শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির কাগজ ‘নতুন এক মাত্রা’

আল হাফিজ ও আযাদ আলাউদ্দীন ।।
শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম প্রধান মাধ্যম হলো সাহিত্য পত্রিকা ও লিটল ম্যাগাজিন। আমাদের জাতীয় জীবনে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। অথচ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অনেক ভালো ভালো সাহিত্য পত্রিকা ও লিটল ম্যাগাজিন আজ তাদের প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। বিজ্ঞাপন সংকট, মুদ্রণ উপকরণের উধ্বমূল্যসহ নানাবিধ সীমাবদ্ধতা এর জন্য দায়ী। এত সংকট-সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যে দু একটি পত্রিকা ও লিটল ম্যাগ এখনও আলোর মুখ দেখছে তার মধ্যে ‘নতুন এক মাত্রা’ অন্যতম। তীব্র শীতের মধ্যে ভাপাপিঠার উষ্ণতা নিয়ে মেধা ও মননে সমৃদ্ধ এবং সচেতন পাঠকদের ভালো লাগা এই প্রকাশনার জন্য ‘নতুন এক মাত্রা’র সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা।

শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির কাগজ ‘নতুন এক মাত্রা’- শীত সংখ্যা জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-২০২৩ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। কবি আবিদ আজম রচিত আকর্ষণীয় মুগ্ধতায় ভরপুর ‘এক শীতকাল’ শীর্ষক প্রচ্ছদ কবিতা দিয়ে শুরু হয়েছে ‘নতুন এক মাত্রা’র সূচিক্রম। এর পরই রয়েছে বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি বহুমাত্রিক চিন্তাশিল্পী আবদুল হাই শিকদার’র সাক্ষাৎকার। গুরুত্বপূর্ণ এই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘যদি সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে শুধু কবিতা নিয়ে থাকতাম তাহলে হয়তো আমি যেরকমভাবে চেয়েছিলাম সেরকমভাবে পারতাম। এক ধরনের অতৃপ্তি, এক ধরণের ক্ষুধা, আরও ভালো কবিতা লেখার পিপাসা থেকেই গেলো।’ হ্যাঁ, এই অতৃপ্তি এই পিপাসাই একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে এবং তার লক্ষ্যে পৌছে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বহু বর্ণিল এই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে কবির বেড়ে ওঠার গল্পসহ যাপিত জীবনের আনন্দ-বেদনার নানা অনুসঙ্গ যা সৃজনশীল সকল মানুষকে দারুণভাবে অনুপ্রাণীত করবে।

চলতি সংখ্যায় বেশ কয়েকটি তাৎপর্যমূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ রয়েছে। যেমন- আশরাফ উদ্দীন আহমদ’র ‘বিস্মৃতিপ্রায় সাহিত্যিক আবুল ফজল এবং তার গল্প’, তৈমুর খান’র ‘কবিতা লেখার শর্ত’, ইমদাদুল হক মামুন’র ‘পঞ্চাশের কবিদের কবিতায় একুশের প্রভাব’, মুসা আল হাফিজ’র ‘বাংলায় সুফিকবিতা: একটি অবলোকন’, আবু সাঈদ’র ‘মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য প্রেক্ষিত’, নবাব আবদুর রহিম’র ‘আল মাহমুদের কবিতা: জাতিসত্তার নিরিখে’ এবং বইমেলা নিয়ে ফজলে রাব্বি’র ‘একুশে ফেব্রুয়ারি ও বইমেলা’। এছাড়া শহিদুল ইসলামের ‘দর্শন ও বিজ্ঞান’, শিল্পকলা নিয়ে মোজাফফর হোসেনের ‘প্রাচীন বাংলায় পটচিত্রের ক্রমবিকাশ’, চলচ্চিত্র নিয়ে আহমদ মতিউর রহমানের ‘জহির রায়হানের ‘আনোয়ারা’ এবং পুনর্পাঠ হিসেবে আবদুল মান্নান তালিব রচিত ‘বাংলা ভাষার ঐতিহ্যিক স্বাতন্ত্র’ ইত্যাদি। এ প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো চিন্তাশীল অগ্রসর পাঠকের জ্ঞানতৃষ্ণা আরও একধাপ বাড়িয়ে দেবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি।
বিশ্বসাহিত্য নিয়ে এ সংখ্যায় গুরুত্বপূর্ণ দুটি চমৎকার আলোচনা যুক্ত হয়েছে। যথা- ইফতিখারুল আলম মাসউদের ‘মাহমুদ দারবিশ: সমকালীন আরবি কাব্যের প্রাণপুরুষ’ এবং মুহাম্মদ নুরে আলমের ‘বুকার জয়ী শ্রীলঙ্কার শেহান করুণাতিলকার উপন্যাস ‘দ্য সেভেন মুনস অব মালি আলমেদা’। এছাড়া বইপত্র বিভাগে নির্ঝর আহমেদ প্লাবনের ‘মুক্তির মোহনায় ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়: বুকের ভেতর দহন দুপুর’, তাজ ইসলামের ‘সোলায়মান আহসানের বারুদ গন্ধী সময়ের কবিতা’, আবু ইশমামের ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি করোনা প্রেক্ষিত’, আবু আফজাল সালেহের ‘সৌরভে গৌরবে ‘শৈল্পিক’, ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে আবু নোমান’র ‘বখতিয়ার খলজির বিজয় ও রাজা লক্ষ্মণ সেন’ এবং ফাহমিদ উর রহমানের ভ্রমণ বিষয়ক ‘চসারের শহরে কয়েক ঘন্টা’ ইত্যাদি বিশ্লেষণধর্মী লেখা পড়ে পাঠকমন দারুণভাবে আন্দোলিত হয়।
শিল্পী সাইফ আলির নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণে সজ্জিত এবারের সংখ্যায় ছোটগল্প ও রম্যগল্প মিলিয়ে ৭টি গল্প রয়েছে। জীবনকে ছুঁয়ে যাওয়া সুখপাঠ্য এ গল্পগুলো লিখেছেন কথাশিল্পী রফিকুর রশীদ [গোত্রান্তর], সেখ আবদুল মান্নান [মনের ভাইরাস], খাতুনে জান্নাত কণা [মুখবই], সোহেল নওরোজ [গল্পটি এভাবে শেষ করার কথা ছিল না], রোকন রেজা [একটি ছাইরঙা ছাগল ও বাইসাইকেল], ইলিয়াস বাবর [ঘুমে দেখা বেহেশতি-মানুষের মুখ] এবং মাসুম শাহরিয়ার [রম্যগল্প- জিমনেসিয়াম জিন্দাবাদ]। এছাড়া নাজিব ওয়াদুদ রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস ‘ঝুলন্ত পৃথিবী’ এবং কামরুল হাসান অনূদিত তাওফিক আল-হাকিমের নাটক ‘জ্ঞানী রাজা সুলায়মান’ ইত্যাদি গল্প, উপন্যাস ও নাটক পড়ে পাঠক কখনও হাসবেন আবার কখনও ভাববেন এবং এক পর্যায়ে জেগে ওঠে তাদের বোধ ও বিবেক। আমরা মনে করি, আনন্দদায়ক জীবনঘনিষ্ঠ এ সরস গল্পগাঁথা পড়ে বোদ্ধা পাঠক-সমালোচকের মনের জানালা আরো একটু বেশি খুলে যাবে উদারভাবে।
শীত সংখ্যা ‘নতুন এক মাত্রা’য় আরও ২০টি কবিতা ছাপা হয়েছে। কবিতাগুলো লিখেছেন কবি হাফিজ রশিদ খান [নিন্দা], কাজী গোলাম গউস সিদ্দিকী [সত্য কি বহুরূপী হতে পারে?], মুস্তফা হাবীব [মানুষের অধিকার ও মুক্তির কথন], আশরাফ আল দীন [বৃষ্টিহীন আষাঢ় শ্রাবণ], আনোয়ারুল ইসলাম [কৃষ্ণচূড়ার দিনকাল], মাঈন উদ্দিন জাহেদ [শাদাপাথরের মর্মর], সম শামসুল আলম [চঞ্চল চড়ুই ও বিষাক্ত সাপ], মাহবুবুল মাওলা রিপন [একটি বিনিদ্র রজনী], প্রদীপ কর [উপহার], অনন্ত রিয়াজ [ভুলতে কি আর পারি], সুজন আরিফ [ব্যক্তিগত জিন], সুমন সাজ্জাদ [আয়না], নজর উল ইসলাম [মনবাস], বিবিকা দেব [এক টুকরো চড়ুইভাতি], জাফর পাঠান [জীবন গহন], স্বপঞ্জয় চৌধুরী [এন্তেজাম], শাজাহান কবীর শান্ত [ভয়ঙ্কর ঈগল], অলোক আচার্য [এই শহরে আমি], জহুরুল ইসলাম [অদ্ভূত আঁধার] এবং তৌহিদ আকবর [দুঃখ]। এ কবিতাগুলো পাঠকের বোধকে শাণিত করে, জাগ্রত করে। তবে কিছু কিছু কবিতা খুব বেশি গদ্যধর্মী হয়ে গেছে বলে মনে হয়।

এ সংখ্যার বিশেষ আয়োজন ‘নতুন এক মাত্রা তরুণ লেখক পুরস্কার ২০২২’। তরুণ লেখকদের প্রনোদনা ও পৃষ্ঠপোষকতা দানের এ আয়োজন প্রশংসার দাবি রাখে। বিচারকদের বিবেচনায় ২০২২-এ সৃজনশীল শাখায় রফিকুজ্জামান রণি’র ‘চৈতি রাতের কাশফুল’ এবং মননশীল শাখায় জুম্মি নাহদিয়া’র ‘ব্যাকপ্যাকে পৃথিবী’ বিজয়ী গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বিজয়ী এই দুই তরুণ লেখককে অভিনন্দন। তবে এবার সৃজনশীল শাখায় মানসম্পন্ন কাব্যগ্রন্থ না পাওয়ায় কবিতায় কোনো পুরস্কার দেয়া হয়নি। মনে হয়, এ বিষয়টি কবিতা কেন্দ্রিক চর্চাকারীদের বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলবে। তারপরও আমরা এই শুভ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।
সবশেষে সাহিত্য সন্দেশ বিভাগে রয়েছে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক বেশ কিছু সাংগঠনিক খবরাখবর। শাহাদাৎ সরকারের গ্রন্থনায় উঠে এসেছে জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘আবদুল হাই শিকদারের কবিতা: বিশ্ববীক্ষার অপরাজেয় প্রতিভূ’ শীর্ষক গবেষণাধর্মী গ্রন্থের পাঠ উন্মোচনের আকর্ষণীয় বয়ান। আইরিন সুলতানা লিমার বর্ণনা থেকে পাঠকগণ জানতে পারেন চাঁদপুরের ‘চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার-২০২২’-এর খুঁটিনাটি নানান বিষয়। কামরুল আলমের লেখা পড়ে জানা যায় সিলেটের ‘পাপড়ি লেখক-পাঠক সম্মিলন ও করামত আলী সাহিত্য পুরস্কার প্রদান’ অনুষ্ঠানের খবর এবং আযাদ আলাউদ্দীনের বর্ণনা পড়ে অবগত হওয়া যায় ‘বরিশাল কবিতা পার্কে দুটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসব’-এর কথা।
৫০ টাকা মূল্যের ১২০ পৃষ্ঠা ডাবল ডিমাই উন্নত মানের কাগজ, ঝকঝকে ছাপা আর গেট আপ- মেক আপ ইত্যাদি মিলিয়ে মুনশিয়ানার ছাপ রয়েছে নতুন এক মাত্রা’র এ সংখ্যায়ও। পরিশীলিত সম্পাদনার নান্দনিক উপস্থাপনায় এ পত্রিকাটি ইতোমধ্যেই সচেতন পাঠক-সমালোচকদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত কবি-লেখকদের পাশাপাশি উদীয়মান নতুনদের লেখাও অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ছাপা হওয়ার ফলে আগামিতে আরও নতুন লেখক সৃষ্টি হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

প্রচ্ছদ কবিতা, সাক্ষাৎকার, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, কবিতা, গল্প, শিল্পকলা, বিশ্বসাহিত্য, ভ্রমণ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, পুনর্পাঠ, ধারাবাহিক উপন্যাস ও নাটক, অনুবাদ, বইপত্র আলোচনা, সাহিত্য- সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন সংবাদসহ নানান স্বাদের বিচিত্র বিষয় নিয়ে সাজানো হয়েছে পত্রিকাটি। শিল্পসুষমায় সমৃদ্ধ, পরিমার্জিত এবং বৈচিত্র্যময় শীত সংখ্যা ‘নতুন এক মাত্রা’র সম্পাদক ও প্রকাশকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ। ‘নতুন এক মাত্রা’র মতো আমাদেরও প্রার্থনা- সাহিত্যের মাধ্যমে উত্তরণ ঘটুক মানবিক বোধ, মনুষ্যত্ব ও বিবেকের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *