রিপোর্টারের ডায়েরি: চোখের জলে ভেজা ঈদ

আযাদ আলাউদ্দীন

২৭ নভেম্বর ২০০৯। পরদিন পবিত্র ঈদুল আজহা। পত্রিকায় কাজ করার সময় ঈদের জন্য তিনদিন ছুটি পেলেও দিগন্ত টেলিভিশনে যোগ দেয়ার পর সংকুচিত হয়ে আসে ছুটির ব্যাপারটি। ঈদের আগেরদিন বার্তাবিভাগের কাছে ছুটি চাইলাম গ্রামের বাড়িতে পরিবারের সবার সাথে ঈদ করার জন্য। অফিস থেকে বলা হলো- ‘বরিশালে ঈদের জামায়াতের কোন ফুটেজ-নিউজ মিস হবেনা’ এই শর্ত সাপেক্ষে শুধুমাত্র ঈদের দিনের জন্য ছুটি দেয়া হলো। যাই হোক ঈদের আগের দিন ক্যামেরাম্যান জসিম ভাইকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বিকেলে বরিশাল থেকে ভোলায় গ্রামের বাড়িতে রওনা দিলাম। লঞ্চে-বাসে যাত্রীদের সেকি ভীড় ! বসার মত কোন জায়গা পেলাম না। দু’ঘন্টা ঠায় দাড়িয়ে থেকে সন্ধ্যায় কুঞ্জেরহাট গ্রামের বাড়ি ‘পদ্মামনসা’য় পৌছলাম। আমার দৃষ্টিতে- ঈদে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার সবচেয়ে বড় আনন্দ হলো পরিবারের কিংবা গ্রামের পুরনো বন্ধুবান্ধব সবাইকে একসাথে ঈদের মাঠে পাওয়া যায়। যাই হোক- বাড়ি যাওয়ার পর পরিবারের সবার সাথে কুশল বিনিময় হলো। জার্নি করার কারনে শরীরটা বেশ ক্লান্ত। ঈদ সংখ্যা একটি ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লাম।

রাত ১২ টার দিকে লালমোহনের সাংবাদিক আরশাদ উল্যাহ মামুনের ফোন- ‘বস’ আমনে কি বাড়ি আইছেন? হ্যাঁ- সূচক জবাব দিতেই মামুন বললো- এইমাত্র খবর পাইলাম নাজিরপুরের তেতুলিয়া নদীতে কোকো-০৪ লঞ্চ ডুবছে, আমরা সেখানে যাচ্ছি। আপনার মোবাইল ফোন খোলা রাইখেন- আমি সেখানে পৌঁছে আপনাকে বিস্তারিত জানাবো।
সাধের ঘুম শেষ ! নিউজ সংগ্রহের জন্য শুরু হলো পেরেশানি। ফোন দিলাম আমাদের ভোলা জেলা প্রতিনিধি ইউনুছ শরীফকে। তিনি তখনো বিষয়টি জানেন না। তাকে জানানোর পর ফোন দিলাম ঢাকা অফিসে। বার্তাসম্পাদক মাসুম বিল্লাহ ভাই বললেন- আমাদের সহকারি বার্তাসম্পাদক মাসুম মাহবুব ঈদের ছুটিতে ভোলায় আছেন। তারসাথে সমন্বয় করে নিউজ পাঠান। ক্যামেরা নিয়ে ঘটনাস্থলে আসতে বলি ইউনুছ শরীফ কে। প্রচন্ড শীত আর কুয়াশা উপেক্ষা করে রাতেই তিনি ঘটনাস্থলে এসে পৌছান ।
রাত ১ টায় দিগন্ত টেলিভিশনে শুরু হলো কোকো-৪ ট্রাজেডির ব্রেকিং নিউজ। ঘন্টায় ঘন্টায় ফোনো লাইভ, কিংবা আপডেট তথ্য সরবরাহ করতে থাকি আমরা।
ভিডিও ফুটেজ পাঠাতে গিয়ে দেখা দেয় নানা বিপত্তি। সিটিসেল জুম ঠিকভাবে কাজ করছেনা। ল্যাপটপ নিয়ে নদীর পাড়ে গাছতলায় বসে বারবার চেষ্টা চালাচ্ছেন মাসুম মাহবুব। ভিডিও ক্লিপ অর্ধাংশ গিয়ে আবার বেক করে ডিসকানেক্ট হয়ে যাচ্ছে। সে এক অশ্বস্তিকর অবস্থা। অবশেষে ভোলা প্রতিনিধি ইউনুছ শরীফকে ক্যামেরাসহ ঘটনাস্থলে রেখে আমি আর মাসুম ভাই ল্যাপটপ নিয়ে চলে গেলাম লালমোহন শহরে। দেখলাম- সেখানে বেশ ভালোই নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে । মুহুর্তের মধ্যেই সব ফুটেজ পাঠিয়ে দিলাম আমাদের এফ.টি.পি সার্ভারে। এভাবেই চলতে থাকলো আমাদের পেশাগত কাজ।
ঈদের দিন। সময় যতই যাচ্ছে ততই বাড়ছে লাশের সংখ্যা। তেুলিয়া নদীর তীরে তৈরী হলো বিষাদময় এক শোকার্ত পরিবেশ। স্বজনহারাদের বুকফাটা আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠলো নাজিরপুরের বাতাস। এমন মুহুর্তে নিজেকে স্থীর রেখে কাজ করাটা বেশ কঠিন হলেও আবেগ সংবরণ করে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে আমাদের ।
উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা বরিশাল থেকে ঘটনাস্থলে এসে পৌছতে একদিনেরও বেশি সময় লেগে যায়। ততক্ষণে আমাদের চ্যানেলের ঢাকা অফিস থেকে পাঠানো হয় ক্যামেরাম্যান তানভীর আহমেদকে। রাতে অবস্থান করার জন্য লালমোহন ডাকবাংলোয় একটি রুম ভাড়া নেই আমরা। ঘটনার একদিন পর উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা এসে অর্ধ ডুবন্ত কোকো-৪ লঞ্চটি কোনরকম নাড়া দিতেই একের পর এক বেরিয়ে আসে ভেতরে আটকে থাকা লাশ আর লাশ। এসব লাশ চিহ্নিত হওয়া মাত্রই স্বজনদের গগনবিদারি সেকি আর্তনাদ! কোন পাষাণ হৃদয়ও সেই মুহুর্তে আবেগ সংবরন করতে পারেনা। সেইসব দৃশ্য ক্যামেরার ফ্রেমে ধারন করছেন তানভীর। লক্ষ করলাম- তার চোখ ক্যামেরার মনিটরে হলেও অঝোর ধারায় সে চোখে বইছে কান্নার নোনা জল। এভাবেই শোকাবহ পরিবেশে চলতে থাকলো আমাদের পেশাগত কাজ। ল্যাপটপ নিয়ে আমি উঠে বসলাম উদ্ধারকারী জাহাজ হামজায়। সেখানে বসে তানভীরের তোলা ছবি গুলো দিগন্ত টেলিভিশনের হেড অফিসে পাঠাতে থাকি। ঢাকা থেকে আসা অন্যান্য টিভি চ্যানেলের অনেক সাংবাদিকের ল্যাপটপ ও মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় দুপুরের পর থেকে অনেকেই বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। তবে কৌশল প্রয়োগ করায় আমাদেরকে এরূপ কোন বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি। তাছাড়া ইন্টারনেটে প্রেরণের পাশাপাশি আমাদের র- (টাটকা) ফুটেজের ক্যাসেটও সবার আগে ঢাকা স্টেশনে পৌছেছে। এটা কিভাবে সম্ভব হয়েছে তা কৌশলগত কারনেই এখানে বলছিনা। এভাবেই প্রতিঘন্টার খবরের সাথে চলেছে আমাদের ফোনো লাইভ, সেসময় চালানো হয় সব আপডেট ফুটেজ।

কোকো-০৪ লঞ্চ উদ্ধারের চেষ্টায় উদ্ধারকারী জাহাজ হামযা ও রুস্তম (বামে) উৎসুক জনতার ভীড় (ডানে)।

ঈদের দিন একটানা কঠোর ডিউটি শেষে ক্লান্ত হয়ে পড়েন মাসুম মাহবুব। এরই মধ্যে সন্ধ্যায় ভোলা শহরের বাসা থেকে তার শিশুকণ্যার ফোন- বাবা আজ ঈদের দিন, তুমি কোথায়? সকাল থেকে তোমাকে দেখিনা কেন ? একদিকে পেশাগত দায়িত্ব অন্যদিকে শিশু কণ্যার এরূপ আবেগী ফোন ! কি করবেন তিনি। তার মানসিক অবস্থা দেখে বললাম- মাসুম আপনি বাসায় চলে যান, আমি আর ক্যামেরামান তানভীর সব বিষয় দেখছি। মাসুম ভাই ভোলায় চলে গেলেন।
আমরা সারাদিনের আপডেট নিউজ শেষে সন্ধ্যায় ফলোআপ প্যাকেজ তৈরী করে পাঠাই। যথারীতি প্রচারও হয় সব। সারাদিন কাজের চাপে খাওয়া-দাওয়ার কথাও ভুলে গিয়েছিলাম আমরা। সন্ধ্যার দিকে ভোলা প্রতিনিধি ইউনুছ শরীফকে ঘটনাস্থলে রেখে আমরা লালমোহন ডাকবাংলোয় ফিরি। গোসল-খাওয়া শেষ না হতেই ইউনুছ শরীফের ফোন- ‘লঞ্চ থেকে উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের মালামাল লুটপাট চলছে, এই লুটপাটের মালামাল নিয়ে আবার আওয়ামী লীগের দু’গ্রুফের মধ্যে সংঘর্ষ’। মনে মনে ভাবলাম এরকম একটা শোকার্ত এলাকায় লুটপাট চালাতে ওদের বিবেকে একটুও বাধলোনা ! যাই হোক আবার ছুটে গেলাম নদীর তীরে, ফুটেজ পাওয়া গেল, নিউজও হলো। কিন্ত আমাদের শরীর তো আর সাপোর্ট করতে চাইছেনা। তবে কি আর করা- কাজ তো চালিয়ে যেতেই হবে। এভাবে এক ড্রেসে তানভীর আর আমি কাজ করলাম টানা তিনদিন। আমাদের ঠিকানা হয়ে ওঠে লালমোহন ডাকবাংলো আর তেতুলিয়া নদীর পাড়। লঞ্চের ভেতর থেকে বের করে আনা এক একটি লাশ হয়ে ওঠে বেদনা বিধূর সব সাইড স্টোরি। দুঃসহ সেসব স্মৃতির কথা বলে এই লেখার পরিধি বাড়াতে চাইনা।
ঈদের তিনদিন পর রাত ১০টায় ডাক বাংলোয় ফিরে গোসল করে ফ্রেস হওয়ার পর তানভীর বললেন- আযাদ ভাই, এবারের ঈদতো কোরবানী ঈদ তাইনা ? আমি বললাম হ্যাঁ, কি হয়েছে বলেন- তিনি বললেন রুটি গোশত খেয়েছেন? তখন মনে পড়লো, না-তো আমরা কেউই এবারের ঈদে রুটি গোশত কিছইু খাইনি। রাত ১১টায় বললাম চলেন- লালমোহন বাজারের দিকে যাই, যেহেতু এক কাপড়ে এসেছি তখন কিছু জামাকাপড়ও কিনব আর কোন হোটেলে পেলে রুটি গোশত খেয়ে নেব। লালমোহন বাজারে গিয়ে জামাকাপড় সবই পাওয়া গেল । তবে কোন হোটেলেই রুটি গরুর গোশত পাওয়া গেলনা । উপরন্তু ভোলার আঞ্চলিক ভাষায় এক হোটেল বয়ের এরূপ টিচ শোনা গেল ‘এইতেরা কইত্তে আইছে, ঈদেস্ সময় বেকের (সবার) বাইত (বাড়ি) রুডি গোশত বানায়, আর এইতেরা আইছে হোডেলে রুডি গোশত খাইতো, হেও আবার ঈদের তিনদিন পর’। যাই হোক হতাশ হয়ে ডাকবাংলোয় ফিরতে হলো আমাদের।

রাতে লালমোহন ডাকবাংলোয় ফিরে দেখি নিউজ সংগ্রহের জন্য বরিশাল থেকে লালমোহন এসেছেন ইত্তেফাকের তৎকালীন ব্যুরো চিফ লিটন বাশার। ডাকাংলোয় আমাদের পাশের রুমেই উঠেছেন তিনি। কুশল বিনিময়ের পর লিটন বাশার ভাই বললেন আজাদ তোমার ক্যামেরাম্যানকে নিয়ে রুমে আসো। গিয়ে দেখি তার জন্য ঈদের রুটি গোশত নিয়ে এসেছেন লালমোহনের সাংবাদিক এসবি মিলন। লিটন ভাই তার কমন ডায়লগ ‘একা খেলে পেট ভরে, সবাই খেলে সম্পর্ক বাড়ে’ বলতে বলতে আমাদের সামনে সামনে এগিয়ে ধরলেন রুটি গোশতের বাটি আর প্লেট। কুরবানী ঈদের তিনদিন পরে সবাই মিলে খেলাম সেই রুটি গোশত।

রাতে বাড়ি থেকে মায়ের ফোন- ‘কয়মাস পর বাড়ি আসলি ঈদ করতে, ছুটিতে এসেও এত ডিউটি করা লাগে? ঢাকার যে মেহমান এসেছে তাকে নিয়ে বাড়ি আসো। তানভীর কে আমার মায়ের দেয়া প্রস্তাবটি শোনাতেই তিনি বললেন- যেতে তো মন চায়, কিন্তু এই মুহুর্তে স্টেশন লিভ করা ঠিক হবে না, বরং আপনি যান। কিন্তু তানভীরকে একা লালমোহন ডাকবাংলোয় রেখে আমি বাড়ি যাই কি করে ? এজন্য গ্রামের বাড়ি থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দুরত্বের লালমোহনে থাকলেও টানা ৫ দিনের একদিনও বাড়ি যাওয়া হয়নি আমার ।
এদিকে দীর্ঘ পরিশ্রম শেষে রাতে যখন আমরা চিফ নিউজ এডিটর রাশেদ ভাইকে সারাদিনের কাজের একটা বিবরণ কিংবা সারসংক্ষেপ জানাতাম তখন তিনি আমাদের কাজে বেশ প্রেরণা যোগাতেন, পরদিন কি করতে হবে সে সম্পর্কে নির্দেশনা দিতেন। আমরা সব কষ্ট ভুলে সকালে নব উদ্যোমে কাজে নেমে পড়তাম। এভাবে কেটেছে টানা সাতদিন। এরপর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসে সবকিছু। কিন্তু মাঝেমধ্যে এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে স্বজন হারাদের কান্নার সেইসব হৃদয় বিদারক করুন দৃশ্য। ##

কোকো-০৪ দুর্ঘটনায় উদ্ধার হওয়া লাশের সারি একাংশ (বামে), স্বজনহারাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে আমরা।

 

আযাদ আলাউদ্দীন, সাবেক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক, বরিশাল প্রেসক্লাব।

২ comments

  1. সেই ঘটনা হৃদয় বিদারক। স্বজনহারাদের আর্তচিৎকার। সাংবাদিকের দায়বদ্ধতা। মাতৃভূমির প্রতি মমতা। সব মিলেমিশে একাকার।
    লিটন বাশার আজ প্রয়াত।

    আমাদের হৃদয় ছুঁয়েগেছ।

  2. কনকনে শীতের রাত ২৭ নভেম্বর ২০০৯, লালমোহন নাজিরপুরে লঞ্চডুবিতে আমাদের সহকর্মী জনাব মোঃ মোশারেফ ভাইও মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
    ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। তিনি সহ ওই লঞ্চডুবিতে নিহত সকলকে আল্লাহ্ জান্নাতের বাসিন্দা রাখুন, আমিন!

Leave a Reply to আবদুল্লাহ্ আব্বাস Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *