আহমেদ বায়েজীদ ।।
ফেসবুকের ইনবক্সে একটা বার্তা প্রায়ই পাই, ‘ভাইয়া, লেখালেখি করতে চাই; কিন্তু কোথায় লিখবো, কী লিখবো বুঝতে পারছি না’। বেশি পরিচিত, অল্প পরিচিত কিংবা প্রায় অপরিচিত (কিন্তু ফেসবুক ফ্রেন্ড) এমন লোকদের কাছ থেকে বার্তাটা আসে। বিশেষ করে যারা জানেন যে, আমি এই অঙ্গনে বিচরণ করি- তারা সাধারণত এসব বার্তা পাঠান। লেখালেখিতে আগ্রহ তৈরি হলে পরামর্শ চান।
ফেসবুক কিংবা হোয়াটসঅ্যাপের যুগ আসার আগেও এমন পরামর্শ চাওয়া হতো। তখন চায়ের আড্ডায় কিংবা ক্যাম্পাসের গাছের ছায়ায় এমন পরামর্শ চাইতেন। আমিও সবাইকে সাধ্যমত পরামর্শ দেয়ার চেষ্টা করি। কেউ আবার লেখা পাঠিয়ে বলেন, ‘একটু ঠিকঠাক করে দিন’।
আল্লাহ আমাকে এ ব্যাপারে বিশেষ ধৈর্য দিয়েছেন বলেই হয়তো কখনো বিরক্ত বোধ করিনি। এমনও হয়েছে, লেখা ‘সাইজ করে’ সেটা কোন পত্রিকার উপযোগী তাও আমাকে চিন্তা করতে হয়েছে। তারপর পত্রিকা অফিসে আমিই পাঠিয়েছি। লেখা ছাপা হয়েছে।
কী লিখবেন
লেখালেখিতে আগ্রহী হয়ে ওঠা নতুনরা শুরুতে এই বিষয়টা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। তারা বুঝে উঠেতে পারেন না, কী বিষয় নিয়ে লেখা উচিত। সেটা নিয়েই শুরুতে আলোচনা করবো।
পড়তে পড়তে একজন পাঠকের মনে লেখক সত্ত্বা জেগে ওঠে। পড়ার অভ্যাস নেই এমন কেউ লেখক হতে পারে না। আবার টার্গেট করেও লেখক হওয়া যায় না। বিশেষ ক্ষেত্রে টার্গেট করে হয়তো কিছু লেখা তৈরি করা যায়; কিন্তু লেখক হওয়া সম্ভব নয়। লেখক হতে গেলে লেখার তাগিদটা ভেতর থেকে আসতে হয়। একজন পাঠক যখন পত্রিকা, ম্যাগাজিন, গল্প, উপন্যাস-নানা কিছু পড়তে থাকেন- যদি তার মনের কোনে লেখক সত্ত্বা লুকায়িত থাকে- তখন সেটা জেগে ওঠে। শর্ত হলো, অবশ্যই এই সত্ত্বা নিজের ভেতর থাকতে হবে।
লেখক সত্ত্বা যখন জাগবে তখনই আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কী বিষয়ে লিখবেন। দুনিয়ার এমন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে লেখা যায় না; কিন্তু সব বিষয় আপনার জন্য নয়। তাই এক্ষেত্রে আগে নিজেকেই প্রশ্ন করুন, কোন বিষয়টির প্রতি আপনার আগ্রহ বেশি? কোন বিষয় পড়তে আপনার ভালো লাগে? তারপর ভাবুন, কোন বিষয়ে আপনার একটু ভালো জানাশোনা রয়েছে।
লেখার বিষয়
এই তিনটি বিষয়ের সম্মিলন ঘটিয়ে খুঁজে বের করুন আপনার লেখার সাবজেক্ট। যার খেলাধূলায় আগ্রহ নেই তিনি ক্রীড়া বিষয়ে লিখতে শুরু করলেও তা এগোবে না। একসময় আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। যিনি কবিতা পছন্দ করেন, কবিতা পড়েন- তিনি আন্তর্জাতিক বিষয়ে লিখতে গেলে কি আর হবে!
আবার লেখা কোথায় প্রকাশ করবেন- সেটির ওপরও অনেক সময় লেখার ধরণ নির্ভর করে। স্থানীয় লিটলম্যাগে আপনি প্রায় সব ধরণের লেখাই দিতে পারবেন; কিন্তু প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা বা ম্যাগাজিনকে টার্গেট করে লিখতে হলে আপনাকে তার মেজাজটা বুঝতে হবে।
কাজেই আপনার আগ্রহ, জানাশোনা আর লেখার সুযোগ- এই তিনটি মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিন যে, আপনি কোন বিষয়ে লিখবেন। এরপর খুঁজে বের করুন এ ধরণের লেখা কোথায় ছাপা হয়। সেটা বুঝতে পারাও জরুরি। যেমন আমি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে বেশি লেখি, তাই সাহিত্য পত্রিকার দিকে চেয়ে থাকলে আমার হবে না।
আবার ধরুন, কিশোর কণ্ঠ খুব জনপ্রিয় একটি ম্যাগাজিন, এখানে প্রতিমাসে খেলাধূলা বিষয়ে ফিচারধর্মী একটি লেখা ছাপা হয়। একজন অভিজ্ঞ লেখক সেটা লিখে থাকেন। তাই আপনি কাঁচা হাতে সেই বিভাগে লেখা পাঠালে ছাপা না হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৯৯ ভাগ; কিন্তু যারা শিশুতোষ ছড়া, গল্প, ফিচার লিখবেন তাদের জন্য কিশোর কণ্ঠ আদর্শ জায়গা হতে পারে।
আবার আপনার যদি ইচ্ছে হয় পত্রিকায় কলাম লিখবেন। তাহলে পত্রিকার উপসম্পাদকীয় পাতা হবে টার্গেট। তবে এই পাতায় নতুন লেখক হিসেবে আপনার কলাম ছাপা নাও হতে পারে, তাই পরিচিতি বৃদ্ধি ও নিজেকে ঝালিয়ে নেয়ার জন্য চিঠিপত্র কলাম দিয়ে শুরু করুন। এখানে স্থানীয় সমস্যা কিংবা সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে ছোট ছোট লেখা পাঠান। আবার অনেক পত্রিকা সপ্তাহে একদিন পাঠকের জন্য বিশেষ পাতা বের করে (যেমন যুগান্তরে বুধবার দৃষ্টিপাত পাতা), এখানেও পাঠক ও নবীন লেখকদের লেখা ছাপানো হয়।
যদি রম্য লিখতে চান তবে পত্রিকার ফান ম্যাগাজিনগুলোকে টার্গেট বানাতে পারেন। আবার বরিশাল থেকে প্রকাশিত মুক্তবুলির মতো লিটলম্যাগ প্রায় সব ধরণের লেখাই ছাপায়। নবীনদের জন্য লিটলম্যাগ আদর্শ জায়গা। আবার কখনো এমন হয়, হঠাৎ একটা টপিক মাথায় চলে আসে, লেখার ঝোঁক তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে লিখে ফেলুন, তারপর চিন্তাভাবনা করে কোথাও পাঠান। লেখার আইডিয়া মাথায় এলে কোথায় পাঠাবেন সেই চিন্তায় আবার লেখা বন্ধ রাখবেন না যেন!
আরেকটি কথা, লেখকদের সাথে আড্ডা দেয়া কিংবা যোগাযোগ রাখলেও অনেক সময় লেখার নতুন নতুন জায়গা সম্পর্কে খবর মেলে।
লিখতে শুরু করার আগে
কোন বিষয়ে লিখতে শুরু করার আগে সেই বিষয়ে ভালো করে জানার চেষ্টা করুন। ধরুন, দৈনিক পত্রিকা পড়তে পড়তে আপনার ক্যাম্পাস পাতাটির প্রতি আগ্রহ তৈরি হলো। তাহলে বিভাগটি ভালো করে পড়ুন কিছুদিন। লেখা পাঠানোর নিয়মগুলো জানুন। তারা কী ধরণের লেখা ছাপায় সেটি বুঝতে চেষ্টা করুন। তারপর আপনার ক্যাম্পাসের কোন বিষয় নিয়ে লিখে ফেলুন। শব্দ সংখ্যা বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। দৈনিক পত্রিকা সাধারণত ৩০০-৪০০ শব্দের লেখা বেশি ছাপে। ম্যাগাজিন হলে বড় লেখাও ছাপার সুযোগ থাকে। লেখাটি যদি ফিচারধর্মী হয় তাহলে অবশ্যই সঙ্গে এক বা একাধিক ছবি পাঠাবেন।
লেখা শুরু করার আগে হোমওয়ার্ক করুন এবং একটি ফোকাস পয়েন্ট নির্ধারণণ করুণ। মানে লেখার মাধ্যমে পাঠককে আপনি কী বলতে চান। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে যেমন লেখা যায়, আবার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি কিংবা মসজিদ নিয়েও আলাদা লেখা তৈরি করা যায়। এ জন্য ফোকাস পয়েন্ট জরুরি। লেখার বিষয় লাইব্রেরি হলে, বইয়ের সংগ্রহ কেমন সেটাই হবে মূখ্য। ল্যাবরেটরি হলে গবেষণার কতটা সুযোগ আছে সেটা হবে ফোকাস পয়েন্ট।
কেস স্টাডি
সম্প্রতি সাপে কাটা এবং এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ছোট একটি লেখা তৈরি করি। গ্রামে থাকি। বর্ষায় সাপের উপদ্রপ দেখে বিষয়টি মাথায় আসে। ভেবে দেখলাম, সাপে কাটার কোন চিকিৎসা গ্রামে নেই, অথচ গ্রামেই সাপের উপদ্রপ বেশি। এখানে মানুষ ওঝা ডাকতে অভ্যস্ত। এই চিন্তা থেকে আমি লেখাটির দুটি ফোকাস পয়েন্ট ঠিক করি ১. সাপে কাটলে কী করতে হবে ২. গ্রাম পর্যায়ে সাপে কাটার চিকিৎসা ছড়িয়ে দেয়ার দাবি।
এরপর হোমওয়ার্ক শুরু করলাম। প্রথমে সাপ সম্পর্কে ইন্টারনেটে তথ্য সংগ্রহ করি। বাংলাদেশ কত ধরণের সাপ আছে, কত সাপ বিষাক্ত আর কত নির্বিষ, কোন অঞ্চলে বেশি সাপে কাটার প্রবণতা এবং এর চিকিৎসারই বা উপায় কী। গুগলে সার্চ করে বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য ওয়েবসাইট থেকে তথ্য জোগাড় করি। প্রথম আলো অনলাইনে সাপ বিষয়ে একটি নিবন্ধ পাই একজন পরিবেশ বিজ্ঞানীর লেখা। আমি সেখান থেকে কিছু তথ্য নোট করি। বিশ্বব্যাপী সাপে কাটার তথ্য সংগ্রহ করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটেও ঘুরে আসি।
ইন্টারনেটে অনেক আজগুবি ও ভূয়া খবর এবং তথ্য থাকে। তাই যে ওয়েবসাইট থেকে তথ্য নিবেন সেটি কতটা আস্থা রাখার মতো তা খেয়াল রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বিশিষ্টজনদের লেখা বা প্রথম সাড়ির পত্রিকাকে প্রাধান্য দিন। তবে জাতীয় দৈনিক পত্রিকার অনলাইনেও অনেক সময় ভুল তথ্য থাকে। (এটি একদিনে হবে না। ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটির অভ্যাস হলে আপনি কয়েকদিন পর নিজেই বুঝে যাবেন কোন তথ্যটি আস্থা রাখার মতো)।
যাই হোক…… এরপর আমি সাপ নিয়ে লেখাটি সাজাই। দু’এক লাইনে সূচনা পর্বের পর বাংলাদেশের সাপ ও সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা সম্পর্কে তথ্য দেই। এক্ষেত্রে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (এনসিডিসি) দেশব্যাপী পরিচালিত জরিপের তথ্য তুলে ধরি। লেখাটি পত্রিকা কর্তৃপক্ষ ও পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য এই রেফারেন্স জরুরি ছিল। (তবে এ তথ্যটা আমি টার্গেট করে খুঁজিনি, ইন্টারনেট ঘাটতে গিয়ে ভাগ্যক্রমে পেয়ে যাই। এভাবে হোমওয়ার্ক করতে গেলে নতুন নতুন পয়েন্ট বের হবে)।
দ্বিতীয় ধাপে রোগীদের কী করা উচিত সেটা সম্পর্কে বলি এবং শেষে ইউনিয়ন পর্যায়ে এন্টিভেনম ও প্রশিক্ষিত চিকিৎসক রাখা কেন জরুরি সেটা বলতে চেষ্টা করি। সব মিলে ৪০৫ বা ৪০৭ শব্দে শেষ হয় লেখাটি।
লেখা শেষে
লেখাটি কয়েকবার বার পড়ুন। লেখায় সাধারণত তিন ধরণের ভুল থাকে- বানান, বাক্য গঠনে ত্রুটি ও তথ্যগত ত্রুটি। লিখে কয়েকবার পড়ুন। কয়েক ঘণ্টা পর অথবা এক-দুই দিন পর আবার পড়ুন। (এই লেখাটি আমি ১৫ আগস্ট, ২০২৩ সন্ধ্যায় লিখেছি। ১৬ আগস্ট ভোরে মুক্তবুলিতে পাঠানোর আগে পড়তে গিয়ে বেশ কিছু সংশোধন করতে হলো।)
লেখা শেষ হলে পত্রিকা অফিসে পাঠানোর জন্য লেখকের মাঝে একটি তাড়াহুড়ো তৈরি হয়। এটি দোষের কিছু নয়; কিন্তু একটু ধৈর্য্য ধরে কাজটি নিখুঁত করতে পারলে আপনারই লাভ। প্রতিবার পড়লেই দেখবেন কিছু না কিছু সংশোধন হবে। আর যদি অভিজ্ঞ কাউকে দেখানো যায় তাহলে তো কথাই নেই।
আমার মনে আছে, অনার্সে পড়ার সময় বরিশালের স্থানীয় দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলের চিঠিপত্র কলামে লিখতে শুরু করি। মুক্তবুলি সম্পাদক আযাদ আলাউদ্দীনের সাথে তখন নতুন পরিচয়। জানলাম, তিনি সাংবাদিকতা ও লেখালেখি করেন। ভয়ে ভয়ে একদিন একটি লেখা নিয়ে তার বগুড়া রোডের মেসে যাই। লেখাটি দেখার পর তিনি বললেন ‘ঠিক আছে’।
ব্যাস, পাঠিয়ে দিলাম দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলে এবং ছাপা হলো। এভাবে ২/৩টি লেখা তাকে দেখানোর পর আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলাম এবং চলতে থাকলো প্রফেশনাল লেখার চর্চা।
আহমেদ বায়েজীদ প্রফেশনাল কন্টেন্ট রাইটার, ০১৯২৫২৬২৫২৭
নোট: নতুন লেখকদের জন্য গাইড লাইন হিসেবে আযাদ আলাউদ্দীনের লেখা ‘সাংবাদিকতার বাঁকে বাঁকে’ বইটি সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে কাজ করবে। আমি সংগ্রহ করেছি, আপনিও সংগ্রহ করতে পারেন।