ভাষা আন্দোলনে বরিশাল

আযাদ আলাউদ্দীন ।।

মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাজধানী ঢাকার রাজপথে যে উত্তাল আন্দোলন সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তার ঢেউ খুব সহজেই এসে যায় বরিশালে। কারণ- রাষ্ট্রভাষার জন্য ঘটিত কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ছিলেন বরিশালের কৃতি সন্তান কাজী গোলাম মাহবুব। এছাড়াও ওই কমিটিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ভোলার শামসুল আলম, বরিশালের আব্দুর রহমান চৌধুরী (বিচারপতি), আখতার উদ্দিন আহমেদ, এম. ডব্লিউ লকিতুল্লাহ, অনিল দাস চৌধুরী সহ বৃহত্তর বরিশালের অনেক ভাষা সৈনিক।
শুধু তাই নয়- ২১ ফেব্রুয়ারির সাংস্কৃতিক চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন বৃহত্তর বরিশালের কবি সাতিত্যিক সাংবাদিক ও শিল্পীরা। ভাষা আন্দোলনের পর যেসব গান-কবিতা সারা বাংলাদেশে এমনকি সমগ্র বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তার অধিকাংশেরই স্রষ্টা হলেন এই বরিশালের সন্তান। যেমন- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি——-, গানের রচয়িতা তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী, প্রথম সুরকার আবদুল লতিফ, পরবর্তী ও বর্তমান সুরকার আলতাফ মাহমুদ সবাই এই বরিশালের কৃতি সন্তান। আবার আবদুল লতিফের ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়—- বিখ্যাত এই গান- কিংবা কিংবদন্তির কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘মাগো ওরা বলে’ কবিতায় ফুটে ওঠে মায়ের ভাষার প্রতি হৃদয়স্পর্শী আবেগ আর অনুভূতি।

বরিশালের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ন তথ্য পাওয়া যায় বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস’ গ্রন্থে। এছাড়াও জীবিত থাকাকালীন সময়ে বরিশালের কয়েকজন ভাষা সৈনিকের স্মৃতিচারণ থেকেও বেরিয়ে এসেছিল অনেক না জানা কাহিনী। কিন্তু গত কয়েক বছরের ব্যবধানে একে একে পরপারে চলে গেছেন বরিশালের সর্বজন পরিচিত কয়েকজন ভাষা সৈনিক। এদের মধ্যে রয়েছেন- আবুল হাসেম, মোশারেফ হোসেন নান্নু, রানী ভট্রাচার্য প্রমুখ।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস অধ্যয়ন করে জানা যায়- ১৯৪৭ সালের শেষভাগে বরিশালের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট গোলাম কবীর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার উপর একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেন । সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বক্তব্য রাখেন অ্যাড. অবনী ঘোষ, অ্যাড. মোবারক আলী, রফিকুল ইসলাম, বি.এম কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ডি.এন চ্যাটার্জি। এ সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেন বক্তারা।

১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আন্দোলন শুরু হয়। ওই বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রশীদ বিল্ডিং-এ এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় ফজলুল হক হলের ছাত্র ভোলার শামসুল আলমকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা ছিলেন বরিশালের আব্দুর রহমান চৌধুরী (বিচারপতি)। তিনি তখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সহ-সভাপতি ছিলেন। একই দিনে বরিশাল মুসলিম ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে এক জনসভার আয়োজন করে মুসলিম ছাত্রলীগ। ছদরুদ্দিনের সভাপতিত্বে এ সভায় বক্তব্য রাখেন আখতার উদ্দিন আহমদ, এম ডব্লিউ লকিতুল্লাহ, অনিল দাস চৌধুরী। সন্ধ্যায় এক শোভাযাত্রা শহর প্রদক্ষিণ করে। বিএম কলেজেও ওইদিন ছাত্রদের উদ্যোগে প্রতিবাদ সভা হয়। অশ্বিনী কুমার হলে আর একটি সভায় সভাপতিত্ব করেন হাশেম আলী। সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি করা হয়।

১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে প্রদেশব্যাপী হরতাল পালিত হয় এবং সচিবালয় ঘেরাও করা হয়। পুলিশ শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বরিশালের কাজী গোলাম মাহবুব ও সরদার ফজলুল করিমকে (অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) গ্রেফতার করে। ঢাকার সংগ্রাম কমিটির আহবানে ওইদিন বরিশালের স্কুল-কলেজেও ধর্মঘট পালিত হয়। বরিশাল মুসলিম ছাত্রলীগ এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। ছাত্র ফেডারেশন তাদের সমর্থন দেয়। ছাত্রলীগের কাজী বাহাউদ্দীন আহমেদ আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনে বরিশালের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ১১ মার্চ হরতালের পর সভা করার জন্য কোথাও জায়গা পাওয়া যায়নি। তখন বরিশাল শহরে ফকির বাড়ি রাস্তার পাশে সদর রোড দীপালি (অভিরুচি) সিনেমা হলের সামনে এবং আর্য্যলক্ষ্মী সংলগ্ন কচুখেতে সভার আয়োজন করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কাজী বাহাউদ্দীন আহমেদ এবং বক্তৃতা করেন ভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক শামসুল হক চৌধুরী (সুপ্রিমকোর্ট বারের সাবেক সভাপতি), এ বি এম আবদুল লতিফ (অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) মোহাম্মদ আর্শেদ (ভোলা), মোখলেছুর রহমান, আশরাফ আলী খান, হাসান ইমাম চৌধুরী প্রমুখ। জনসভার ছবি তোলেন ফখরুল ইসলাম খান। ওইদিন সন্ধ্যার পর পুলিশ কাজী বাহাউদ্দীন আহমেদ, শামসুল হক চৌধুরী, আঃ রশিদ, মোহাম্মদ আর্শেদ ও এবিএম আশরাফ আলী খান ও শেখ মালেককে গ্রেফতার করে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এই গ্রেফতারের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র-জনতা থানা ঘিরে ফেলে। পরে বাধ্য হয়ে প্রশাসন বন্দিদের মুক্তি দেয়।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকার এক জনসভায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করলে এর প্রতিবাদে বিভিন্ন দলসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’। ২৮ সদস্য বিশিষ্ট এই কর্মপরিষদের ৫ জন ছিলেন বৃহত্তর বরিশাল জেলার। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণার উত্তাপ বরিশালেও অনুভূত হয়। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহবানে বরিশালে ‘২১ ফেব্রুয়ারি’ পালনের প্রস্তুতি চলে। আওয়ামী মুসলিম লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের উদ্যোগে ১১ ফেব্রুয়ারি হতে অর্থ সংগ্রহের জন্য ‘পতাকাদিবস’ পালন শুরু হয়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এ নামে পতাকা ও ব্যাজ বিতরণ এবং পোস্টারিং চলতে থাকে। কর্মীরা টিনের চোঙা নিয়ে রাস্তায় প্রচার কাজ চালায়। এই চোঙা ফোকানোর অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শ্রী নিখিল সেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি আবদুল মালেক খানকে সভাপতি এবং যুবলীগের সম্পাদক আবুল হাশেমকে আহবায়ক করে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট ‘বরিশাল রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয। বরিশাল যুবলীগের সভাপতি আলী আশরাফ ছিলেন সংগ্রাম পরিষদের অবিসংবাদিত নেতা।

বরিশালে ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিএম কলেজের ছাত্রবৃন্দ ছিলেন মূল চালিকাশক্তি। তারা পৃথক ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেন। এর আহবায়ক ছিলেন ছাত্রলীগ সভাপতি এবং বিএম কলেজ ছাত্রসংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া (গৌরনদী)। সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন ছাত্রলীগ সম্পাদক একেএম বেলায়েত হোসেন (শ্রমিক নেতা), সহ-সভাপতি মতিউর রহমান, যুগ্ম সম্পাদক গোলাম রব্বানী, ট্রেজারার রফিকুল ইসলাম (১৯৭১ সালে শহিদ), সিদ্দিকুর রহমান, মোহাম্মদ ইউসুফ কালু, কলেজ সংসদের সম্পাদক আবদুস সাত্তার, সমীর পাল, জসিম বিশ্বাস, সরদার গোলাম কুদ্দুস প্রমুখ।

২১ ফেব্রুয়ারি বৃহত্তর বরিশালের সকল বিদ্যালয় ও শহরে হরতাল পালিত হয়। মিছিল বরিশাল শহর প্রদক্ষিণ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র হত্যার সংবাদ বরিশালে পৌছলে একজন পুলিশ সদস্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে তা জানান। ফলে পরিষদের উদ্যোগে রাত ৯ টায় শহরে মিছিল বের হয়। ওই রাতেই সার্কিট হাউসের নিকট অবস্থিত বরিশাল মুসলিম ইনস্টিটিউটে সংগ্রাম পরিষদের সভা বসে এবং পরবর্তীতে কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়। সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সংখ্যা ২৫ হতে ৮১ জনে উন্নীত করা হয়। ‘বরিশাল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’র অন্তর্ভুক্ত যারা ছিলেন তাদের কয়েকজন হলেন- আব্দুল মালেক খান (সভাপতি-তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের জেলা সভাপতি), আবুল হাশেম (সম্পাদক, যুবলীগ আহবায়ক), আলী আশরাফ (সভাপতি, যুবলীগ সদস্য), আবদুল আজিজ তালূকদার, অ্যাডভোকেট আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, প্রাণকুমার সেন, জাহিদ হোসেন জাহাঙ্গীর, আব্দুল করিম, সিরাজুল হক ভূঁইয়া (নয়া মিয়া), উকিল ওবায়দুল হক, উকিল আমিনুল হক চৌধুরী (সম্পাদক, আওয়ামী মুসলিম লীগ), ডাঃ হাবিবুর রহমান, নিখিল সেন, ইমাদুল্লাহ (লালা ভাই), সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া, মিসেস হামিদ উদ্দিন, মোশারেফ হোসেন মোচন, আলতাফ মাহমুদ (শহিদ), মোহাম্মদ হোসেন আলী, সরদার গোলাম কুদ্দুস, সৈয়দ আজিজুল হক শাহজাহান, সুনীল গুপ্ত, মোহাম্মদ ইউসুফ কালু, সাধণ রায় চৌধুরী, সুলতান মিয়া, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, মুজিবুর রহমান কাঞ্চন (শহিদ), নসরুল্লাহ খসরু, আবদুস সাত্তার, বরুণ বর্মণ, হাজি আবদুল লতিফ খান প্রমুখ।

২১ ফেব্রুয়ারি সারা রাতেই ছাত্রদের প্রচারকাজ চলে। ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি বরিশালে হরতাল ও মিছিল হয়। অন্যান্য জায়গার মতো বরিশালেও আন্দোলনকে সংগঠিত করার পেছনে চালিকাশক্তি ছিল ছাত্রসমাজ। প্রায় পাঁচশ ছাত্রের এক মিছিল ক্লাস বর্জন করে বেরিয়ে পড়ে বরিশাল একে স্কুল থেকে। এর সংগঠক হিসেবে ছিলেন স্কুলের জেনারেল ক্যাপ্টেন একেএম আজহার উদ্দিন। এছাড়া নবম শ্রেণির ক্লাস ক্যাপ্টেন এ বারেক খলিফা, মীর আশ্রাফ উদ্দিন প্রমুখ আন্দোলন সংগঠনে ভূমিকা রাখেন। এ. কে স্কুল ময়দানে ভাষা শহিদদের উদ্দেশ্যে গায়েবানা জানাজা পড়ান মৌলবী সুলতান আহমেদ। জানাজা শেষে ছাত্র-জনতা শহর রাস্তা প্রদক্ষিণ করে স্থানীয় অশ্বিনী কুমার টাউন হল চত্বরে সমবেত হন। সেখানে একেএম আজহার উদ্দিনের সভাপতিত্বে এক শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়।

২২ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা হতে স্টিমারে আগত সৈয়দ শামসুল হুদা একটি টেলিগ্রাম সংবাদপত্র নিয়ে আসেন, যাতে ঢাকায় ছাত্র হত্যার সংবাদ ছিল। অশ্বিনী কুমার হলের সামনে ভোর হতে ছাত্র-জনতার স্রোত নামে। গ্রাম হতে আগত জনতা ছাড়াও শহরের শত শত মহিলা মিসেস হামিদ উদ্দিনের (আওয়ামী লীগ এমপিএ) নেতৃত্বে প্রথম শোভাযাত্রা করেন। বরিশালের অন্যান্য মহিলা ভাষা সৈনিক হলেন হোসনে আরা নিরু, মঞ্জুশ্রী, মাহে নূর বেগম, রানী ভট্টাচার্য প্রমুখ। মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন মেয়েরা, তারপরে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ। স্মরণকালের বৃহত্তম মৌনমিছল অশ্বিনী কুমার হল হতে শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে সার্কিট হাউস ময়দানে গিয়ে শেষ হয়। অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী খান বাহাদুর হাশেম আলী, অ্যাডভোকেট শামসের আলী প্রমুখ নগ্নপদে মৌনমিছিলে অংশ গ্রহণ করেন। ওইদিন অনেক মুসলিম লীগ নেতাকর্মী দল ত্যাগ করেন। সংগ্রামী জনতার এক জনসভা ওইদিন বিকেল ৩ টায় অশ্বিনী কুমার হলে অনুষ্ঠিত হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০ টায় একে স্কুল মাঠে শহীদ ছাত্রদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরের দিন অশ্বিনী কুমার হলের সামনে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। এক্ষেত্রে অগ্রণী ছিলেন আবুল হাশেম, জাহিদ হোসেন জাহাঙ্গীর, চক বাজারের সুলতান, মোশারেফ হোসেন নান্নু, আলী আশরাফ, মোশারেফ হোসেন মোচন প্রমুখ। ২৪ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে শোকের প্রতীক কালোপতাকা এবং সংগ্রামের প্রতীক লাল পতাকা উত্তোলন করা হয়। এর আগে মোহাম্মদ সুলতান তার দোকানের ১০ গজ সাদা কাপড় দিয়ে শহিদমিনার মুড়ে দেন। পুষ্পমাল্য দিয়ে আবুল হাশেম শহিদমিনার উদ্বোধন করেন। অবশ্য ২৭ তারিখ রাতের অন্ধকারে সরকারি নির্দেশে পুলিশ শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলে।

বরিশাল শহরের বাইরেও অনেক স্থানে বিক্ষোভ মিছিল হয়। তার মধ্যে বানারীপাড়া উল্লেখযোগ্য। এখানে যারা আন্দোলনকে সংগঠিত করেন তাদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারীরা হলেন আবদুস শহীদ, অতুল ভট্টাচার্য, কালী চাঁদ বসু প্রমুখ। বানারীপাড়াায় ভাষার সংগ্রামে তাদের নেতৃত্বে উজ্জীবিত হন ছাত্ররা। বিশেষত জিন্নাহ স্কুল, কলিফা কোবা হাইস্কুল, চাখার কলেজ, নারায়নপুর হাইস্কুল, জাতীয় বিদ্যালয় প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা আন্দোলনে অংশ নেন। তাদের মিছিল বানারীপড়া গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রদক্ষিণ করে। পরে থানার সম্মুখে দিয়েও যায় মিছিলটি। তবে গ্রেফতারের হুমকির ফলে আবদুস শহীদ ও অতুল ভট্টাচার্য তখন মিছিলে ছিলেন না। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের এই মিছিল প্রমাণ করে যে, ভাষা আন্দোলনের ঢেউ সেখানেও কতখানি লেগেছিল। পরে সংগঠকদের দৃঢ়প্রত্যয়ী ভাষণের পর মিছিলের পরিসমাপ্তি ঘটে।

ভাষা আন্দোলনের সূতীকাগার ঢাকায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালনকারীদের কয়েকজন বৃহত্তর বরিশালের সন্তান। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি গঠিত ‘রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ এ বৃহত্তর বরিশালে পাঁচজন সদস্য ছিলেন। তারা হলেন কাজী গোলাম মাহবুব (আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিনিধি), শামসুল আলম (ভিপি, ফজলূল হক মুসলিম হল), শামসুল হক চৌধুরী (ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ), আখতার উদ্দিন আহমেদ, (নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ) ও মুহাম্মদ মুজিবুল হক (ভিপি, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল)। তারা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে নানাভাবে নেতৃত্ব দেন। এছাড়া ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা কলেজ ইত্যাদি) অধ্যয়নরত বৃহত্তর বরিশালের ছাত্র-ছাত্রীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

বরিশালের গৌরব শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাঙলার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেন এবং শহীদ মিনার নির্মাণ ও বাংলাভাষাকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ করার প্রস্তাব অনুমোদন করেন। বরিশালের সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে এ সকল গৃহীত প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ##