স্মরণীয়-বরণীয় কবি মল্লিক

ডা. এহসান কবির

চলছে আগস্ট মাস। বিশেষ বিশেষ কারনে এই মাসটা খুবই অর্থবহ। কারো কাছে দূ:খের মাস, কারো কাছে আবার সুখের। তবে নিঃসন্দেহে বাংলার ইসলামী সাংষ্কৃতিক আন্দোলনের কর্মীদের কাছে এ মাসটা দূ:খেরই বটে। কারণ এ মাসের আজকের এই দিনে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন এ দেশের ইসলামী সাংষ্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ত্ব, সোনালী দিগন্তের আলোকবর্তিকা, সর্বজনপ্রিয় মুখ, নিরহংকারী, আত্মপ্রচারবিমুখ, জাগরণী প্রাণপুরুষ, প্রিয় মানুষ কবি মতিউর রহমান মল্লিক।
তখন আমি ঢাকার শাহবাগে থাকতাম ডাক্তারি পেশাগত কারণে। আর ঢাকায় থাকার সুবাদে মল্লিক ভাইয়ের সোহবতে ধন্য হতাম প্রায়শ:ই। সপ্তাহে অন্তত: ১ বার তো যেতামই তার হাতে গড়া ইসলামী সংষ্কৃতির বাতিঘর “প্রত্যাশা প্রাংগনে”। যেখানে তিনি বীজ বুনেছিলেন ইসলামী সংষ্কৃতির। গড়ে তুলেছিলেন অসংখ্য কবি, সাহিত্যিক, কন্ঠশিল্পী, আবৃত্তি শিল্পী, অভিনয় শিল্পীসহ অসংখ্য কলাকুশলী ও সংগঠকদের। জমায়েত করতে পেরেছিলেন দেশের স্বনামধন্য সব সংষ্কৃতিমনা বোদ্ধা কবি সাহিত্যিক ও অন্যান্য ঝানু সাংষ্কৃতিক ব্যক্তিত্ত্বদেরকে। শুধু তাই নয় তাদের কাছ থেকে কিভাবে কাজ আদায় করে নিয়ে অনুজদেরকে শেখাতে হয় তার স্বার্থক রূপায়ন করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। সেদিক থেকে তিনি শতভাগ স্বার্থক বলা যায়। তার সেই শিক্ষার ছিটেফোটা আমার ভাগ্যেও কিছুটা জুটেছিল বটে তখন। কিন্তু আমার ডাক্তারি পেশার ব্যস্ততার কারণে আমি সেটার শতভাগ গ্রহন করতে পারিনি। এটার জন্য মল্লিক ভাইয়ের কপট অভিমানের জ্বালা সহ্য করতে হতো মাঝে মাঝে।
যাহোক, আমার সাথে মল্লিক ভাইয়ের সম্পর্কটা ছিল একটু ভিন্নরকম।
একদিন প্রত্যাশা প্রাংগনে মল্লিক ভাই ডাকলেন। গেলাম। ওনার অফিসে উনি একা বসে আছেন। সাথে আমি। নিস্তদ্ধ অফিস। সেদিন তাকে গুরু গম্ভীর উদাসীন লাগছিল বেশ। বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি হয়েছে। শুধু মনকে প্রবোধ দিচ্ছিলাম কবি-সাহিত্যিকদের মনটা নরম কাদামাটির মত। এই বৃষ্টি, এই রোদের মত। তা না হলে কি বিরাট বিরাট সাহিত্য, গীতি রচনা করা যায়? হঠাৎ বলে উঠলেন, “বুঝলে ডাক্তার! কয়েকদিন ধরে খুব পারিবারিক দুশ্চিনায় আছি।” আমি বললাম, “কি রকম?” তিনি একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বললেন, “আমি তো প্রায় আমার এসব কাজ নিয়ে পড়ে থাকি। ফ্যামিলির সদস্যদের স্বাস্থ্যের তদারকি ঠিকমত করতে পারিনা। এ নিয়ে আমাকে কথা কম শুনতে হয়না।” এই বলে মাথাটা নিচু করে কিছুক্ষন নিরব কবি। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে বাকিটুকু শোনার জন্যে। এরপর আবার শুরু করলেন, “ডাক্তার! আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেটা হলো তোমাকে আমার পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার ভার নিতে হবে। তোমাকেই আমার পারিবারিক চিকিৎসক নিযুক্ত করতে চাই”। ভাবলাম এই মানুষটাকে যদি এরূপ দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রাখা না যায় তাহলে সাংষ্কৃতিক আন্দোলনের অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। রাজী হলাম। কিন্তু এরপর যেটা ঘটলো তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি ধীর পায়ে আমার কাছে এসেই আমার শার্টের পকেটে কয়েক’শ টাকা গুজে দিয়ে বললেন, “এটা রাখো ডাক্তার।” ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মল্লিক ভাইয়ের পরিবারের চিকিৎসা বাবদ আমাকে ফি নিতে হবে? প্রতিবাদ জানালাম। কাজ হলোনা। তিনি একরোখা। খুব ঠান্ডা মাথায় বুঝালেন। বললেন, “দেখো, আমার এক শিক্ষক আমাকে একবার বলেছিলেন যে শিক্ষক ও চিকিৎসকদের সম্মানী কখনো বাকি রাখতে নেই। আমি সেই থেকেই এই প্রাক্টিসটা বজায় রেখেছি। তুমি কিছু মনে করো না ডাক্তার।” বলাবাহুল্য মল্লিক ভাই আমাকে আদর করে ডাক্তার সন্মোধন ছাড়া কখনোই স্বনামে ডাকতেন না। আমি সেদিন নিরুপায় হলেও তাকে আর কস্ট দিতে মন চাইছিলো না। এরপর বললেন,”চিকিসার ব্যাপারে সব সময় তোমার ভাবীর সাথেই যোগাযোগ রাখবে”। সাবিনা মল্লিক ভাবী তখন ইসলামী ব্যাংক, ঢাকা নিউ মার্কেট শাখায় কর্মরত ছিলেন। আমারও ব্যাংক একাউন্ট ওই ব্যাংকে। তাই নিয়মিত এ ব্যাপারে ভাবীর সাথেই কথা হতো। সেই থেকে ওনার বাসায় যাওয়া আসা। পাশাপাশি চিকিৎসা পরামর্শ চলতে থাকলো। ওনার ছেলে মুন্না তখন অনেক ছোট ছিল। আজ সে অনেক বড় হয়েছে শুনেছি। তার হয়তো এসব কথা মনেও নেই।

ডা. এহসানুল কবির, সাবেক পরিচালক, হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠী, বরিশাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *