আবু সুফিয়ান বাহার এবং ভোলার সংবাদপত্র ও সাংবাদিক

অ্যাডভোকেট নজরুল হক অনু

দ্বীপ জেলা ভোলার সাংবাদিকতা খুব বেশি দিনের নয়। আর এই সাংবাদিকতাকে একটি পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য তেমন বিশেষ কোন ব্যক্তির সন্ধানও আমরা পাই নি। বলতে গেলে এক প্রকার হাটি হাটি পা পা করে নিজের প্রচেষ্টায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, প্রশিক্ষণ, চর্চা, পৃষ্ঠপোষকতা আর লালনপালন ছাড়াই ভোলা জেলার সাংবাদিকতা এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। তারপরও এ কথা খুব সহজেই বলা যায় যে, কেউ না কেউ এগিয়ে এসেছিলেন বলেই আমরা আজকের এই অবস্থানের কথা উল্লেখ করতে পারছি। যারা ভোলার সাংবাদিকতাকে সম্বৃদ্ধ করতে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হচ্ছেন আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং প্রিয় ব্যক্তিত্ব মরহুম আবু সুফিয়ান বাহার। যদিও বাহার ভাই ছাড়া আরও অনেক গুণীজন ছিলেন বা আছেন যাদের দ্বারা আমাদের সাংবাদিকতা অঙ্গন বিকশিত হয়েছে। কিন্তু তারপরও বাহার ভাই-ই একমাত্র ব্যক্তি যার মাধ্যমে আমাদের ভোলার সাংবাদিকতা পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।
শুধু বাহার ভাই-ই নন, তাঁর গোটা পরিবারই ভোলার সাংবাদিকতা অঙ্গনের অনবদ্য অবদান রেখে গেছেন। এক্ষেত্রে কাচিয়া মিয়া বাড়ির কাছে আমাদের সাংবাদিকতা অনেকটা ঋণগ্রস্থ। কাচিয়া মিয়া বাড়ি পরিবারের সদস্য মরহুম লুৎফ রহমান মিয়াই সম্ভবত প্রথম ব্যক্তি যিনি ভোলার সন্তান হয়ে সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত হন। যদিও তিনি কখনও ভোলায় সাংবাদিকতা করেননি। কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘দি কমরেড’ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এক পর্যায়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কলম ধরতে গিয়ে কোলকাতা ছাড়া হন এবং হায়দ্রাবাদে গিয়ে রাজা নিজামের আশ্রয়ে থেকে পরবর্তী জীবন কাটান এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করে সমাহিত হন।
মরহুম লুৎফর রহমানের পরবরতী প্রজন্ম আবু সুফিয়ান বাহার ভোলার প্রথম সংবাদপত্র ‘ভোলা বাণী’ প্রকাশ করে সাংবাদিকতা জগতের পথিকৃৎ হন। ভোলার সাংবাদিকতায় নবজাগরনণ বা রেনেঁসাস এর দাবিদার বলতে বাহার ভাইকেই বোঝায়। সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী, বিশিষ্ট লেখক ও সাহিত্যিক মোশাররফ হোসেন শাজাহান এর নেতৃত্বে ভোলায় প্রথম মাসিক পত্রিকা ‘মেঘনা’ প্রকাশিত হয়। কিন্তু তাকে ভোলার প্রথম সংবাদপত্র বলা হয় না কারণ, ‘মেঘনা’ সরকার অনুমোদিত সংবাদপত্র নয় এবং ম্যাগাজিনটি নিয়মিত বের হয়নি। তাছাড়া সেটি বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি।
১৯৮০ সালে যখন ‘ভোলা বাণী’ সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয় তখন ভোলায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তৎকালীন বরিশালের জেলা প্রশাসক পত্রিকাটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দেয় এবং এই মামলায় ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হন বাহার ভাই। এরশাদ সরকারের আমলে তখন পত্রিকার ডিক্লারেশন বের করা ছিলো খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। স্বয়ং রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা ব্যাতিরেকে সংবাদপত্র বের করা যেত না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, ডিএফপি, ডিসি অফিস আর এমপি অফিসে দৌড়াদৌড়ি করতে করতেই জীবন শেষ হয়ে যেত। কিন্তু বাহার ভাই তার অদম্য মনোবল নিয়ে সেই অসাধ্য কাজটি করেছেন। ১৯৮৪ সালের ৩১ শে মার্চ ভোলা বাণীকে অনুমোদন দিয়ে সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশ করেন। অবশ্য তাকে এ বাপারে মোশাররফ হোসেন শাজাহান সার্বিকভাবে সহায়তা দিয়েছেন।
মোশাররফ হোসেন শাজাহান ছিলেন ভোলার সমাজপতি, রাজনীতির কর্ণধার। তখন তিনি ছিলেন ভোলার সমাজ নিয়ন্ত্রক। তার সান্নিধ্যে যাওয়ার জন্য ভোলার যে কেউই চেষ্টা চালাতেন। অথচ বাহার ভাই তার সান্নিধ্যে থেকেও ভোলা বাণীকে কিন্তু শাজাহান সাহেবের পকেটের সংবাদপত্রে পরিণত করেননি। দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে তিনি অনেক দূরে ছিলেন। ভোলা বাণীতে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে তিনি সকল দলকে সমান গুরুত্ব দিতেন। ছোট খাটো রাজনৈতিক দলেরও সংবাদ ছাপাতেন। কোন দলের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে গেলে তিনি তার উপযুক্ত মূল্যায়ন করতেন। ভোলা বাণী বন্ধুজন পরিষদের ছাপাখানায় ছাপা হতো। মোশাররফ হোসেন শাজাহান সাহেবের বাসায় ভোলা বাণীর অফিস ছিলো। মোশাররফ হোসেন শাজাহান ভোলা বাণীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকও ছিলেন কিছুদিন। অথচ বাহার ভাই পত্রিকাটি স্বীয় বৈশিষ্টগুণে নিরপেক্ষ রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এমনকি পত্রিকাটি যখন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম ঠিক তখন শাজাহান সাহেব পত্রিকাটি টিকিয়ে রাখার জন্য একটি তহবিল গঠন করে মালিকানার অংশিদারিত্ব নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু বাহার ভাই তাতে রাজি হলেন না একমাত্র পত্রিকাটি তার নিরপেক্ষতা হারাতে পারে এই ভয়ে। বাহার ভাই মনে করতেন সংবাদপত্র প্রকাশ করতে হলে অবশ্যই তাকে নিরপেক্ষ হতে হয়। এক পর্যায়ে ভোলা বাণী বন্ধ হয়ে গেল কিন্তু দলীয় লেজুড় বৃত্তির চেয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া শ্রেয় মনে করে তিনি ভোলা বাণী বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু ভোলা বাণীকে নিয়ে দলীয় গুণগান গাইলেন না।
এরশাদ সরকারের আমলে দোদন্ড প্রতাপশালী মন্ত্রী নাজিউর রহমান মঞ্জুও ভোলা বাণীকে দিয়ে তার দলীয় এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছিলেন কিন্তু বাহার ভাইর চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণে সফল হতে পারেননি।
বাহার ভাই ভোলা বাণীকে নিভু নিভু করে জ্বালালেন। শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারলেন না। কিন্তু কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কিংবা মহলের ক্রীড়ানকে পরিণত করেননি। শেষ পর্যন্ত বিগত আওয়ামীলীগ আমলে ভোলা বাণী অফিস দখল করে নেয়া হয়। ভোলা বাণীর প্রেস ও অন্যান্য মালিকানা ধ্বংস করে দিল। বাহার ভাই তার হাতে গড়া ‘ভোলা বাণী’ প্রতিষ্ঠানটির ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করলেন। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে একটু লিয়াজো কিংবা তাদের কাছে মাথা নত করলে হয়তোবা ভোলা বাণীর অস্তিত্ব নিঃশেষ হতো না কিন্তু তিনি তাতেও কোনো প্রকার আপোশ করলেন না।
বরিশাল অঞ্চলে এখনও সংবাদপত্র এতটা সুদৃঢ় অবস্থানে পৌঁছাতে পারে নি। আজকের বার্তা, দক্ষিণাঞ্চল বা আজকের পরিবর্তন কোনোটাই তখনো প্রকাশিত হয়নি। এমনকি ঢাকা থেকেও আজকের মত এতগুলো দৈনিক ছিলো না। হাতে গোনা চার-পাঁচটি দৈনিক তখন ভোলায় আসত। তাও প্রকাশের পরের দিন। আর আগেই বলেছি ডিক্লারেশান তখন এত সহজলভ্য ছিল না। ভোলা বাণী ছিল বহুল প্রচারিত এবং জনপ্রিয় একটি পত্রিকা। যদিও পত্রিকাটি তখনও ছিল একটি লোকসানজনক প্রজেক্ট। আর ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নিয়েও এটি প্রকাশ করা হয় নি। তবে ভোলা বাণীকে বাদ দিয়ে তখন ভোলার কথা ভাবা যেত না। চার পৃষ্ঠার লেটার প্রেসে মুদ্রিত একটি ট্যাবলয়েড যে কতটা প্রভাবশালী হতে পারে তা এই মূহুর্তে বোঝানো যাবে না। ‘ভোলা বাণী’কে বলা হতো ‘ভোলার ইত্তেফাক’। যদিও তখন ভোলা বাণী’র প্রচার সংখ্যা ছিল ভোলায় প্রচারিত ইত্তেফোকের চেয়ে কয়েকগুন বেশি- কিন্তু পরিস্থিতিটা ছিল এ রকম যে ‘ইত্তেফাক’ না দেখে তখন ভোলার মানুষ থাকতে পারতো, কিন্তু ভোলার ইত্তেফাক তথা ভোলা বাণী না দেখলে সপ্তাহের সোমবার ভোলাবাসীর কাছে দূর্বিসহ হয়ে পরত। প্রতি সোমবার ভোলা বাণী প্রকাশিত হতো। ভোলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাটে-বাজারে এর কপি পাওয়া যেত।
‘ভোলা বাণী’ এতই জনপ্রিয় ছিল যে তখনকার সময়ে আমরা যারা জাতীয় পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধি ছিলাম তখন যদি কোথাও যেতাম আর আমাদের পরিচয় দিতাম তখন জনগন তা বুঝতেন না। জনগন তখন আমাদেরকে ভোলা বাণীর সাংবাদিক হিসেবেই বুঝতেন। সাংবাদিক দেখলেই জনগন বলতেন, আপনি কি ভোলা বাণীর সাংবাদিক?
ভোলা বাণীতে তখন আমাদের কোন সংবাদ ছাপা হলে শত শত মানুষের কাছে শোনতাম আমাদের প্রকাশিত সংবাদের প্রশংসা। লোকজন দেখলেই বলতেন কাল আপনার নিউজটা দেখলাম। খুব ভালো হয়েছে। আর ভোলা বাণীতে সংবাদ প্রকাশিত হলে কর্তৃপক্ষ সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নিতেন। যে কারণে লোকজন তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি- কান্না, দুঃখ-বেদনা, সমস্যা-সম্ভাবনা, নির্যাতন-নিপীড়ণের কাহিনী তুলে ধরার জন্য দ্বারস্থ হতেন ভোলা বাণী অফিসে সম্পাদক-প্রকাশক আবু সুফিয়ান বাহার ভাইর কাছে। নির্ভয়ে- নির্দ্বিধায় উপস্থাপন করতেন শোষিত মানুষ তাদের যত কথা। এসব সংবাদ ছেপে বাহার ভাই সাধারণ লোকজনের কল্যাণ করতেন কিন্তু বিনিময়ে কারো কাছ থেকে কোন ফায়দা নিতেন না। আমার হাতে প্রমাণাদি রয়েছে যে, ভোলা বাণীতে প্রকাশিত সংবাদের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ব্যক্তি তাদের চাকুরি হারিয়েছেন, পদোন্নতি পাননি, শাস্তিমূলক বদলি হয়েছেন, অবৈধ সুবিধা ভোগ বা ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়েছেন। এসব অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা কিংবা উপঢৌকন নিয়ে বাহার ভাইর পিছু নিয়েছেন কিন্তু লাভবান হতে পারেননি। এমন বহু ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ভোলা বাণী ছাপার জন্য অর্থ না থাকার কারণে বাহার ভাই কাগজ কিনতে পারেননি। ধার নিয়ে কিংবা বাকীতে কাগজ কিনেছেন অথচ পঞ্চাশ হাজার টাকার অবৈধ অফার প্রত্যাখ্যান করেছেন। এখন বাহার ভাইর মত  আদর্শবান সাংবাদিকতার বড্ড অভাব দেখা যাচ্ছে। পত্রিকাকে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে প্রকাশ করে কেউ কেউ হয়তোবা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। কিন্তু সামাজিকভাবে লাভবান হতে পারেননি। জননন্দিত সাংবাদিক হতে পারেননি। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের কাছে একজন সৎ মানুষ হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করতে পারেননি। যেটা বাহার ভাই পেরেছেন।
ভোলা হোক কিংবা অন্য কোন জেলা হোক । নানা কারণে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নানা ধরণের সত্য-মিথ্যা অভিযোগ শোনা যায় অথচ বাহার ভাই তার কর্মকান্ডের মাধ্যমে জনমনে এমন আস্থাবান হয়েছিলেন যে, কেউ তার বিরুদ্ধে কখনো মিথ্যা অভিযোগ করেননি। বরং সকলেই একমত পোষণ করেন যে বাহার ভাই সত্যিকার অর্থেই একজন সাংবাদিক। প্রকৃত সাংবাদিকের কোন বন্ধু নেই। তিনি সকলের কাছেই সমান ছিলেন। সকলের কথাই সমান তালে তুলে ধরেছেন। ভোলা বাণীকে সংবাদপত্র হিসেবে প্রকাশ করেছেন। সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য নিয়ে পত্রিকা বের করেছেন। অস্ত্র বা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেননি। বাণিজ্যিক হাতিয়ার হিসেবেও নয়। ভোলা জেলা বিএনপি’র সহ-সভাপতি ছিলেন বাহার ভাই। অথচ ৯১ সালে বিএনপি’র ক্ষমতার আমলেও তিনি ভোলা বাণীর জন্য বাড়তি সুবিধা নেননি। আর ২০০২ বিএনপি আমলে তো ভোলা বাণী আর বেরই করলেন না। কারণ সোজা আঙ্গুলে ভোলা বাণী বের হবে না। ক্ষমতা দেখিয়ে অসৎভাবে ভোলা বাণী কে বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারেও ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। ব্যক্তি জীবনে তিনি ভোলা বাণীর সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন। জেলা বিএনপি’র সহ-সভাপতি কিংবা অন্য কোন পরিচয় বরাবরই তাকে বিব্রত করতো।
আমাদের সকলের প্রিয় বাহার ভাই এই ভোলা বাণীকে বের করতে গিয়ে আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলেন। পত্রিকাটির লোকসান গুণতে গুণতে তিনি তার পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভাবির সম্পত্তিও বিক্রি করে দিয়েছেন। শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তি বন্ধক রেখে বিসিকের ঋণ নিয়ে ভোলা বাণী প্রেস করেছেন। সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে মৃত্যুর সামান্য ক’দিন পূর্বে সেই ঋণ শোধ করেছেন।
ভোলা জেলা বিএনপি’র সাবেক সহ-সভাপতি মোঃ মোস্তফা কামাল ছিলেন ভোলা বাণীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। এছাড়া প্রথম আলো’র সাবেক জেলা প্রতিনিধি প্রতিনিধি ফরিদ হোসেন বাবুল, দৈনিক সংগ্রামের সহকারী সম্পাদক আমীর খসরু, দৈনিক আজকের ভোলা সম্পাদক মোহাম্মদ শওকাত হোসেন, আশরাফুল হক মাসুম সহ ভোলার প্রথম সারির সাংবাদিকরা আশির দশকে বা ভোলা বাণী প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে জড়িত ছিলেন। তাদের ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে ভোলা বাণী সমৃদ্ধ হয়েছিল। বিশিষ্ট লেখক, অনুবাদক ‘পলি মাটির দেশ ভোলার’র রচিয়তা মোস্তফা হারুণও ছিলেন ভোলা বাণীর একজন। আমি ব্যক্তিগতভাবে বাহার ভাইর নিকট আত্মীয়। আমার চাচাত ভাই ছিলেন তিনি। তার মত সাংবাদিকের সান্নিধ্যে থেকে অমি গর্বিত। আমি আরো গর্বিত যে আমাদের কাচিয়া মিয়া বাড়ি পরিবার থেকে আমরা ছয়জন সাংবাদিক বের হয়েছি। প্রথমজন ‘দি কমরেড’ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক মোঃ লুৎফর রহমান। যিনি অষ্টাদশ শতাব্দীতে ছিলেন। দ্বিতীয়জন বাহার ভাইর সান্নিধ্য ধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। আমরা পরবর্তীতে আজকের কাগজ প্রতিনিধি সাজ্জাদুর রহমান সামুন, যুব বার্তার নির্বাহী সম্পাদক ও ঢাকা ক্রিড়া লেখক সমিতির সদস্য স্পোর্টস রিপোর্টার রাকিবুর রহমান, যুব বার্তার কর্ণধার সাংবাদিক নিয়াজুর রহমান সহ একই বাড়ির আমরা যে ছয় ব্যক্তি সাংবাদিকতায় জড়িত হয়েছি তার পেছনে আবু সুফিয়ান বাহার ভাইর অসামান্য অবদান রয়েছে।
শুধু পারিবারিকভাবে যে আমরা সাংবাদিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়েছি তা নয়। ৮০’র দশকে আমরা একটা গ্রুপ ছিলাম যারা একই সাথে ভোলা সরকারি স্কুল এবং পরবর্তীতে ভোলা সরকারি কলেজে লেখাপড়া করেছি। তাদের মধ্যে আমরা অনেকেই ভোলা জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিক হিসেবে সফলতার সাথে আছি। তাদের প্রত্যেকেই বাহার ভাইর কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। দৈনিক খবরপত্রের সাবেক সম্পাদক, বর্তমানে  খবরের অন্তরালে’র সম্পাদক নাসির আল মামুন, আমি, মিজানুর রহমান ( সাবেক স্টাফ রিপোর্টার জনকন্ঠ), জাকির হোসেন মহিন (বর্তমানে নির্বাহী পরিচালক গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থা ও সাবেক ইনকিলাব ভোলা প্রতিনিধি), হাবিবুর রহমান ছুট্টি (বর্তমানে আমেরিকায় কর্মরত), মোকাম্মেল হক মিলন (সাবেক বার্তা সম্পাদক, দৈনিক বাংলার কন্ঠ) মিলে আমরা একসঙ্গে ভোলা বাণীতে কাজ করেছি। ভালো যা কিছু শিখেছি বাহার ভাইর কাছ থেকেই শিখেছি। পরবর্তীতে আহাদ চৌধুরী তুহিন, সাজাদুর রহমান সামুন, নুর নবী মনা, আমিরুল ইসলাম বাছেতসহ আরো একটি ব্যাচ বাহার ভাইর স্নেহ-ভালোবাসায় সম্বৃদ্ধ হয়েছে। সাংবাদিকতায় উজ্জল ভূমিকা রেখেছে।  ইনকিলাব প্রতিনিধি এম.এ বারী নান্নু ভোলা বাণীর প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপক থেকে অণুপ্রাণিত হয়ে বর্তমানে সার্বক্ষণিক সাংবাদিকতায় জড়িত হয়েছেন। এছাড়া ভোলার বিভিন্ন উপজেলার অসংখ্য সাংবাদিক রয়েছেন যাদের হাতেখড়ি বাহার ভাইর হাত ধরে। তখন উপজেলা পর্যায়ে কোন জাতীয় আঞ্চলিক পত্রিকার প্রতিনিধি ছিল না। শুধুমাত্র ভোলা বাণী বা বাহার ভাইর কারণে গ্রামবাসী সাংবাদিক দেখতে পেয়েছে। ভোলা বাণীর পাতায় তাদের এলাকার সংবাদ দেখতে পেয়েছে। সংবাদ ছাপা হলে যে দুর্নীতি-অনিয়ম দূর হয় তা জানতে পেরেছে উদাহরণ হিসেবে। ভোলার সাংবাদিকতাকে কয়েকটি অংশে ভাগ করলে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হয় ‘ভোলা বাণী’ যুগ। আর ভোলা বাণী যুগ চালু হবার পর থেকেই ভোলার সাংবাদিকতা মূলত বিকশিত হয়। জাতীয় পত্রিকার প্রায় সকল সাংবাদিকের আড্ডা বলেন আর মিলনমেলাই বলেন সবই ছিলো ভোলা বাণী অফিসে। এই আড্ডায় জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারাও অংশ নিতেন। সাংবাদিকদের নানা সমস্যা চায়ের টেবিলে বসেই সমাধান হয়ে যেত। ভোলা বাণী যুগে এমন অনেক সাংবাদিককে দেখেছি যিনি একজন ভালো সাংবাদিক হয়েও পরিচিতি পাননি। তার পরিচয়ের প্রসার ব্যাপ্ত করার জন্য তিনি ভোলা বাণী অফিসে এসে বসতেন। তৎকালীন সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার অনুন্নতার কারণে জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিকরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবর পেতেন না। তখন ভোলা বাণীর সংবাদ কেটে জাতীয় দৈনিকে পাঠাতেন। ভোলা বাণী এবং ভোলার সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতাকে সম্বৃদ্ধ করার জন্য আবু সুফিয়ান বাহার ভাই আমরণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তিনি বিআরডিতে চাকুরী করতেন, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, ঠিকাদারী করতেন কিন্তু সাংবাদিকতা করতে তিনি তার সবই ছেড়ে দিলেন। সংবাদপত্র ছাড়া অন্য কিছুর সঙ্গে আর ঘনিষ্ট কোন সম্পর্ক রাখলেন না। তাঁর কর্মকান্ডের মাধ্যমে ভোলা, ভোলার সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতা ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছিল। কিন্তু বিনিময়ে তিনি কিছু পাননি। সহকর্মিদের লাঞ্চনা, রাজণীতিকদের বঞ্চনা আর হতাশা নিয়ে নিয়ে তিনি ২০০৫ সালের মে মাসের ২৬ তারিখ আমাদের কাছ থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলেন। বিদায় নেবার পূর্বে ভোলা প্রেসক্লাবের সদস্য হতে চেয়েছিলেন কিন্তু জাতীয় দৈনিকের স্থানীয় প্রতিনিধি না হবার কারণে প্রেসক্লাব তাকে সদস্য পদ দিল না। তবে দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতা এবং ভোলা বাণী প্রকাশ ও ভোলার সাংবাদিকতা বিকাশের ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরুপ তাকে সম্মাননা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য প্রেসক্লাব ক্রেস্ট বানিয়ে আনে। মৃত্যুর আগে তিনি ক্রেস্টটি দেখে যান কিন্তু আনুষ্ঠানিভাবে গ্রহণ করতে পারেননি।
মানুষ আসে মানুষ যায় । বাঁচা-মরার দৃশ্য চলতেই থাকে। বাহার ভাই সেই ধারা অনুযায়ী আমাদের কাছ থেকে চিরবিদায় নিলেন। কিন্তু মৃত্যুর পর শোকসভায় বক্তারা তার যে গুণগান করেছেন, তার প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করেছেন- সেটা সবার ভাগ্যে জোটে না। আমি বিশ্বাস করি বাহার ভাই তার কর্মময় জীবনে যে অবদান রেখেছেন, মৃত্যু আর জনগণের ভালোবাসার মধ্য দিয়েই তার যথার্থ মূল্যায়ন তিনি লাভ করেছেন। এর বেশি কিছু আর চাওয়ার থাকতে পারে না একজন সৎ সাংবাদিকের।

তথ্যসূত্র: আনন্দ লিখন, জুন ২০০৫

অ্যাডভোকেট নজরুল হক অনু,

ভোলা জেলা প্রতিনিধি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন।

One comment

Leave a Reply to Anjamul Alam Munier Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *