনা, তাইতো লিখি !

সুহাস মনে মনে একটা মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসতো। ওই মেয়ের নাম ছিলো পূরবী। শ্যামলা গোত্রবর্ণ। মাথাভর্তি পাকা জামের দেহের মত কালো চুল। মুখভর্তি খই রঙা হাসি। ঠোঁট দু’টো শালিক পাখির আব্রু ঢেকে রাখা পশমের মত খয়েরী। চোখ দু’টো খেঁয়া ঘাটে বেঁধে রাখা জেলেদের নৌকার মত। সব মিলিয়ে অসম্ভব সুন্দরী ছিলো পূরবী নামের সেই মেয়ে।
মেয়েটিকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছিলো সুহাস। তবে তার বেশি কথা বলার অনভ্যস্ততায় আমরা কেউ সেটা বুঝতে পারিনি। আমরা কেউ বুঝতেই পারিনি চুপ থাকা মানুষের মধ্যে মানুষকে এত গভীরভাবে ভালোবাসার শক্তি থাকতে পারে।

পূরবীকে সুহাস তার জীবনসঙ্গিনী হিসাবে পায়নি। তবে এই অপ্রাপ্তির ভেতর তার যতটুকু প্রাপ্তি আছে সেটা প্রাপ্তির সুখের চেয়ে অনেক অনেক গুন বেশি। সুহাসের আত্মহত্যার পর তার লেখা একটা পান্ডুলিপি পাওয়া যায় তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে। সেই পান্ডুলিপির সুত্র ধরে আমরা পূরবী সম্পর্কে জানতে পারি।
সুহাস পূরবীকে অসংখ্য চিরকুট লিখেছে তবে সেগুলো কখনো তাকে দেয়নি। তার একটা চিরকুটে লেখা ছিলো- ‘পূরবী, তোমাকে না বলতে পেরে এত্ত কথা আমার হৃদয়ে জমা হয়েছে যার ভার ডাকবিভাগ বইতে পারবে না। তাই সব কথা নিজের কাছেই রেখে দিয়েছি, একদিন তোমাকে সব বলবো!’
আমি জানিনা সুহাসের মত ওমন মুখচোরা মানুষ পূরবীকে সব জমানো কথা আদৌ বলতো কিনা। কারণ অল্পভাষী মানুষদের কাছে তাদের জমানো কথাগুলোই হলো তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। এবং এটা অনেকটা নারী সতিত্বের মত।

বাহির জগত থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকালাম দেয়াল ঘড়ির দিকে। তাকিয়ে বোধ করলাম দেয়াল ঘড়ির সর্বসময় ঘূর্ণিয়মান সেকেন্ডের কাঁটাটা পাগলের গান গাইতে গাইতে ঘরে ফিরে যাওয়া বৃদ্ধের মেঠো রাস্তায় আটকাপড়া যানবাহনের মত আটকে গেছে।

আজ এমন ঘটা করে সময় অনুসন্ধানের কারণ হলো ডাকযোগে আমার প্রিয়তমা আমাকে একটা চিরকুট পাঠাবে বলেছিলো। এতক্ষণে তো ডাকপিয়ন পরিমল দাদা তার দ্বিচক্রযানের (সাইকেলের) কিং কিং বেল চাপতে চাপতে আমার বাড়ির উঠানে পৌঁছে যাবার কথা। কিন্তু এখনও এলো না। অপেক্ষার সময় যে কতটা দীর্ঘ সেটা হয়তো পরিমল দাদার এই অনুপস্থিতির কারণ ছাড়া ঠিকঠাক অনুধাবন করা হতো না। এই ডাকপিয়নদের জীবন ভীষণ অদ্ভুত। এদের হাত দিয়ে কত শব্দ, কত কথা, কত অনুভূতি, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পারাপার হয় তবুও তারা সেগুলোর একটি শব্দও জানে না। এরা শুধু খামবন্দি শব্দদের বাহক মাত্র।

ঠিক এমনই একটা কথা আইনস্টাইন একবার চার্লি চ্যাপলিনকে বলেছিলেন- ‘তোমার ব্যাপারটা আমার দারুণ ইন্টারেস্টিং লাগে। তোমার ছবিতে তুমি একটা কথাও বলো না, অথচ দুনিয়ার লোকেরা বুঝে ফেলে তুমি কী বলছো, বলতে চাইছো। তারা তো চার্লি বলতে অজ্ঞান।’
তারপর কথার উত্তরে চ্যাপলিন বলেছিলেন- ‘কিন্তু তোমার ব্যাপারটা আমার কাছে আরো বেশি ইন্টারেস্টিং লাগে। দুনিয়ার প্রায় সব লোকই আইনস্টাইন বলতে অজ্ঞান। এবং অনেকের ধারনা সায়েন্টিস্ট মানেই হলো আইনস্টাইন। অথচ তুমি যা বলো, তার একবর্ণ বোঝে না তারা!’
এই বিষ্ময়গর্ভা পৃথিবীতে কেউই কাউকে পুরোপুরি বোঝে না। যেমনঃ- আলবার্ট আইনস্টাইনের কথা বোঝেনি তার একান্ত ভক্তরা। জীবনানন্দকে বোঝেনি তার বনলতা। কাদম্বরী দেবীর ভালোবাসাকে বোঝেনি রবি ঠাকুর!

চারপাশে সুবহে সাদিকের পবিত্র বাতাসের মৃদু আভাস পাচ্ছি। হয়তো এখনি এই পবিত্র বাতাসে গ্রাম ছাপিয়ে দাড়িয়ে থাকা মসজিদের উঁচু মিনার থেকে মুয়াজ্জিনের সুরেলা কণ্ঠের আযানের ধ্বনি ভেসে আসবে। আজকের মত সপ্তম আসমানে ফেরত যাবে আল্লাহ প্রদত্ত দুনিয়াবি কর্মকান্ডের হিসাবরক্ষক ফেরেশতারা।
পৃথিবীতে আবার নতুন একটা দিন শুরুর জন্য সূর্যের কাছ থেকে আলোর চিঠি আসবে। যে আলোয় বাসকলতার সুপ্ত কলঙ্কগুলো আবার ফের দৃশ্যমান হবে!
.

গল্পকার: আল-আমীন।
ফেসবুক লিংক- https://www.facebook.com/mdalamin.khan.73594479

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *