সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের অকুতোভয় মর্দে মুজাহিদ মেজর এম এ জলিলের জীবনপরিক্রমা

 

১৯৪২: পারিবারিক নাম মোহাম্মদ আব্দুল জলিল। তবে মেজর এম এ জলিল হিসেবেই বিখ্যাত। জন্ম ৯ ফেব্রুয়ারি বাকেরগঞ্জ জেলার উজিরপুরে মাতুলালয়ে। উল্লেখ্য, বাকেরগঞ্জ জেলা নামটি ১৭৯৭ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ছিলো। ১৯৯৩ সালে বরিশাল বিভাগ সৃষ্টির ফলে বাকেরগঞ্জ নামটি জেলা থেকে বাদ দেয়া হয়। পিতা জোনাব আলী চৌধুরী জন্মের তিন মাস পূর্বে ইন্তেকাল করেন। মাতার নাম- রাবেয়া খাতুন।
১৯৫৯: উজিরপুর ডব্লিউ বি ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ৷
১৯৬১: পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির মারি ইয়ং ক্যাডেট ইনস্টিটিউশন থেকে আইএ পাশ। পাশাপাশি গ্রহণ করেন সামরিক শিক্ষা৷
১৯৬২: পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে ট্রেইনি অফিসার হিসেবে যোগদান করেন৷
১৯৬৫: সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হন এবং ১২ নং ট্যাঙ্ক ক্যাভারলি রেজিমেন্ট অফিসার হিসেবে তৎকালীন পাক-ভারত যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ভারত বিরোধী লড়াইয়ে তিনি বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
১৯৬৬: পাকিস্তান একাডেমি থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন। পরে মুলতানে কর্মরত থাকাকালে ইতিহাসে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৭০: মেজর পদে উন্নীত হন৷

Image result for মেজর জলিল

১৯৭১: ১৪ ফেব্রুয়ারি এক মাসের ছুটি নিয়ে বরিশালে আসেন এবং মার্চে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি নবম সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব লাভ করেন।
– ২৬শে মার্চ মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন এবং বরিশাল অঞ্চলের ডিফেন্স চিফ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তাকে নবম সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত করে।
– ৭ই এপ্রিল খুলনা বেতার কেন্দ্র মুক্ত করতে এক ঝটিকা অপারেশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রবাসী সরকার ও স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় মেজর জলিলের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে ৮০ হাজার সদস্য নিয়ে বিরাট মুক্তিবাহিনী। ৯নং সেক্টর হেড কোয়াটার টাকিতে বসেই তিনি বেশির ভাগ গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করতেন।
– ৭ই জুলাই তার উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু স্কোয়াড নামে স্বাধীন সরকারের প্রথম নৌবাহিনী গঠিত হয়। তার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাগণ সাতক্ষীরা, খুলনা ও বরিশালের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান বাহিনীর সাথে সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধে জয়লাভ করেন। ৩২ বছরের যুবক সেক্টর কমান্ডার মেজর এম. এ. জলিলের বীরত্বপূর্ণ সফলতা বিবিসিসহ আন্তজার্তিক গণমাধ্যমে প্রশংসিত হয়।
– ৪ঠা আগস্ট দক্ষিণাঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ সাপ্তাহিক প্রকাশিত হয়। নুরুল আলম ফরিদ ছিলেন এর সম্পাদক।
– ৭ই ডিসেম্বর তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী সাতক্ষীরা মুক্ত করে।
– ৮ই ডিসেম্বর বরিশাল ও পটুয়াখালী মুক্ত হয়।
– ১৭ই ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী নিয়ে বিজয় বেশে তিনি খুলনা শহরে প্রবেশ করেন। পাকবাহিনীর অধিনায়ক বিগ্রেডিয়ার হায়াত খান ৮ হাজার সৈন্য নিয়ে খুলনা সার্কিট হাউজে মিত্র বাহিনীর অধিনায়ক লেঃ জেনারেল বলবীর সিং এর নিকট আত্মসমর্পণ করে। ভারতীয় সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করায় তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানান। ভারতীয় লুণ্ঠন বন্ধ করতে তাজউদ্দীন আহমেদ, কর্নেল ওসমানী ও জেনারেল অরোরার নিকট চিঠি পাঠান।
– ২১শে ডিসেম্বর খুলনা থেকে স্টিমার যোগে বরিশাল আগমন।
– ৩১ ডিসেম্বর ভাগ্যের পরিহাসে চক্রান্তের শিকার হয়ে যশোরে মুক্তিবাহিনীর লোকের হাতে গ্রেফতার হন। মূলত ভারতীয় হানাদারদের তা-বলীলার প্রতিবাদ করায় ভারতীয় ষড়যন্ত্রে তিনি হলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দী।

Image result for মেজর জলিল

১৯৭২: অক্টোবর মাসে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তিনি ছিলেন এ দলেন যুগ্ম আহ্বায়ক। তার নেতৃত্বে জাসদ দেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মকা- পরিচালনা করেন। সরকার বিরোধী রাজনীতিতে তিনি ছিলেন সক্রিয়। ৩১ অক্টোবর জাসদের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৭৩: বরিশাল ও ভোলা থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি সাতটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু প্রচুর জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও তাঁকে বিজয়ী হতে দেয়নি শাসকদল। সরকারি দল তাঁর বিজয় ছিনিয়ে নেয়।
১৯৭৬: সীমাহীন সমর কিতাব প্রকাশিত। শোষনমুক্ত সমাজ কায়েমের লক্ষ্যে রচনা করেন এ বই।
১৯৭৪: ১৭ মার্চ দলীয় কর্মীদের নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ঘেরাও অভিযানকালে তিনি গ্রেফতার হন। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে কয়েকশ জাসদ কর্মী হতাহত হয়।
১৯৭৫: ৮ই নভেম্বর জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন৷ সামরিক সরকার কর্তৃক ২৫ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের সাথে পুনরায় তিনি গ্রেফতার হন।
১৯৭৬: ১৮ই জুলাই আদালতের দেয়া রায়ে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন৷
১৯৮০: ২৬শে মার্চ তিনি জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন।
১৯৮১: জাসদ, ওয়ার্কাস পার্টি ও কৃষক শ্রমিক সমাজবাদী দলের সমন্বয়ে গঠিত ত্রিদলীয় জোটের মনোনীতি প্রার্থী হয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আগস্ট মাসে ত্রিপলি ও লেবাননে সফর।
১৯৮২: প্রবন্ধ কিতাব ‘দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনদর্শন’, রাজনৈতিক উপন্যাস ‘সূর্যোদয়’ প্রকাশিত। একই বছর টাঙ্গাইলের সায়মার সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন মেজর জলিল।
১৯৮৪: ৩ রা নভেম্বর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপূর্বে ২০ অক্টোবর তারিখে ইসলামি আন্দোলন হিসেবে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ঘোষণা করেন। ২১ অক্টোবর হাফেজি হুজুরসহ ১১টি ইসলামি সংগঠন সহকারে ‘সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে দেশব্যাপী ইসলামি আন্দোলন শুরু করেন।
১৯৮৫: শোষন, নির্যাতন, জুলুমের প্রতিবাদ করায় স্বৈরাচারী সরকার কর্তৃৃক জানুয়ারিতে এক মাসের জন্য গৃহবন্দী। আগস্ট মাসে লন্ডনের মুসলিম ইনস্টিটিউটে এক কনফারেন্সে যোগদান।
১৯৮৬: এপ্রিলে দ্বিতীয়বার ত্রিপলিতে কনফারেন্সে যোগদান। আগস্টে পুনরায় মুসলিম ইনস্টিটিউট লন্ডনে গমন।
১৯৮৭: নভেম্বরে আন্তর্জাতিক ইসলামিক কনফারেন্সে যোগদান করেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের জের ধরে কারাগারে প্রেরণ। ৩০ ডিসেম্বর হতে ১৯৮৮ এর মার্চ পর্যন্ত ঢাকা কারাগারে বিশেষ নিরাপত্তা আইনে বন্দী হন।
১৯৮৮: অক্টোবর মাসে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ভারতীয় হানাদার কর্তৃক লুণ্ঠনের দুর্লভ তথ্যপূর্ণ বই ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা’ প্রকাশিত।
১৯৮৯: ১১ নভেম্বর একটি সেমিনারে যোগ দিতে পাকিস্তান যান। সেখানে ১৬ নভেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ১৯ নভেম্বর রাত ১০টা ৩০ মিনিটে তিনি পাকিস্তানের ইসলামাবাদে মৃত্যুবরণ করেন৷ পরে ২২ নভেম্বর তার লাশ ঢাকায় আনা হয় এবং সামরিক মর্যাদায় তার দাফন সম্পন্ন হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৭ বছর৷