বিবেক

প্রফেসর এ কে এম আবদুল কাদের

‘বিবেক’ একটি বাংলা শব্দ। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Conscience. ইংরেজি Conscience কথাটি এসেছে ল্যাটিন Conscientia শব্দ থেকে যার বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘ন্যায়-অন্যায়বোধ’ বা ‘নীতিবোধ’। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থের দিক থেকে বলা যেতে পারে যে, মানুষের আচরণের ঔচিত্য বা অনৌচিত্য নির্ধারণ করার জন্য ‘নীতিবোধ’ নামক যে মানসিক শক্তির প্রয়োজন হয়, তাকেই বিবেক বলা হয়। অর্থাৎ যে মানসিক শক্তি বা ক্ষমতা দ্বারা আমরা ঐচ্ছিক ক্রিয়ার নৈতিক গুণ বা কর্মের ভাল-মন্দ নির্ধারণ করতে পারি, তাকেই বলা হয় বিবেক। সহজ কথায়, যে মানসিক শক্তির সাহায্যে আমরা কর্মের নৈতিক মূল্য নির্ধারণ করি তাকে বিবেক বলে।
মানুষের মানসিক শক্তির অপর নাম হলো নীতিবোধ শক্তি। আর এই নীতিবোধ শক্তিই হলো মানুষের বিবেক। মানুষ বিবেকের ক্ষমতার সাহায্যে কর্মের নৈতিক গুণ উদ্ঘাটন করতে সমর্থ হয়। বিবেকের সাহায্যেই মানুষ তার কর্মের ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, প্রশংসা-নিন্দা, গৌরব-অগৌরব, কল্যাণ-অকল্যাণ ইত্যাদি বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে পারে। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, বহিরেন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যেমন বহির্জগতের বস্তু সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করেত পারি, তেমনিভাবে অন্তরেন্দ্রিয় তথা বিবেকের সাহায্যে আমরা আমাদের কাজের নৈতিক গুণ সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতে পারি। অর্থাৎ কাজের ন্যায়-অন্যায় বা ভাল-মন্দ বিচার করতে পারি।
বিভিন্ন নীতিবিজ্ঞানী বিবেক সম্পর্কে নানাভাবে তাঁদের মতামত প্রকাশ করেছেন। বিবেক সম্পর্কে কয়েকজন প্রখ্যাত নীতিবিজ্ঞানীর মতামত নিম্মে তুলে ধরা হলো: পাশ্চাত্য নীতিবিজ্ঞানী বিশপ বাটলার-এর মতে, কোন কাজের ভাল-মন্দ বা ন্যায়-অন্যায় বিচার করার জন্য ব্যক্তির বিবেক সর্বদা মানুষের চরিত্র, আচরণ, উদ্দেশ্য, অভিপ্রায় ইত্যাদি বিষয়গুলো জানতে চেষ্টা করে এবং বিবেক সচেতন হয়ে অন্তর্দৃষ্টির সহায্যে বুঝতে চেষ্টা করে যে, ভালে কাজের পরিণাম সুখ এবং মন্দ বা খারাপ কাজের পরিণাম সর্বদা দুঃখ বহন করে আনে। তদনুসারে বিবেক কাজটিকে চিহ্নিত করতে সমর্থ হয়। বাটলারের মতে, বিবেক কেবল কাজের ভাল-মন্দই নির্ধারণ করে না, বিবেক যে কাজ ভালো বা উত্তম সে কাজ সম্পাদন করতে এবং যে কাজ মন্দ তা থেকে বিরত থাকতেও নির্দেশ দেয়।
নীতিবিজ্ঞানী অধ্যাপক সি ডি ব্রড-এর মতে, বিবেকের রয়েছে দু’ধররেন প্রকৃতি যার একটি হচ্ছে প্ররোচক এবং অপরটি হচ্ছে প্রতিরোধ। অর্থাৎ বিবেক যেমন কর্ম সম্পাদনের জন্য ব্যক্তিকে প্ররোচিত করে, তেমনিভাবে কোন কোন কর্ম না করার জন্যও ব্যক্তিকে প্রতিরোধ করে। তাঁর মতে, বিবেকের মধ্যে একটা অনুভূতির দিকও রয়েছে। কেননা, বিবেক যখন একটি কাজকে অনুচিত মনে করে, তখন এই বিবেকের প্রভাবে আমাদের মনের মধ্যে একটি বেদনাদায়ক অনুভূতিরও সৃষ্টি হয়।
নীতিবিজ্ঞানী অধ্যাপক লিলি-এর মতে, বিবেক স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুধু বলে দেয় যে, কি আমাদের করা উচিত অথবা কি আমাদের করা উচিত নয়। তাঁর মতে, একটি ঘৃণ্য বা অনুচিত কাজ দেখলে বিবেক আমাদের মনে একটা অপ্রীতিকর অনুভূতির উদ্রেক করে। আবার একটি কাজ ন্যায় বা ভালো হতে দেখলে বিবেক আমাদের মনে একটা প্রীতিকর অনুভূতি সৃষ্টি করে। কাজেই বলা যেতে পারে যে, বিবেকের মধ্যে অনুভূতিমূলক একটি দিকও রয়েছে। লিলির মতে, দৈনন্দিন জীবনে আমরা বলে থাকি যে, মনের ভেতর থেকে কে যেন বলে দেয়-এটা কর বা এটা করা উচিত ছিল। একথা মনের ভেতর থেকে যে বলে দেয় তার নামই বিবেক।

জার্মান দার্শনিক ও নীতিবিজ্ঞানী ইমানুয়েল কান্ট-এর মতে, বিবেকের আদেশ সর্বদা যথোচিত ও অভ্রান্ত। অর্থাৎ কান্ট দাবি করেন যে, বিবেক ন্যায়-অন্যায় বিচার করতে কখনো ভুল করতে পারে না। কাজেই বিবেকের আদেশ সর্বদা নির্দ্বিধায় মেনে চলা উচিত। কান্টের মতে, ভ্রান্ত বিবেক বলে কিছু নেই। নীতিবিজ্ঞানী পি বি চ্যাটার্জি বলেন, ‘বিবেকের কোন ভুল ভ্রান্তি হয় না। বিবেককে কোন কিছু শিখানো যায় না।’ অর্থাৎ বিবেক সব সময়ই আপন গতিতে চলে।
পূর্ণতাবাদী নীতিবিজ্ঞানীদের মতে, বিবেক স্বতঃস্ফূর্তভাবে নৈতিক আদর্শ নিঃসৃত নৈতিক নিয়মাবলি পরিব্যক্ত করে। বিবেক নৈতিক নিয়মসমূহ বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে কাজের ভাল-মন্দ, ঔচিত্য-অনৌচিত্য নির্ধারণ করে থাকে। বিবেক কোন দুর্বোধ্য শক্তি নয়, বিবেক হচ্ছে সমগ্র আত্মা যা নিজের কার্যাবলির বিচার করে থাকে। এ প্রসঙ্গে নীতিবিজ্ঞানী মূরহেড তাঁর Elements of Moral গ্রন্থে বলেন, ‘বিবেক হলো সমগ্র বা প্রকৃত আত্মা যা নিজের বিভিন্ন অংশের জন্য আইন প্রণয়নের দাবিদার। বিবেকের দাবি এই যে, আত্মা সচেতন ও বিচার শক্তিসম্পন্ন সত্তা, যা ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মধ্যে নিজের বিশেষ অভিব্যক্তির বিচার করে।’
বিবেককে আদালতের বিচারকের সাথে তুলনা করা যেতে পরে। কেননা, প্রতিটি আদালতে বিচারকার্য সম্পন্ন করার জন্য বিচারক থাকেন, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন জীব হিসেবে মানুষের ক্ষেত্রেও কাজের ন্যয়-অন্যায় বিচার করার জন্য প্রতিটি ব্যক্তির ভেতরে এক ধরনের আদালত রয়েছে এবং সেই আদালতের বিচারক হচ্ছে ব্যক্তির বিবেক। আদালতের বিচারক যেমন কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অন্যায় কাজের বিচার করে থাকেন, তেমনিভাবে বিবেক নামক বিচারকও ব্যক্তির অন্যায় কাজের বিচার করে থাকে। আদালতের বিচারক জেল বা জরিমানার মাধ্যমে অন্যায় কাজের বিচারকার্য সম্পন্ন করেন। কিন্তু বিবেক নামক বিচারক ব্যক্তির অন্যায় কাজের বিচার করে থাকেন বিবেকের দংশন নামক শাস্তির মাধ্যমে। আদালেতের সব বিচারকের বিচারকার্যের রায় যেমন সর্বদা একই রকম হয় না, ব্যক্তির বিবেকের বিচারের রায়ও তেমনি অনেক সময় এক রকম হয় না। কেননা, সব মানুষের একই রকম বিবেক থাকে না। কোন কোন মানুষের বিবেক অত্যন্ত সবল ও শক্তিশালী, আবার অনেকের বিবেক অত্যন্ত দুর্বল থাকে। কাজেই একই অন্যায় কাজের জন্য সবল বা শক্তিশালী বিবেকের বিচার এবং দুর্বল বিবেকের বিচার ভিন্ন রকম হতে পারে। কেননা, বিবেকের বিচারকার্য বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভ্রান্তি ঘটতে পারে এবং অনেক সময় ঘটেও থাকে।
এখানে একটি প্রশ্ন আসতে পারে যে, বিবেক কি স্থিতিশীল না পরিবর্তিত হয় ? এ প্রশ্নের উত্তরে এক কথায় বলা যেতে পারে যে, বিবেক স্থিতিশীল নয়, বিবেক পরিবর্তনশীল এবং সব মানুষের বিবেক একই মাত্রায় থাকে না। কেননা, পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, অনেকের বিবেক খুবই শক্তিশালী, আবার অনেকের বিবেক খুবই দুর্বল। এছাড়া, অনেক সময় পরিবেশ, পরিস্থিতি, সুশিক্ষা, সঠিক জ্ঞান অর্জন ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যাক্তির বিবেক পরিবর্তিত হয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। আবার খারাপ পরিবেশ, পরিস্থিতি, কুশিক্ষার কারণে ব্যক্তির বিবেক দুর্বল হয়ে যেতে পারে অর্থাৎ সুশিক্ষা ও অনুশীলনের মাধ্যমে বিবেকের শক্তি শানিত, বিকশিত ও উন্নত হতে পারে। আবার এর বিপরীতে নানা কারনে বিবেক দুর্বলও হয়ে যেতে পারে। এমনকি ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারনে একই ব্যক্তির বিবেক এক এক সময় এক এক রকম হতে পারে। সুতরাং বিবেকের বিচার সর্বদা নির্ভুল হবে অথবা একই রকম হবে এমনটা দাবি করা য়ায় না।
পরিশেষে বলা যেতে পারে যে, বিবেককে চাক্ষুষভাবে প্রত্যক্ষ করা না গেলেও একে উপলব্ধি করা যায়। বিবেককে কোন অবস্থায় কোনভাবেই ফাঁকি দিয়ে কাজ করা যায় না। প্রতিটি ব্যক্তির কাজের ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বিচার করার ক্ষমতা তার বিবেকের রয়েছে। যে ব্যক্তির বিবেক যত শক্তিশালী তিনি ততই অন্যায় কাজ করা থেকে বিরত থাকেন। সর্বদা কেউ ন্যায় কাজ করলে তার বিবেক শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং সর্বদা কেউ অন্যায় কাজ করতে থাকলে তার বিবেক আস্তে আস্তে দুর্বল বা শক্তিহীন হয়ে পড়ে। আর শক্তিশালী বিবেক সর্বদা অন্যায় কাজে বাধা প্রদান করে থাকে। কিন্তু শক্তিহীন বা দুর্বল বিবেক অন্যায় কাজে বাধা প্রদানের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। সুতরাং আমাদের সকলের উচিত সৎ, ন্যয় ও ভাল কাজের মাধ্যমে বিবেককে শক্তিশালী করে তোলা এবং বিবেকের অনুশাসন মেনে যথারীতি জীবন যাপন করা।

প্রফেসর এ কে এম আবদুল কাদের
সাবেক অধ্যক্ষ, বরগুনা সরকারি কলেজ, বরগুনা
সাবেক বিভাগীয় চেয়ারম্যান, দর্শন বিভাগ, সরকারি বি এম কলেজ, বরিশাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *