১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ, উপনিবেশবাদ এবং হাবিলদার রজব আলি

মাহমুদ ইউসুফ

সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা ১৯০ বছর প্রত্যেক্ষভাবে বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষকে শোষন করেছে, লুটপাট করেছে, পাচার করেছে। বাঙালি আযাদি পিয়াসীদের হত্যা করে, খুন করে, জেল জুলুম নির্যাতন করে, নির্বাসন দিয়ে, ফাঁসি দিয়ে বিজয়োৎসব পালন করেছে। বৃটিশ সরকার ও তাদের দালাল হিন্দু জমিদাররা। তারা মুসলমানদের জীবন ও সম্পদ হরণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।

এ প্রসঙ্গে আযাদ ভারতের প্রথম প্রধান প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ১৯৩২ সালের ৭ই ডিসেম্বর লিখেন,

‘বৃটিশদের হাতে ভারতের শিল্পগুলো ধ্বংস হয়ে যাবার ফলে তাতিরা একেবারে নি:স্ব হয়ে গিয়েছিল; এদের প্রায় সকলেই মুসলমান। ভারতের অন্যান্য সমস্ত প্রদেশের চেয়ে বাঙলাদেশেই মুসলমানদের সংখ্যা বেশি। এরা ছিল গরিব প্রজা বা অতি ক্ষুদ্র ভূস্বামী। জমিদার সাধারণত হত হিন্দু; গ্রামের বানিয়াও তাই। এই বানিয়াই হচ্ছে টাকা ধার দেবার মহাজন আর গ্রামের মুদি। কাজেই এই জমিদার এবং বানিয়া প্রজার ঘাড়ে চেপে বসে তার রক্ত শুষে নেবার সুযোগ পেত। সুযোগের যথাসাধ্য সদ্ব্যবহারও করে নিতে ছাড়ত না। এই কথাটা মনে রাখা দরকার। কেননা হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে যে বিবাদ তার মূল রয়েছে এখানে।
ঠিক একইভাবে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে। শুষে নিতেন তথাকথিত ‘অনুন্নত’ জাতিদের, তাদের অধিকাংশই কৃষিজীবী।— অস্পৃশ্য জাতিরা ছিল কৃষিজীবী ভূমিদাস; এদের নিজস্ব জমি রাখবার অধিকার ছিল না। তাছাড়া আরও অনেক অধিকার থেকে এদের বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল।’’ [জওহলাল নেহরু: বিশ্ব-ইতিহাস প্রসঙ্গ (গ্লিম্পসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্টরি এর তরযমা), আনন্দ পাবলিশার্স, ৪৫ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা ০০৯, নবম মুদ্রণ, জুন ২০১৬, পৃ ৪০৭]

এসব উচ্চবর্ণের হিন্দু ও জমিদারদের সর্দার ছিলেন ঠাকুর কবি রবীন্দ্রনাথ। যিনি আজীবন বৃটিশদের দালালিতে মত্ত ছিলেন। বৃটিশ প্রশংসায় তিনি লিখেছেন, জন গণ মন অধিনায়ক, জয় হে, বৃটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না প্রভৃতি গান কবিতা, প্রবন্ধ। তিনি লিখেছেন, আমি নানা দেশ ঘুরে এলুম। আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে এই দেখলেম একমাত্র ইংরেজ গবর্নমেন্ট ছাড়া স্বদেশি প্রজার বাক্য বা ব্যবহারে বিরুদ্ধতা আরা কোন গবর্নমেন্ট এতটা ধৈর্য্যরে সঙ্গে সহ্য করে না।— ইংরেজ রাজ ক্ষমা করবেন এই জোরের উপরেই ইংরেজ রাজকে আমরা নিন্দা করার এটাতে পৌরুষ নেই।’ [ অরবিন্দ পোদ্দার: রবীন্দ্রনাথ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, উচ্চারণ, কলকাতা, পৃ ৩২৪; উদ্বৃতি: সরকার শাহাবুদ্দিন আহমেদ: ইতিহাসের নিরিখে রবীন্দ্র নজরুল চরিত, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি, প্রকাশ ১৯৯৮, পৃ ১৭২]

অথচ গালিভারস ট্রাভলস্ বইয়ের লেখক জোনাথান সুইফট আইরিশ দেশবাসীদের উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, ইংরেজদের যা পাও তাই পুড়িয়ে দিবে তোমরা, কেবল তাদের কয়লা ছাড়া।’’ ডাবলিন শহরে তাঁর সমাধিস্তম্ভে আজও শোভা পাচ্ছে, ‘এইখানে সমাহিত হয়েছে জোনাথান সুইফটের দেহ; ৩০ বছর ধরে তিনি ছিলেন এই ক্যাথিড্রালের ডিন। হিংসা ঘৃণা এখন আর তাঁর হৃদয়কে পীড়িত করছে না। যাও, পথিক, যদি পার, তাঁর অনুকরণ কোরো, যিনি স্বাধীনতা রক্ষা করবার জন্য পুরুষের মত লড়াই করে গেছেন। [ জওহলাল নেহরু: বিশ্ব-ইতিহাস প্রসঙ্গ (গ্লিম্পসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্টরি এর তরযমা), আনন্দ পাবলিশার্স, ৪৫ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা ০০৯, নবম মুদ্রণ, জুন ২০১৬, পৃ ৫৬০-৫৬১]

সবারই জানা পলাশিতে বর্ণহিন্দুদের শঠতা, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা ও চক্রান্তে বাংলার স্বাধীনতা বিপন্ন হয়। পরবর্তী ১০০ বছর বিক্ষিপ্তভাবে চলে স্বাধীনতা সংগ্রাম। ফকির বিদ্রোহ, সাইয়েদ আহমদ বেরেলভির আযাদির লড়াই, শহিদ তিতুমিরের স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রেরণা জোগায়, শক্তি যোগায়, সাহস যোগায় স্বাধীনতা প্রিয় নেতা-কর্মীদের। এই শতবছরের স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে মুসলমানদের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়। হিন্দুরা তখন বৃটিশদের সহায়ক শক্তি। হিন্দু, শিখ, বৃটিশ মিলে সাইয়েদ আহমদ ও শাহ ইসমাইলের মুজাহিদ আন্দোলন স্তব্ধ করে দেয়। জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র বৃটিশদের সাথে ঐক্য করে নিসার আলির মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামকে বানাচাল করে দেয়। নিভিয়ে দেয়া তিতুমির, মাসুম ও তার মুজাহিদদের জীবন প্রদীপ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. অমলেন্দু দে বলেনঃ মনে রাখা দরকার, মুসলিম বিপ্লবীরাই(ওহাবিরা) বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সংঘবদ্ধভাবে ভারতবর্ষ হতে ইংরেজ বিতাড়নের জন্য দীর্ঘকাল ব্যাপী এক সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। আর এই বিপ্লবকে (ওহাবি আন্দোলন) মুসলিম কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার অভিপ্রায়ে মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে উল্লেখ করা যায়।’ (সূত্রঃ অমলেন্দু দে: বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ, পৃ ১২৯; সংগৃহীত: গোলাম আহমাদ মোর্তজা: এ সত্য গোপন কেন? মেমারী, বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, নভেম্বর ১৯৯৮, পৃ ৩৭)

১৮৫৭ সালে বাহাদুর শাহ জাফরের নেতৃত্বে ভারতবর্ষের আযাদি প্রত্যাশী জনতা বৃটিশ সরকার উৎখাতের ডাক দেয়। এবারও বর্ণহিন্দুরা বৃটিশরাজকেই সমর্থন দেয়। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় বুদ্ধিজীবী অনির্বাণ বন্দোপাধ্যায় বলেন, ১৮৫৭ সালে মহাসংগ্রামের ব্যর্থতায় বাংলার অ-মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। ‘সাহিত্য-সম্রাট’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘সংবাদ ভাস্কর’ পত্রিকায় লিখলেন — ‘‘হে পাঠক, সকলে উদ্বাহু হইয়া ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া জয়ধ্বনি করিতে করিতে নৃত্য কর। আমাদের প্রধান সেনাপতি সক্ষমরূপে দিল্লি প্রবেশ করিয়াছেন। পাঠকগণ জয় জয় বলিয়া নৃত্য কর। হিন্দু প্রজাসকল দেবালয়ে পূজা দাও। আমাদের রাজ্যেশ্বর শত্রুজয়ী হইলেন।’’ কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখলেন — ‘‘যবনের যত বংশ এবারে হবে ধ্বংস/সাজিয়াছে কোম্পানির সেনা/গোরু জরু লবে কেড়ে, চাপ দেড়ে যত নেড়ে/এই বেলা সামাল সামাল।’’ তিনি আরও অগ্রসর হয়ে লিখলেন — ‘‘চিরকাল হয় যেন বৃটিশের জয়/বৃটিশের রাজলক্ষ্মী স্থির যেন রয়/এমন সুখের রাজ্য আর নাহি হয়/শাস্ত্রমতে এই রাজ্য রামরাজ্য কয়।’’ ঈশ্বর গুপ্ত একটি জনপ্রিয় শ্লোগান পর্যন্ত তৎকালে ইংরেজানুগ এবং বিপ্লব-বিরোধী জনমত গঠনের লক্ষ্যে প্রচার করেন : ‘‘ভারতের প্রিয় পুত্র হিন্দু সমুদয়/মুক্ত মুখে বল সবে বৃটিশের জয়।’’ তাঁর সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ সে সময় সম্পূর্ণভাবে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির পক্ষে এবং সংগ্রামী-স্বাধীনতাকামী মুসলিমদের বিরুদ্ধে সুতীব্রভাবে সংবাদ এবং সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশ করতে থাকে। এমনই একটি সংখ্যায় পত্রিকাটি লেখা হয়–‘‘অবোধ যবনেরা উপস্থিত বিদ্রোহ সময়ে গভর্নমেন্টের সাহায্যার্থে কোন প্রকার সদানুষ্ঠান না-করাতে তাহাদিগের রাজভক্তি সম্পূর্ণ বিপরীতরূপ রহিয়াছে এবং ‘বিজ্ঞ লোকেরা’ তাহাদিগকে নিতান্ত অকৃতজ্ঞও জানিয়াছেন।’’ (অনির্বাণ বন্দোপাধ্যায়ঃ ভারতবর্ষে ইসলাম : প্রবেশ এবং প্রস্থান (পঞ্চবিংশতি পর্ব); ৬ আগস্ট ২০১৬)

বাধ্য হয়ে মুসলমানরা এককভাবে ইংরেজ তাড়াতে প্রাণপন লড়াই চালিয়ে যায়। ভারতবর্ষে এক ইঞ্চি জায়গাও খালি নেই যেখানে মুসলমানের রক্ত মিশে নাই। আন্দানমান নিকোবরের সেই ভয়ানক নির্বাসন আজও শিহরিত করে জীবিত মানুষদেরকে। ভারতীয় ঐতিহাসিক গোলাম আহমাদ মোর্তজা বলেন, নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের মতে (বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে) মুসলমানদের বিদ্রোহ দমনে ৫ লক্ষ বিপ্লবীর ফাঁসি দেয়া হয়েছে। বৃটিশ বুদ্ধিজীবীরা এটাকে বেমালুম হজম না করে কিঞ্চিৎ স্বীকার করা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেছেন। তাই ফিল্ড মার্শাল লর্ড রবার্ট তার Forty One Years in India পুস্তকে কিঞ্চিৎ স্বীকার করে লিখেছেন, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে মাত্র ২৭ হাজার মুসলমানের শুধু ফাঁসি দেয়া হয়েছে।’ (গোলাম আহমাদ মোর্তজা: এ সত্য গোপন কেন? মেমারী, বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, নভেম্বর ১৯৯৮, পৃ ৪৭)।

এটা তো রেকর্ডের কথা। বাস্তবতা এর চেয়ে বহু ভয়াবহ। এত গেল শুধু ফাঁসির কথা। গুলি, বোমাবাজি, অপহরণ, গুম, উৎখাত, দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে কতসংখ্যক মুসলমানকে খুন করা হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। ‘বৃটিশ যেমন মুসলিম পুুরুষদের উপর অত্যাচার করেছে মুসলিম নারীদেরও কম কম কষ্ট সহ্য করতে হয়নি। তাদেরকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে সর্বপ্রকার নির্যাতন চালানো হয়েছে। শেষে অনেককে মেরে ফেলে তাদের স্তন কেটে সাধের পোষা কুকুরকে খাওয়ানো হয়েছে। (গোলাম আহমাদ মোর্তজা: এ সত্য গোপন কেন? মেমারী, বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, নভেম্বর ১৯৯৮, পৃ ২৮)।

মুসলিম বিপ্লবীদের শুধু কেবল জেল ফাঁসিই হয়নি কোটি কোটি ক্ষেত্রে তাদের জরিমানা হয়েছে এবং স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি কেড়ে নিলাম করে ইংরেজরা অর্থ জোগাড় করেছে। যদিও বৃটিশ সরকার ইংলন্ড থেকে কখনো টাকা আনেনি তথাপি বৃটিশ শাসনে যত রাস্তাঘাট, ব্রিজ, রেলপথ, টেলি ও ডাক ব্যবস্থা ইত্যাদি হয়েছে তার সিংহভাগ খরচা মুসলিম সমাজ থেকেই প্রাপ্ত। দুশো বছর রাজত্ব করে ভাগ্যান্বেষণে আগত বৃটিশরা যদি দরিদ্র থেকে ধনী হতে পারে তাহলে পৌনে এক হাজার বছর রাজত্ব করার পর মুসলমান জাতি যে সকল সম্প্রদায়ের চেয়ে ধনী ছিল তা ঐতিহাসিক সত্য। জমি কেমন করে কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং সরকারি বেসরকারি চাকরি থেকে তাদেরকে কেমন করে বঞ্চিত করা হয়েছে সে তথ্য মিস্টার উইলিয়াম হান্টারের লেখা ‘ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ গ্রন্থে পরিদৃষ্ট হয়। (গোলাম আহমাদ মোর্তজা: এ সত্য গোপন কেন? মেমারী, বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, নভেম্বর ১৯৯৮,পৃ ৮-৯)

১৮৫৭ সালের ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পরে ইংরেজরা ধরে নেয় যে মুসলমানরা তাদের চরম শত্রু। তাই যাদের সঙ্গে বিপ্লবের সামান্যতম যোগ ছিল তাদের পা বেঁধে গাছের ডালে ঝুলিয়ে নিচে আগুন জ্বালিয়ে দেহের মাংস ঝলসে দেয়া হয়। আবার হাজার হাজার মুসলিম বিপ্লবীদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারা হয়। বহু বিপ্লবীকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট করে দেহ ক্ষতবিক্ষত করা হয়। (মেওয়ারাম গুপ্ত: হিন্দুস্তান কী জঙ্গে আযাদীকে মুজাহিদীন, পৃ ২০; সংগৃহীত: গোলাম আহমাদ মোর্তজা: এ সত্য গোপন কেন? মেমারী, বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, নভেম্বর ১৯৯৮, পৃ ২২।

হাবিলদার রজব আলি ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের এক লড়াকু সৈনিক। নিকষ কালো অন্ধকার রজনীর আলোকবর্তিকা, মেঘলা রাতের তারা, অমাবশ্যার রাতের আলোকরশ্মি, সময়ের সাহসী সৈনিক, ভয়ঙ্কর বিপদের একনিষ্ঠ বন্ধু, বাঙালির মুক্তির দিশারি, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অসম সাহসী যোদ্ধা হাবিলদার রজব আলি।

ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা প্রথম হানা দেয় জেরুজালেমে ১০৯৭ সালে। ধর্মযুদ্ধের নামে ইউরোপীয় অসভ্য ক্রুসেডাররা লাখ লাখ মুসলমানদের নির্মমভাবে হত্যা করে। দ্বাদশ শতকে ইমাম উদ্দিন জেঙ্কি, নুরুদ্দিন জেঙ্কি ও সালাহউদ্দিন আইয়বির হাতে শোচনীয় পরাজয় ঘটে ক্রসেডারদের। ভারতবর্ষের পিঠে সওয়ার হওয়া ইংরেজরাও ছিলো ক্রুসেডারদের উত্তরসূরী ও তল্পিবাহক। তাই ২০০ বছরের বৃটিশ শাসনে মুসলমানরা একদিনও বিশ্রাম নেয়নি স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে। রজব আলি সেই সব বিপ্লবীদের প্রথম সারির একজন। নুরুদ্দিন, সালাহউদ্দিন, সিরাজদৌলা, মজনু শাহ, মুসা শাহ, টিপু সুলতান, সাইয়েদ আহমদ, শাহ ইসমাইল, তিতুমির, মাসুম খানের পরবর্তী নায়ক।

ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্রই টালমাটাল। কিন্তু চট্টগ্রাম তখন নিরব নিস্তব্ধ। বিপ্লবের ঢেউ সেখানে পৌঁছেনি। প্রশাসন, সৈন্যবাহিনী, জনগণ সবাই তাদের রুটিন মাফিক কাজে ব্যস্ত। বিদ্রোহের কোনো নামগন্ধও নেই। ১৮ই নভেম্বর ১৮৫৭; গভীর রাত। সবাই ঘুমে নিমজ্জিত। হঠাৎ বিদ্রোহের ডাক ওঠে রজব আলি ও তাঁর অনুগত সৈনিক মুজাহিদবৃন্দ থেকে। অসম সাহসী বীরশ্রেষ্ঠ রজব আলি সিংহের মত গর্জে ওঠেন জনগণের আশু মুক্তি ও অধিকার পুনরুদ্ধারে। মহাশক্তিধর বৃটিশ শাসন উৎখাতে সৈন্য পরিচালনা করেন নিজের জীবন বিপন্ন জেনেও। সাম্রম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে হাজার হাজার সঙ্গীসাথীসহ নিজের জীবন কুরবানি দেন।

নামজাদা মনীষী সত্যেন সেন রজব আলির বিদ্রোহ সম্পর্কে বলেন, ১৮ই নভেম্বরের স্মরণীয় রাত। চট্টগ্রামের সিপাইদের ৩৪ নং রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করে বসল। এইখান থেকেই আমাদের কাহিনি শুরু। সেদিনকার বাংলাদেশে- কলকাতায় নয়, ব্যারাকপুরে নয়, জলপাইগুড়িতে নয়, ঢাকায় নয়, আর কোনো অঞ্চলে নয়, সিপাইদের প্রথম ও স্বাধীন অভ্যুত্থান চট্টগ্রামেই যে প্রথম ঘটেছিল, এ কথা অনেকেই জানি না। —সমস্ত বাংলা দেশের মধ্যে চট্টগ্রামের সিপাইরাই বান জাগিয়ে তুলল, এই কথাটি স্মরণ করে রাখবার মতো। এই প্রসঙ্গে দুটি কথা মনে রাখা দরকার। চট্টগ্রামের সিপাইদের মধ্যে ব্যারাকপুরের সিপাইদের একটা দলও ছিলো, সেখান থেকে তারা বিদ্রোহের অগ্নিমন্ত্র বহন করে নিয়ে এসেছিল, এই অনুমান অস্বাভাবিক নয়। দ্বিতীয় কথা চট্টগ্রামে সরকারি তৎপরতা ছিল খুবই কম, বিদ্রোহ করতে গিয়ে বিদ্রোহীদের সরকারি বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি।— হাবিলদার রজব আলী খাঁ। বিদ্রোহী সিপাইদের পরিচালনার ভার তাঁর উপরেই এসে পড়ল। বিদ্রোহীরা স্থির করেছিল যে, তারা ইংরাজের রাজত্ব ছেড়ে স্বাধীন ত্রিপুরার নিরাপদ অঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নেবে। রজব আলী খাঁ তাঁর বাহিনীকে সেই পথেই পরিচালিত করলেন। সরলমনা সিপাইরা ভাবতেও পারেনি ইংরাজের আসল গোলামেরা স্বাধীনতার তকমা এটে তাদের ইংরাজ প্রভুর হুকুম তামিল করে চলেছে।–. স্বাধীন ত্রিপুরার রাজা তাদেরই একজন। চট্টগ্রামের কমিশনার ত্রিপুরা রাজার কাছে সংবাদ পাঠালেন, বিদ্রোহী সিপাইরা তোমার রাজ্যর দিকে চলেছে, তাদের আটকাও! অতি বশংবদ ‘স্বাধীন’ রাজা উত্তরে জানালেন- জী হুজুর, প্রস্তুত আছি! শুধু রাজার কাছে নয়, (ইংরেজ) কমিশনার সাহেব পার্বত্য প্রদেশের আরও দুই জন বড় বড় জমিদারের কাাছেও এই মর্মে চিঠি দিলেন। বিদ্রোহীরা সীতাকু- হয়ে ২রা ডিসেম্বর তারিখে ‘স্বাধীন’ ত্রিপুরার প্রবেশদ্বারে গিয়ে পৌঁছল। গিয়ে দেখল, বহু সশস্ত্র সৈন্য সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। বিদ্রোহীদের অভিনন্দন বা অভ্যর্থনা জানাবার জন্য নয়, তাদের ধ্বংস করবার জন্য তলোয়ারে শান দিচ্ছে।— বিদ্রোহীরা মণিপুর রাজ্যের সীমানার মধ্যে পৌঁছে গেল। এরপরেও শ্রীহট্টের সিপাইদের সঙ্গে তাদের দু’বার যুদ্ধ হয়। আক্রমণের আশঙ্কায় শেষ পর্যন্ত তাদের পার্বত্য অঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়। পর পর কয়েকটা যুদ্ধে তাদের পক্ষের অনেক লোক মারা যায়! যারা বেঁচে ছিলো, তাদেরও বাইরে বেরিয়ে আসবার কোনোই পথ ছিলো না। এই দুর্গম পার্বত্য প্রদেশে তারা আটক পড়ে গেল। তার পর তাদের কী হয়েছিল, সে ইতিহাস কেউ জানে না।’ (সত্যেন সেনঃ মহাবিদ্রোহের কাহিনী, পৃ ১৫৫-১৫৯)

বিংশ শতাব্দির প্রথমার্ধের চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী, সাম্প্রদায়িক, জনবিদ্বেষী সূর্যসেন, প্রীতিলতাদের জয়ধ্বনি হচ্ছে। গণমাধ্যমে, মঞ্চে, ফিল্মে, পাঠ্যপুস্তকে। কিন্তু স্বাধীনতার সংগ্রামের দিশারী হাবিলদার রজব আলি নামটি অনুচ্চারিত, উপেক্ষিত, অপাঙক্তেয়, পর্দার অন্তরালে। কিন্তু কেন? মুসলিম হওয়াই কী তাঁর অপরাধ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *