মেঘের আড়ালে সূর্য হাসে

মোঃ জসিম জনি
আমরা খুব শিগগিরই নতুন স্বপ্ন দেখবো। এ আঁধার কেটে যাবে। নতুন ভোর হবে আবার, নতুন সূর্য দেখা দেবে। পৃথিবীতে করোনার ভয়ংকর থাবা মূছে যাবে। আবার আমরা প্রাণে প্রাণ মিলাবো। রঙিন পৃথিবী ঘুরে দাঁড়াবে। স্বস্থির নিঃশ্বাস নিবো আমরা। টিভিতে একটি মোবাইল নেট কোম্পানীর বিজ্ঞাপন দেখে মনে অনেক আশা জেগেছে। ‘সব সম্ভব হবে, সব ঠিক হয়ে যাবে’ দুটি কথার এই বিজ্ঞাপন আমাদের শুভ দিনের ইঙ্গিত দেয়। হয়তো বেশিদিন আর নয়, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আবার আমরা মাথা তুলে দাঁড়াবো।
আমরা প্রকৃতির সাথে অনেক অন্যায় করেছি। যার ফল আমরা ভোগ করছি। সেই শৈশব থেকেই অপার বিস্ময়ে প্রকৃতিকে দেখতাম আর ভাবতাম কত বৈচিত্রময় প্রকৃতির গল্প, ছবিগুলো। কতই না বিচিত্র রঙিন প্রকৃতি। ইদানিং প্রকৃতি নতুন রূপে হাজির হয়েছে পৃথিবীর সামনে। এতদিনকার বিশ্বায়নের অকল্যাণে ধুঁকে ধুঁকে নিঃশ্বাস নিতে থাকা বায়ুম-ল আজ আবারও দূষণ মুক্ত হতে শুরু করেছে। হিমালয়ের চূড়া নাকি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সমুদ্রের জলরাশি আবার গাঢ় নীল রঙ ধারণ করতে শুরু করছে, আকাশে মেঘেদের দলও আরও শ্বেতশুভ্র হয়ে উঠছে, অভয়ারণ্যে বন্য পশু-পাখি-প্রাণীরও অবাধ বিচরণ শুরু হয়েছে, প্রকৃতি আবার যেন প্রাণ চাঞ্চল্য খুঁজে পেয়েছে নতুন করে। এর কারণ শুধুমাত্র একটি ক্ষুদ্র ভাইরাস।
পৃথিবীকে সুস্থ করতে এখন এই মুহূর্তে সামগ্রিকভাবে সমবেত চেষ্টার বিকল্প নেই। আমরা কেউই একা বাঁচতে পারি না, পারব না। আমি সুস্থ থাকলেই আমার চারপাশটা সুস্থ-সুন্দর থাকবে। এই যে মানবতার মায়ায় ভালোবাসার জাল ছড়াতে শুরু করেছে তাতে মনে হয় না করোনা আর বেশিদিন বিরক্ত করবে পৃথিবীকে। খুব শীঘ্রই হয়ত অন্যসব ভাইরাসের প্রতিষেধকের মতো এরও প্রতিষেধক তৈরি হবে। করোনা নামের ভাইরাস হারিয়ে যাবে পৃথিবীর মানবজাতির আতঙ্কের ইতিহাস থেকে। তবে মহাকালের পাতায়, শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলায় হয়তো করোনার পায়ের গভীর দাগ থেকে যাবে। আমি বিশ্বাস করতে চাই, করোনা মনুষ্যজাতির চেতনায় যে পরিবর্তনটা এনে দিয়ে গেছে, সেটা সমুজ্জ্বল অটুট থাক। পৃথিবী মানবতার মায়ায় আবারও সুন্দর হোক।
হয়তো লকডাউনের এই পৃথিবীতে আপাতত আমরা কেউই ভালো নেই। আগামী দিনের আর্থ-সামাজিক মন্দাভাবের ভয়াবহতার আশঙ্কায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছি। তবুও একটা আশার আলো বুকে রেখে নতুন ভোরকে স্বাগত জানাতে চাই আগামীর পৃথিবীতে।
মেঘের আড়ালে সূর্য হাসে। করোনার এই আঁধার কেটে সুদিন আসবেই। সেদিনের অপেক্ষায় হলেও অন্তত ঘরে থাকি সবাই। নিরাপদ হোক আগামীর দিনগুলো- এই স্বপ্নটাই কিলবিল করছে চোখের পাতায়। প্রকৃতি আবার হাসবে। আমরাও একসঙ্গে হাসব। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেবো খোলা আকাশের নিচে।
যুগে যুগে অনেক রকমের মহামারি এসেছে বিশ্বে। এসব মহামারি কখনো বেশিদিন, আবার কখনও কিছুদিন থেকেই চলে যায়। এ গল্প একদিন, একবছর বা একদশকের নয়। মানব সভ্যতার শুরু থেকেই মহামারির উপস্থিতি দেখা গেছে। কখনো কলেরা আবার কখনো বা প্লেগ নামে আমরা মহামারিকে চিহ্নিত করেছি। তবে যে নামেই মহামারি পরিচিতি পেয়েছে না কেনো প্রতিবারই কেড়ে নিয়েছে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ।
ইতিহাসে মহামারির কালো ছোঁয়া লেগেছে অনেকবার। এর কোনো কোনোটা সম্পর্কে আমরা হয়তো জানি আবার কোনোটা এখন কালের বিবর্তনে হারিয়েও গেছে। মহামারির কারণে বহু নগর সভ্যতা হারিয়েছে, অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। মা হারিয়েছে সন্তান, বোন হারিয়েছে ভাই। তবে একবিংশ শতাব্দীতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মহামারি হিসেবে দেখা হচ্ছে করোনা ভাইরাসকে। এ শতাব্দীতে সার্স, মার্স, ডেঙ্গু, জিকা, ইবোলার মতো প্রাণঘাতী রোগের কথা জেনেছে বিশ্ব। কিন্তু সব কিছুকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে চীনের করোনাভাইরাস। এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বের অন্তত দুই কোটি মানুষ। মৃত্যু ৭ লাখ ছাড়িয়েছে। মৃতের মিছিলে প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম। হারিয়ে যাচ্ছে সম্ভাবনা, স্বপ্ন!
একবিংশ শতাব্দীর নতুন প্রজন্ম আমরা। মহামারির গল্প শুধু ছবি, গল্প, কাব্য ও রূপকথায় শুনেছি। আমরা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখিনি। দেখিনি মুক্তিযুদ্ধও। শুধু পূর্ববর্তী প্রজন্মের বাবা, দাদুর কাছে যুদ্ধের শাণিত চেতনার গল্প শুনেছি আর বারবার শিহরিত হয়েছি এক গৌরবমাখা অনুভবে। যুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দাভাবে নতুন সামাজিক প্রেক্ষাপটে বেঁচে থাকার যুদ্ধের গল্পের আঁচও কিছুটা পেয়েছি বিভিন্ন শিল্প, সাহিত্যের চিত্রে।

কিন্তু এবারই প্রথম আমাদের প্রজন্ম মহামারিকে দেখল, অনুভব করল অদ্ভুত এক রহস্যময় যুদ্ধকে। এ যুদ্ধ এক অদ্ভুত অদেখা রহস্যময় শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে। বিজ্ঞানীরা এই শত্রুর নাম দিয়েছেন কোভিড-১৯ বা নভেল করোনাভাইরাস। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে এর উৎপত্তি। কি অসীম ক্ষমতায় করোনা এক তুড়িতে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে ভয় দেখিয়ে ঘরবন্দি করল সমগ্র পৃথিবীকে! পৃথিবীর মানুষ নতুন কিছু শব্দকে দৈনন্দিন জীবনের অভিধানে যুক্ত করল- কোয়ারেনটাইন, লকডাউন, সোশ্যাল ডিসস্ট্যান্সিং। জীবনকে আঁকড়ে বেঁচে থাকার কত কায়দা কানুনও রপ্ত করলাম। পরিচ্ছন্নতা, নিয়মমাফিক জীবনযাপন, পারিবারিক মূল্যবোধের গুরুত্ব- অনেক কিছুই শেখালো ‘করোনা’।
করোনার আক্রমণে, আতঙ্কে পুরো বিশ্ব হয়তো কাঁপছে। অনেক মানুষের জীবননাশের কারণও হয়েছে এই জীবাণু। তবে এই ভাইরাস মনুষ্যজাতিকে অনেক শিক্ষা দিয়েছে। মৃত্যু আতঙ্কের কাছে দেশ, জাত, শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ, অর্থ, বিত্ত সব যে ঠুনকো- করোনা দেখিয়ে দিল।

মোঃ জসিম জনি
সাংবাদিক- দৈনিক যুগান্তর
সাধারণ সম্পাদক- লালমোহন প্রেসক্লাব।

One comment

Leave a Reply to রাফিন Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *