মুক্তবুলি আমার কাছে সন্তানের মতো

আযাদ আলাউদ্দীন ।।

প্রমথ চৌধুরী বলেছেন ‘সাহিত্য মানুষের মনের মধ্যে আপন ভূবন তৈরি করে’ ঠিক যেন তাই। আমি তার এই কথাটির সাথে পুরোপুরি একমত। আমার লেখালেখি ও পত্রিকা সম্পাদনার কারণ জানতে হলে যেতে হবে পুরনো স্মৃতিতে। সেই স্মৃতিচারণের মাধ্যমে পাঠক হয়তো আমার সাহিত্য চর্চা, লেখালেখি কিংবা পত্রিকা সম্পাদনার কারণ কিছুটা আঁচ করতে পারবেন।

আমি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, তখন প্রত্যন্ত গ্রামে থাকলেও ঢাকা থেকে প্রকাশিত অনেক পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিনের গ্রাহক ছিলো আমাদের পরিবার। আমি তখন গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়তাম সেসব পত্রিকা ও ম্যাগাজিন। সেই থেকে মনের মধ্যে সাহিত্যের নানা ভাবনা কাজ করতে থাকে। কোন এক সময় আমার হাতে আসে কবি আল মাহমুদের আত্মজীবনীমূলক স্মৃতিকথা ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’। বইটির প্রথম ৩০ থেকে ৩৫ পৃষ্ঠা ছিলো কবি আল মাহমুদের চৌদ্দ পুরুষের ইতিহাস। সেই অংশটি পড়তে আমার কাছে তেমন ভালো লাগেনি। এরপর থেকে তাঁর শিশুকালের স্মৃতিগুলো যখন উপন্যাসের মতো প্রাঞ্জল ভাষায় ধারাবাহিকভাবে সেই বইয়ে পড়ছিলাম, যেন লেখার অনেক কিছুই আমার নিজের জীবনের সাথে মিলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল আমিই তখন সেই লেখার নায়ক। আমার শৈশবকালে পড়া ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ বই-ই মূলত আমাকে সাহিত্যের জগতে টেনে এনেছে।

তখন থেকেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম- সাহিত্য বিষয়ক পড়শোনাতেই গড়বো আমার অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার। যেই ভাবনা সেই কাজ। শুরু হলো আমার সাহিত্য চর্চা। ইন্টারমেডিয়েট পাশ করে অনার্সে ভর্তি হওয়ার পালা। তখন ভর্তি পরীক্ষার আবেদনে তিনটি সাবজেক্টের চয়েজ লিখতে হতো। আমি আমার আবেদনপত্রে তিনটি চয়েজেই লিখেছিলাম বাংলা বিভাগ, বাংলা বিভাগ এবং বাংলা বিভাগ। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করার পর আমাকে ডাকা হলো ভাইভা বোর্ডে। আবেদন ফরম দেখে স্যাররা অবাক! তাঁরা আমাকে পরীক্ষা করার জন্য বললেন– বাংলা বিভাগে কোন আসন খালি নেই। তুমি অন্য যে কোন সাবজেক্টে পড়তে পারো। আমি স্যারদের বিনয়ের সাথে জানিয়ে দিলাম- বাংলা সাবজেক্ট না পেলে আমি অনার্স-ই পড়বোনা। অবশেষে আমাকে বাংলা সাবজেক্ট দেয়া হলো।

শুরু হলো আমার সাহিত্য চর্চা। আমি কিন্তু পরীক্ষা পাশের জন্য বাংলায় অনার্স-মাস্টার্স করিনি। আমার সহপাঠী বন্ধুরা যখন পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের নেশায় বুদ হয়ে নোট, গাইড এবং স্যারদের বাসায় প্রাইভেট পড়ায় ব্যস্ত সময় পার করতো- আমি তখন- সাহিত্যের রস আস্বাদনে ব্যস্ত। সিলেবাসের পাঠ্য ও রেফারেন্স সব বই-ই আমি পড়েছি, তবে তা পরীক্ষা পাশের উদ্দেশ্যে নয়। উদ্যেশ্য ছিলো প্রমথ চৌধুরীর ভাষায় ‘মনের মধ্যে আপন ভূবন তৈরি করা’। আমি যেহেতু সিলেবাসের মূল বই এবং রেফারেন্স বইগুলো পড়েছি সেকারণে আমার পরীক্ষার রেজাল্টও কোন অংশে খারাপ হয়নি, বরং সাহিত্যের রস আস্বাদন করেছি পুরোপুরি।

ক্লাসের বাইরে অনেকেই যখন সেমিনার কক্ষে আড্ডা কিংবা ডেটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকতো- তখন আমার ঠিকানা ছিলো কলেজ লাইব্রেরি অথবা পাবলিক লাইব্রেরি। সাহিত্যের বই থেকে শুরু করে পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন, সাহিত্য পাতা, ফিচারপাতা কিছুই বাদ যেতনা আমার পড়ার বিষয় থেকে। পত্রিকার ফিচারগুলো পড়ার সময় মনে হতো- ইচ্ছে করলে আমিও তো এমন ফিচার লিখতে পারি। সেই ভাবনা থেকে বাসায় এসে লেখা শুরু করলাম। লেখা লিখে দু’টাকার খামে ভরে পাঠিয়ে দিতাম পত্রিকাগুলোর ফিচার বিভাগে। বিশেষ করে দৈনিক ইনকিলাব ও যুগান্তরে ছাপা হতো সেসব ফিচার। অনেক ফিচার ছাপা হতো বরিশালের বিভিন্ন স্থানীয় পত্রিকায়। এভাবেই লেখালেখি ও সাংবাদিকতার জগতে আমার প্রবেশ।

বাংলায় অনার্স পড়ার সময় বরিশালের বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডায় যোগ দিতাম। বিশেষ করে শেকড় সাহিত্য সংসদের সাপ্তাহিক আড্ডাগুলো ছিল বেশ জমজমাট, স্বরচিত লেখা পাঠ ও লেখার আলোচনা-সমালোচনা থেকে জানা হতো অনেক কিছু। সেইসব সাহিত্য আড্ডা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার সম্পাদনায় বের করি সাহিত্য পত্রিকা বা লিটল ম্যাগ ‘উৎস’। ২০০০ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে উৎস’র ছয়টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এই সাহিত্য পত্রিকাটি প্রকাশ করতে গিয়ে অনেক কবি সাহিত্যিকের সাথে পরিচয় গড়ে উঠে।

২০০৪ সাল থেকে পেশাদার সাংবাদিকতায় যুক্ত হওয়ার পর সাহিত্য চর্চায় কিছুটা ভাটা পড়ে, যেহেতু রক্তকণা ও শিরায় শিরায় বইছে সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি আবেগ ও ভালোবাসা, তা কি পেশাদার সাংবাদিকতায় আটকে রাখতে পারে? সে কারণে ২০১৮ সাল থেকে নিয়মিত প্রকাশ করছি সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘মুক্তবুলি’। ইতোমধ্যে এই ম্যাগাজিনের ২১টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তবুলি ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখছেন শতাধিক কবি-সাহিত্যিক ও লেখক। বরিশাল নগরী থেকে একসময় অনেক সাহিত্য পত্রিকা ও ম্যাগাজিন প্রকাশিত হলেও বর্তমানে নিয়মিত প্রকাশিত একমাত্র ম্যাগাজিন ‘মুক্তবুলি’। মুক্তবুলি ম্যাগাজিন এবং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আমরা সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি মানুষকে নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সাহিত্য সংস্কৃতির বিষয়ে সচেতন করার প্রচেষ্টা করছি।

একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ অনেক কষ্টসাধ্য কাজ। সাহিত্যের প্রতি নিরেট ভালোবাসা না থাকলে- এই ধরনের পরিশ্রমের কাজ অনেকেই করতে আগ্রহী হন না। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বারবার তাগাদা দিয়ে লেখা সংগ্রহ করা, নবীন লেখকদের লেখা সম্পাদনা করতে গিয়ে বিরক্তিকর অবস্থা তৈরি হওয়া, অনেক সিনিয়র লেখক এখনো হাতে লিখেন- তাদের কারো কারো লেখার পাঠউদ্ধার করতে গিয়ে ত্রাহি অবস্থা তৈরি হওয়া, অনেকের ডেস্কটপ কম্পিউটার বা ল্যাপলট না থাকায় মোবাইলের অব্রো কিংবা ইউনিকোড ফন্টে লিখে ম্যাসেঞ্জারে লেখা পাঠানো, সেইসব লেখা কনভার্ট করতে গিয়ে অক্ষর ভেঙে একাকার হয়ে যাওয়া, সকল লেখা সম্পাদনা করা, লেখার সাথে সংশ্লিষ্ট ছবি কিংবা ইলাস্ট্রেশন তৈরি করে নান্দনিকভাবে পত্রিকার গেটআপ-মেকআপ ফুটিয়ে তোলা, বারবার লেখার প্রুপ দেখা, হেডলাইন নিয়ে রিসার্চ করা, বিজ্ঞাপনগুলোর ডিজাইন ঠিক আছে কিনা? সাহিত্য পত্রিকার সাথে খাপখায়না এমন কোন বিজ্ঞাপন যাচ্ছে কিনা? এমনি নানারকম ঝক্কিঝামেলা সহ্য করে পত্রিকা প্রেসে পাঠানো, প্রেসে সেটিং করে প্লেট তৈরির সময় ফর্মা এবং কালার ঠিক আছে কিনা? ছাপার পরে ম্যাট-স্পট, লেমিনেশন, ফয়েল প্রিন্টসহ বাঁধাই নিখুঁত হচ্ছে তো? এমন অনেক ঝামেলা পেরিয়ে যখন ছাপানো পত্রিকাটি সম্পাদকের হাতে আসে তখন কেমন লাগে?

আমার কাছে এই অনুভূতি ঠিক সন্তান জম্মদানের মতো! একজন মা যখন সন্তান গর্ভে ধারণ এবং অনেক কষ্টের প্রসব বেদনা আর জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে সন্তান জন্ম দেন, এরপর নিজ সন্তানের মুখ দেখেন- তখন সেই মায়ের অনুভূতি যেমন! একজন পত্রিকা সম্পাদকের কাছেও ছাপা পত্রিকা হাতে পাওয়ার অনুভূতি ঠিক তেমন। অন্তত আমার নিজের কাছে মনে হয় তা-ই। এজন্যই আমি বলি আমার সম্পাদনায় বরিশাল থেকে প্রকাশিত ‘মুক্তবুলি ম্যাগাজিন’ আমার কাছে নিজ সন্তানের মতো। আমি এই সন্তানকে সবসময় নিজের বুকে আগলে রাখার চেষ্টা করি।

যদিও এই সময়ে যান্ত্রিক জীবনের সাথে মিশে থাকা ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউবের এই ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে- মানুষকে বই ও সাহিত্য চর্চার দিকে ফেরানোর কাজটি অনেক কঠিন ও চ্যালেঞ্জের, তবুও আমরা আশাবাদী। জয় হবে সাহিত্যের, জয় হবে মানবিকতার। ##

তথ্যসূত্র : নব ভাবনা (সাহিত্য পত্রিকা) আড্ডা সংখ্যা।

৪ comments

    1. আলহামদুলিল্লাহ,, চমৎকার ভাবে অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য ।
      আমার খুব পছন্দের একজন মানুষ আজাদ আলাউদ্দিন ভাই, ভাই এর জন্য শুভকামনা ❤️

Leave a Reply to রিয়াজুল ইসলাম বাচ্চু Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *