ক্ষুধা কী ভাইরাস চিনে

শাহীন কামাল ।।

লকডাউন সেই যাচ্ছি যাচ্ছি করেও

আসন পেতেছে ময়ুর সিংহাসনে

উজির নাজিরের পাকাপোক্ত মসনদে
রোজ নিত্য ফরমান,
ভ্যারিয়েন্টের ভয়ে দিগভ্রান্ত।
হাভাতে শ্রমিকরা কাজে গেছে-
হ্যামিলনের বাঁশিতে যে এখন
ভাতের গন্ধ আসে,
পাখা গজালো পীপিলিকা
বাঁচতে ছুটে –
ক্ষুধা কী ভাইরাস চিনে, বল?
পোয়াতি বউটার মুখে খাবার দিতে
পুলিশের লাঠিপেটা খায় ছমিরুদ্দিন-
রিকশার প্যাডেলে ঘোরে
ছয়জনের সংসার।
স্বপ্নেবিভোর যুবকের চোখে
গোরের অন্ধকার,
পিতার চোখে অনিশ্চয়তার
কালো পঙতি পড়ে বুকফাটা আর্তনাদে,
আগামীর আলোয় পথ চলে।
তিনশত তেত্রিশে ফোন করে
খাবার আনে তিনবেলা উপোস করা মধ্যবিত্ত,
বাড়ির কাজের লোককে বিদায় করেছে
মাস ছয়েক আগে।
অদৃশ্যের কাছে হাত পেতে
আঁধারে আলো খুঁজতে খুঁজতে
নির্মল সকাল দেখে।

মায়ের জন্য 

শাহীন কামাল 

মায়ের হাতের পিঠা পায়েস, চিড়া মুড়ি খই

কালের জলে ভেসে যাওয়া, দিনগুলো আজ কই?

বায়নাগুলো কায়দা করে, তার কাছে রাখি,
চাওয়া সকল পাওয়া হতে, থাকে কী আর বাকি!
.
মায়ের থেকে প্রথম সবক, জগৎ জানার রথ,
অন্ধকারে কেমন করে, খুঁজতে হবে পথ।
.
রাগের মাঝে সোহাগ বাঁজে, স্বর্গ সমান হাসি,
এক জীবনে হয়নি বলা, মা- তোমায় ভালোবাসি।
.
মধুমাখা মুখখানি তার, শাসন ভরা চোখ,
আঁধার রাতে মিলায় তাতে, নিত্য জাগায় শোক।
.
এক সকালের হঠাৎ ঝড়ে, আমার সকল শেষ।
বুকের মাঝে ঝেঁকে আছে, শুন্য রেখার রেশ।
.
আমার জীবন পূর্ণ মাগো, তোমার আশির্বাদে।
কেন এত দ্রুত গেলে. কীসের অপরাধে?
.
তোমার ঘরে তুমি ছাড়া, আমি অচিন পাখি,
সেই কথাটি কেউ জানেনা, নিজেই ঢেকে রাখি।
.
আসছি আমি তোমার পথে, তোমার পাশের ঘরে,
সেদিন না হয় রাখবে আমায়, খুবই আপন করে।
.
কামাল হোসেন শাহীন 
নাজিউর রহমান কলেজ, ভোলা
০১৭১৬৯৮১১৪৮

বসন্তের সেকাল- একাল

শাহীন কামাল 

বসন্ত এসে গেছে…, বাসন্তী শাড়ি পড়ে.., আহা আজি এ বসন্তে…. শুনতে শুনতে শীতের বিদায় শেষে প্রকৃতি ভিন্ন দৃশ্যপট কল্পিত আমাদের অন্তরে। বসন্ত নিয়ে গান, কবিতা, গল্পের অন্ত নেই আমাদের শিল্প সংস্কৃতিতে। সাম্প্রতিককালে উৎসবপ্রিয় বাঙালির কাছে নবরূপে সজ্জিত হয়ে ধরা দিয়েছে বসন্ত। বাসন্তী রঙ থেকে লাল, নীল, কমলা, খয়ের- সব রঙের ছোঁয়া লাগে বসন্তের ভোরে। ক্যালেন্ডারের পাতা পরিবর্তনের এই ঋতু আলোচনায় যতটুকু আছে, বাস্তবতায় প্রকৃতিতে পরিবর্তন প্রায় অদৃশ্য। শীতের তীব্রতা কমে প্রকৃতিতে প্রশান্তি আসে সত্য, কিন্তু চৈত্রের কাঠফাটা রোদে চৌচির মাঠঘাট আর জনজীবনে দুর্ভোগ পরবর্তীতে কালবৈশাখীকে আমন্ত্রণ জানায় বসন্ত। আম্রমঞ্জরির শুভ্রতা ছাড়া দৃশ্যতঃ ফুলের বাগানে কোন সৌন্দর্য আসেনা। জাতীয় ফুল শাপলার সম্ভার বসে বর্ষায়। গোলাপের পাপড়ি অন্য ঋতুতে আরও বেশি সুরভি ছড়ায়।

তবুও বসন্ত দিনে দিনে তার আপন সুরভি ছড়িয়ে দিচ্ছে নানা মাধ্যমে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বসন্ত আজ  সকল ঋতুর মাঝে স্বীয় মর্যাদার আসনে আসীন। সকলে ভালোবেসে ঋতুরাজ বলে ডাকে। আনিসুল হক বলেছেন, বাঙালি জীবনে বসন্তের কোনো ভূমিকা থাকার কোনো কারণ নেই, বাঙালিকে বসন্ত চিনিয়েছেন দেশ-বিদেশের কবি-সাহিত্যিকেরা।

ছোটবেলায় বসন্তকে স্বাগত জানানোর কথা মনে না থাকলেও বসন্ত তাড়ানোর কথা বেশ মনে আছে। নানাবিধ অনুষ্ঠান মালায় বসন্তবরন যেমন ছিল না, তেমনি এ নিয়ে বাড়তি আবেগ উচ্ছাস কবিতা- গল্পের বাইরে গিয়ে সামাজিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। সেই সময় দেখতাম- কাঁধে ঝোলা নিয়ে এক আগন্তুক এসে বাড়ির দরজায় নানাবিধ উপদেশ দিতেন। বাড়ির মহিলাদের উদ্দেশ্য করে কত শত উপদেশের মধ্যে থাকত      ‘আয়, আয় বলিয়া ডাকিবেন না, ঘরের আশপাশ পরিষ্কার রাখিবেন, রান্না করতে গিয়ে তেলের বাগাড় যেন না দেয়’  ইত্যাদি, ইত্যাদি। লেকচার শেষে সুরে সুরে মন্ত্র পড়ে যেভাবে যা, যা বলে ধমক দিতেন, বেটা বসন্তের পালানো ছাড়া বিকল্প থাকত না!! পাটের দড়িতে মন্ত্র পড়ে ফু দিয়ে কিছু একটা বানিয়ে কখনও হাতে কখনও ঘরের কোণে ঝুলিয়ে দিতেন। এরপর রসুনে ফু দিয়া ঘরে ঘরে টাঙিয়ে দিয়ে তার কেরামতি সাঙ্গ করতেন। বিনিময়ে ঝোলাতে চাল, ডাল, টাকাকড়ি নিয়া মন্ত্র পড়তে পড়তে বিদায় নিতেন সেই সাধক। চুলে জট লাগানো শর্ট পাঞ্জাবি পরা হাতে বিশেষ ধরনের লাঠি হাতে ফকিরের মন্ত্র পড়তে পড়তে চলে যাওয়া সেই দৃশ্য যেনো আজও দেখি স্মৃতি হাতড়ে। গ্রামে গঞ্জে বসন্ত লাগলে যখন অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হতো, তখন নাকি এই লোক সারারাত গ্রামের এ পাশ থেকে ঐ পাশ কিছু একটা তাড়ানোর মতো মন্ত্র পড়ে দৌড়াতেন।

শীতের তীব্রতা কমে বসন্তের মৃদু বাতাস বইতে থাকলে দু ধরনের ডাক্তার আসতেন বাড়িতে। প্রথমজন আসার আগে দু’খানা নতুন লুঙ্গি কিনে আনা হতো। এই উপহার দেখেই বুঝতে বাকী থাকতো না, কি হতে যাচ্ছে। লুঙ্গি উপহার পাওয়া জন পালানোর কত কৌশল করতো! শেষে কিনা কোরবানীর গরুর মতো কেউ একজন দাঁত কেলাতে কেলাতে চ্যাংদোলা করে ডাক্তারের সামনে এনে বিশেষ ভঙ্গিতে বসাতো। ডাক্তার সাহেব পন্ডিত মশাইয়ের মতো নানা প্রশ্নের বাহানা করে, মাঝেমাঝে কাউকে কশে থাপ্পড় দিতেন। মনোযোগ যখন থাপ্পড়ের দিকে, তখনই বাঁশের চেড়া দিয়ে ডাক্তারী কাজ সম্পন্ন করে চুলার পোড়া মাটি দিয়া রক্ত বন্ধ করতেন। পরবর্তী কয়েকদিন বিশেষ ভঙ্গিতে হাটার দৃশ্য ভেবে হাসি পায়। নতুন লুঙি, গামছা ও কিছু টাকা নিয়ে চেইন ছেড়া ব্যাগ হাতে ডাক্তার সাহেবের চলে যাওয়া দেখে ইচ্ছা করতো একটা শিক্ষা দিয়ে দেই!

গরু দাগাইবেনননন…….. বলে চিৎকার দেয়া ডাক্তারও এই সময়ে আসতেন। গরুগুলোকে শোয়াইয়া লোহা পুড়ে শিং ও দাঁতে ছেক দিয়ে দিতেন। নানা ধরনের মন্ত্র পড়তেন। আজও মনে আছে,  উত্তরের বিলে যাবি, লম্বা লম্বা ঘাস খাবি…. ইত্যাদি। মান্দার গাছে তখন ফুল ফুটতো। ফুলগুলো হাতে নিলে মোরগ মনে হইতো। মাঝেমধ্যে হাতে ঘষলে লাল রঙ ধারণ করতো। তুলা গাছে ভুত থাকার ভয়ের পরেও ফুল হাতে নিতে তুলা গাছের নিচে গিয়ে ফুল হাতে খেলা করতো কেউ কেউ।

বাতাসের দিক পরিবর্তন আর  সকাল থেকে যেভাবে গরম অনুভূত হচ্ছে তাতে শীতের বিদায়ে বসন্তর আগমন নিশ্চিত প্রমান করে। ফুল গাছে গাছে না দেখলেও হাটে মাঠে শোভা পাবে। ফেইবুকের ওয়াল ভরে যায় ফুলে ফুলে।  একজন বললেন, ‘আজ কোকিলের ডাক শুনেছেন?  বললাম,  বহুদিন আমি কাকের ডাকও শুনিনা।

 

শাহীন কামাল 

ইংরেজি প্রভাষক

নাজিউর রহমান কলেজ, ভোলা

 

ফেরারি জীবন 

শাহীন কামাল 

।।

পিতৃপুরুষের ভিটেমাটিতে কাকপক্ষীর আবাস

রাতের নির্জনে শেয়াল কানামাছি খেলে

পেঁচার ডাকে সন্ধ্যা নামে

গা ছমছম ওপথে পা পরেনা এখন আর।

জন্মঘর কালে কালে-

বুনো ঝোপের আড়ালে

স্মৃতিচিহ্ন ধুলোয় মিলেমিশে একাকার।

পিতামহ গত হয়েছেন বহুকাল আগে

কবরে তার যত্রতত্র পরে থাকে ঝরাপাতা।

সবুজের নীল কষ্ট সময়ে শুকিয়ে রঙ বদলায়

হলুদাভ সোনালি পাতা মাটিতে মিলায়-

শুকনো পাতার মতো ঠিকানাহীন জীবন

শুন্য থেকে শুরু করে মাটিতে সাকিন।

আত্মোন্নতির পথে চলতে গিয়ে

রেখে আসি পদচিহ্ন

নতুনের অবগাহনে স্বপ্নে বিভোর ডালপালায়

সবুজ পাতা গজায়-

আবার বিবর্ণতায় ঢাকে মন-প্রকৃতি

কষ্ট উপচে পড়ে সময়ের পৃষ্ঠে,

নতুন পথে হাটি, নতুনভাবে।

কবরের নামফলকের কালো অক্ষর মুছে যাওয়া

দেখা হয়ে উঠেনা

সময় দেয়ার সময় কোথায়?

পরিচয় আবছা আলোয় অদৃশ্য হয়

যেমনটি হয়েছে পূর্বপুরুষেরা-

জায়গাজমি, বংশতালিকা ব্যতিরেকে

কোথায় আর টিকে আছে তারা!

গভীর মমতায় ভিটেমাটি জড়িয়ে রাখা হাত-

নিজ হাতে সঁপে দিয়েছি কবরে।

কল্যাণকামী প্রার্থনারত হাতের ছোঁয়ায়

সকাল হয়না এখন

মাটির শয্যায় মমতাময়ীর দেহ ঘুমায় বছর বছর।

পরিযায়ী পাখির মতো ছুটে চলে দেহ

নির্বিঘ্নে জীবন কাটাবো বলে কত আয়োজন!

সুতাসমেত ঘুড়ি হয়ে উড়ে মন

অতীত ভুলে বর্তমানে বাঁচি নির্বিঘ্নে।

স্মৃতিভারাতুর অতীত গাঘেঁষে ঠায় দাঁড়িয়ে

দূরবীনে ছায়া ফেলে, নাটাইয়ের সাথে ফিরে আসে

ভুলতে পারিনা, ভুলে যাওয়া সহজ নয়।

আমিও পরিযায়ী পাখির মতো দূরে যাই

ফিরে আসি বারবার, তবু ফেরা হয়ে উঠেনা।

 

শাহীন কামাল, প্রভাষক

নাজিউর রহমান কলেজ, ভোলা।

[email protected]