শুভংকরের ফাঁকিতে সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ সমূহে কারিগরি শিক্ষার বেহাল দশা

আযাদ আলাউদ্দীন ।।

স্বার্থান্বেষি আমলা চক্রের খপ্পরে পড়ে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ সমূহে কারিগরি শিক্ষা এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট আমলারা ‘কাজির গরু কিতাবে আছে গোয়ালে নেই’ কায়দায় সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে নিজেদেও পদোন্নতির ফায়দা হাসিল করে যাচ্ছেন। সিলেবাস, জনবল, অবকাঠামো এবং বেতন-ভাতা সহ সার্বিক বিষয়ের চিত্র পর্যালোচনা করলে পরিস্কারভাবে বোঝা যায় যে বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষা গভীর ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়েছে। নিম্নে কিছু তথ্যচিত্র তুলে ধরা হলো-

অযৌক্তিক সিলেবাস
কারিগরি শিক্ষা একটি বিশেষায়িত শিক্ষা। এটাকে সাধারণ শিক্ষার মাপকাঠিতে বিচার করে সমমানের চিন্তা করলে চলবে না। কিন্তু সমমান দেয়ার নামে এখানে তা-ই করা হয়েছে। নবম-দশম শ্রেণিতে ১৭টি বইয়ের ১৫টিই জেনারেল বই (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, পদার্থ, রসায়ন, ব্যাকরণ, গ্রামার, রচনা ইত্যাদি)। মাত্র ২টি বই কারিগরি শিক্ষা সংক্রান্ত। ১৪০০ নম্বরের পরীক্ষায় ১০০০ নম্বরই জেনারেল বিষয়ের আর মাত্র ৪০০ নম্বর টেকনিক্যাল বিষয়ের উপর হয়ে থাকে। আবার কারিগরি বইয়ে ৪০% প্রাকটিক্যালও নেই, সবই থিওরিতে ভরা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিরও একই দশা। ছাত্র-ছাত্রীরা ইংরেজি, গণিত, পদার্থ, রসায়ন, ব্যাকরণ, গ্রামার এসব বিষয়ে কী করে পাশ করবে সেই ভাবনায় ভীত হয়ে পড়ে। পাশ-ফেলের হিসেব নিকেশে টেকনিক্যাল সাবজেক্ট তাদের নিকট এখন গৌণ বিষয়।
সমমান দেয়ার নামে কারিগরি শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে জেনারেল বিষয়ের বইয়ের এক বিশাল বোঝা চাপিয়ে দিয়ে অদৃশ্য কোন ইশারায় কৌশলে তাদেরকে অদক্ষ করে গড়ে তোলার নীল নকশা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাস্তবতার দাবি তো এটাই ছিল যে একান্ত প্রয়োজনীয় কিছু সাধারণ শিক্ষার বিষয় রেখে, কারিগরি বিষয়ের প্রাধান্য বজায় রেখে সিলেবাস প্রণয়ন করা। এভাবে এখানে কারিগরি শিক্ষার সাইনবোর্ডের আড়ালে কারিগরি শিক্ষাকে ধ্বংসের মহাষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সরকারের দক্ষ জনশক্তি তৈরির সুস্বপ্নকে এভাবেই দলিত-মথিত করা হচ্ছে।

জনবলের করুন হাল
অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী শিক্ষকের সংখ্যা যা থাকা দরকার আছে মাত্র তার তিনভাগের একভাগ। বাস্তবতা তুলে ধরার জন্য কেবলমাত্র বরিশাল বিভাগের টিএসসি সমূহের চিত্র তুলে ধরাহলো।

বরিশাল বিভাগের টি এস সি সমূহ শিক্ষকের পদ সংখ্যা কর্মরত শতকরা (ট্রেড) সংখ্যা
১ম শিফট ২য় শিফট মোট
সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ, বরিশাল ৫৬ ৪২ ৯৮ ২৪ জন ২৪%
সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ, পটুয়াখালী ৩২ ৪০ ৭২ ১০ জন ৭%
সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ, পিরোজপুর ২৯ ৪২ ৭১ ১১ জন ৭%
সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ, ভোলা ৩১ ৪২ ৭৩ ১২ জন ৭%
সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ, বরগুনা ৩১ ৪২ ৭৩ ০৯ জন ৬.৫%
সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ, ঝালকাঠি ৩০ ৪২ ৭২ ১০ জন ৭%

উপরোক্ত ছক তথ্য থেকে শিক্ষক স্বল্পতার ভয়াবহতা স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগের কোন উদ্যোগ নেই।

২য় শিফটের ভাতা নিয়ে ষড়যন্ত্র
আগে প্রথমম শিফটের জনবল দিয়ে ২য় শিফটের ক্লাস নেওয়া হতো এবং তাদেরকে মূল বেতনের ৫০% ভাতা প্রদান করা হতো। পরে তা অজ্ঞাত কারণে কমিয়ে ১১% এ নামিয়ে আনা হলো। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ড অথরিটি বললেন ৫০% ভাতা দেয়া আইনে নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বরিশাল টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে কর্মরত একজন শিক্ষক ক্ষোভের সাথে জানালেন, এক শিফটের বেতন দিয়ে দুই শিফটের ক্লাস করানোর কথা কোন আইনে আছে? তারপরে ভাতা একেবারেই বন্ধ করে দেয়া হলো। তারপর যা করা হলো তা আরো কঠিন ও নিষ্ঠুরতার ন্যাক্কার জনক দৃষ্টান্ত। তা হলো, বর্তমান কর্মরত এই গুটি কয়েক শিক্ষক ম-লিকে দুই শিফটে ভাগ করে আদেশ জারি করা হলো। ২য় শিফটের ক্লাস নেওয়ার বিনিময়ে কোন ভাতা না দেয়ার হীন উদ্দ্যেশে কর্তৃপক্ষ এই কাজ করেছে। আবার অধ্যক্ষগণকে আদেশ দিয়েছেন ক্লাস ম্যানেজ করতে। ফলে অধ্যক্ষগণ শিফট বিভাজনের তোয়াক্কা না করে কর্তৃপক্ষের ভয়ে দুই শিফটের ক্লাস নিতে শিক্ষকদেরকে বাধ্য করছেন। দ্বিতীয় শিফটের বকেয়া দেড় বছরের ভাতা নাকি আর দেয়া হবে না!

যেসব কারণে ক্লাস হচ্ছেনা টিএসসিগুলোতে

ক) অনেক ট্রেড ফাঁকা
মাত্র ১০%- ২০% শিক্ষক উভয় শিফটে ভাগ করে দেয়ার ফলে কোন ট্রেডে ২/৩ জন আবার কোন ট্রেডে একজন মাত্র টেকনিক্যাল টিচার রয়েছেন। আবার কোন ট্রেড একেবারেই ফাঁকা। আর ননটেক বিভাগে কোন কোন বিষয়ের ২/১ জন শিক্ষক আছেন, আবার কোন কোন বিষয়ের শিক্ষকই নেই। তাহলে দু’একজন শিক্ষকের পক্ষে নবম, দশম, একাদশ, দ্বাদশের এতোগুলো থিওরি ও প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস ম্যানেজ করা কি সম্ভব?

খ) অবকাঠামো না বাড়িয়ে নতুন ভর্তি
বর্তমানে যতগুলো ফ্যাকাল্টি ও যত সংখ্যক ছাত্রছাত্রী রয়েছে তারই স্থান সঙ্কুলান হয়না। তার উপর কোন পরিকল্পনা ছাড়াই ২০২২ শিক্ষাবর্ষে ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম শ্রেণিতেও ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হয়েছে প্রতি শ্রেণিতে ৬০ জন করে। শুধু তাই নয় এবছর বিএম (বিজনেস ম্যানেজমেন্ট) শাখা খুলে একাদশে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হয়েছে। মুলত এসব করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। অথচ এইসব নতুন ক্লাসের জন্য কোন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি। এমনকি এদের জন্য কোন পার্ট টাইম শিক্ষকও নিয়োগ করা হয়নি। আগের ক্লাসগুলো ম্যানেজ করতেই শিক্ষকদের লেজে গোবরে অবস্থা। আর এইসব নতুন ফ্যাকাল্টি যুক্ত করায় বাস্তব অবস্থা কী হচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়।

গ) অবকাঠামো নির্মাণের আগেই কাজ শুরু
নতুন ১০০ টিএসসি চালু করণ প্রকল্পের ৩৫টি ২০২১ সালে চালু করা হয়েছে। এবার চালু করা হয়েছে ৩৫টি। এই ৩৫টির একটিরও অবকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন হয়নি। ঠিকাদারের ছাপড়ার মধ্যে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষদের কাজ চলে। ছাত্রছাত্রীরা বসে গাছ তলায়। এসব প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান টিএসসিগুলো থেকে শিক্ষকদেরকে ডেপুটেশনে পাঠানো হয়েছে। ফলে উপরের ছকে বিদ্যমান শিক্ষকদের যে সংখ্যা দেখানো হয়েছে তা আরো কমে গেছে। নেই বইখাতা, নেই চেয়ার টেবিল। এতো তাড়াহুড়া করে এই ৩৫টি টিএসসি এ বছর চালু না করে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে ২০২৩ সালে চালু করাই ছিলো উত্তম।

ঘ) সামঞ্জস্যহীন প্রশিক্ষণ
বর্তমানে কারিগরি সেক্টরে চলছে ট্রেনিংয়ের বন্যা। ঢাকা ও বগুড়ায় একযোগে চলছে ট্রেনিং। বাস্তব অবস্থা বিবেচনা না করেই শিক্ষকদেরকে পাঠানো হয় ট্রেনিং করতে। ১৫ দিন/২৫ দিনের এই ট্রেনিংয়ের সময় কোন কোন ডিপার্টমেন্ট থাকে একেবারেই শিক্ষক শুণ্য, ননটেকের কোন কোন বিষয় থাকে একেবারে ফাঁকা। এরই মধ্যে চলছে বিদেশে ট্রেনিংয়ের প্রস্তুতি। বিদেশি ঋণের টাকা সাবাড় করাই এর আসল উদ্দেশ্য। আগেও এমন সব ট্রেনিং দেশে বিদেশে করানো হয়েছে যা প্রয়োগ করার কোন ঊপকরণ বা পরিবেশ শ্রেণিকক্ষে নেই। ফলে চর্চার অভাবে ট্রেনিংয়ের সকল দক্ষতা শিক্ষকগণ অল্প দিনের মধ্যেই সব ভুলে গিয়ে সাবেক অবস্থায় ফিরে যান।

ঙ) পদোন্নতি বঞ্চিত চাকুরি জীবন
টিএসসি হলো একটা ভূতুড়ে গর্ত। এখানে যারা একবার ঢোকে অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে সকলকে একই পদে চাকুরি করে অবসর যেতে হয়। পদোন্নতি বঞ্চিত জীবনে সঠিক দায়িত্ব পালনের মানসিকতা কতটুকু থাকে? জানালেন কর্মরত একজন শিক্ষক।

৫) অস্থিতিশীল আমলা চক্র
সচিব, মহাপরিচালক, পরিচালক এসব ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদেরকে ছ’মাস/ ন’মাসের জন্য দায়িত্বে রাখা হয়। ফলে তারা তাড়াহুড়া করে কিছু অবাস্তব চমক দেখিয়ে নিজেদের পদোন্নতির ভাবনাটাই বেশি ভাবেন। বহু সমস্যার জটপাকানো ফাইলগুলো ধরেও দেখেননা, রেখে দেন পরবর্তী আগন্তুকের জন্য।

৬) চাকুরি বঞ্চনা
টিআরএ সহ কয়েকটি পদে লোক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে জেনারেল শিক্ষিতদেরকে, যারা কোন টুলস এর নামও জানেন না। অথচ এইচএইসসি (ভোক) পাশ করে বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের ছাত্ররা। এতে কারিগরি শিক্ষার প্রতি নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছে জনগণ। মাঠ পর্যায়ে জরিপ না করেই আমলারা এসব আত্মঘাতি কাজ করে যাচ্ছেন।
আছেন কি কোন কা-ারি যিনি আমলা চক্রের থাবা থেকে সরকারের সুস্বপ্নের এই কারিগরি শিক্ষাকে রক্ষা করে তার সঠিক ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে সাহসী পদক্ষেপে এগিয়ে আসবেন?

আযাদ আলাউদ্দীন বরিশাল ব্যুরো চিফ, দৈনিক নয়া দিগন্ত। 

০১৭১২১৮৯৩৩৮

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *