‘অবিরাম বাংলা বন্ধুমহল’ এবং আমাদের স্বপ্ন…

আযাদ আলাউদ্দীন
শুরু যেভাবে…
সরকারি বিএম কলেজের বাংলা বিভাগে আমরা ছিলাম অনার্স ১৯৯৮-৯৯ বর্ষের শিক্ষার্থী। কলেজ থেকে পাশ করে বের হওয়ার প্রায় দেড় যুগ পর ফেসবুকের কল্যাণে আমরা আমাদের প্রায় ৯০ ভাগ সহপাঠিকে খুঁজে বের করি। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে আমাদের বন্ধু মোহাম্মদ এনামুল হক সবুজ (মুন্সী এনাম)। পাশ করে যে যার মতো বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরও প্রতি ঈদে সবাইকে (যাদের নম্বর তার কাছে ছিলো) ম্যাসেজ পাঠাতো এনাম। এনাম বাংলালিংকের চাকুরি ছেড়ে মাদারীপুর থেকে বরিশাল চলে আসার পর আমরা যারা বরিশালে আছি তারা একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নেই যে আমরা সহপাঠীরা একটি পনর্মিলনী করবো। তার পর থেকে চলে একাধিক প্রস্তুতি ও সমন্বয় সভা। প্রথম সভায় পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক মনোনীত করা হয় ঝালকাঠি সরকারি স্কুলের সহকারি শিক্ষক মোহাম্মদ শাহাদাৎ হোসেন কে। ঢাকায় অবস্থানরত বন্ধুরা আমাদের সাথে যোগাযোগ করে ঢাকায় আলাদাভাবে একাধিকবার প্রস্তুতি সভা করে এবং আমরাও বরিশালে একাধিক প্রস্তুতি সভা করি। সব মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত সমন্বয় করে আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, সবাইকে নিয়ে বরিশাল নগরীর প্লানেট ওয়াল্ড পার্কে একটি পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত হবে। তারিখ নির্ধারিত হয় ২০১৮ সালের ২০ মার্চ।
সকল বন্ধুর সহযোগিতায় চলতে থাকে পুরনো সব বন্ধুদের খুঁজে বের করার কাজ। ছাত্রজীবনে কার সাথে কার বেশি যোগাযোগ ছিলো- সেই সূত্র এবং ফেসবুকে সার্চ দিয়ে অনেককে খুঁজে বের করা হয়। একই সাথে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের স্মারক বের করার জন্য সবার ছবি , বর্তমান কর্মস্থল, স্থায়ী ঠিকানা সহ পুরো বায়োডাটা কালেকশন করা হয়। এসব কাজ চলতে থাকে বরিশালের আইটি প্রতিষ্ঠান সাতরং সিস্টেমস থেকে।
ওই পুনর্মিলনীতে আমাদের সময়কার সকল স্যার-ম্যাডাম এবং বর্তমান বিভাগীয় প্রধানকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানাই। আমন্ত্রিত প্রত্যেক অতিথিকে ক্রেস্ট প্রদান করি। আমন্ত্রণ থেকে বাদ যায়নি আমাদের সময়কার অফিস সহকারি আবদুল জলিলও। সেই পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে আমাদের প্রায় ৮০ জন বন্ধু তাদের জীবনসঙ্গী ও সন্তানদের সাথে নিয়ে উপস্থিত হন। সবমিলিয়ে উপস্থিতি সংখ্যা ছিলো প্রায় দু’শতাধিক। ১৮ বছর পর বন্ধুদের অনেকের সাথে অনেকের দেখা! সে এক অন্যরকম দৃশ্য, সেই আবেগ কখনো ভুলবার নয়। দিনভর অনুষ্ঠিত হলো স্মৃতিচারণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খাওয়া-দাওয়া, গিফট বিনিময়, গ্রুপ ছবি তোলা আরো কত কি! সবমিলিয়ে সবার সহযোগিতায় সফল এক অনুষ্ঠান।
পুনর্মিলনীর পর থেকে আমরা সহপাঠিরা প্রায় সবাই এখন একটি ছাতার নিচে অবস্থান করছি। সেটি হলো- ‘অবিরাম বাংলা বন্ধু মহল’ এটি আমাদের একটি সমিতি এবং নিজস্ব ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপ। এই সমিতির নামকরণের প্রস্তাবক মন্সী এনাম। পরবর্তীতে সবার সম্মতিতে এ নামেই চলে আমাদের যাবতীয় কার্যক্রম।
আমাদের বন্ধুদের কেউ আমেরিকায়, কেউ লন্ডনে, কেউ ইতালিতে, কেউ ঢাকায়, কেউ চট্রগ্রামে, কেউ বরিশালে। কিন্তু ম্যাসেঞ্জার গ্রুপের কল্যাণে আমরা সবাই এক ফ্লাটফর্মে। প্রতিমুহুর্তে সবাই সবার খবরাখবর পাচ্ছি। সুখে দু:খে একে অপরের পাশে থাকছি। সবমিলিয়ে বলতে পারি ‘আমরা এখন একে অপরের পরিপূরক’ । ২০১৮ সালের পুনর্মিলনীর সময় আমরা‘বন্ধু’ নামে একটি ম্যাগাজিন বের করি। সেখানে সকল বন্ধুর ছবি ও বর্তমান বায়োডাটা ছাপা হয়েছে।
এর কিছুদিন পর ২৭ এপ্রিল বিকেলে বরিশাল নগরীর চায়না প্যালেস রেস্তোরায় অনুষ্ঠিত এক সভার মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে গঠিত হয় ‘অবিরাম বাংলা বন্ধুমহল’র খসড়া কমিটি। প্রতিমাসে সদস্যরা এক হাজার টাকা করে জমা রাখে এই সমিতিতে। এক বছরের মধ্যে তৈরি হয় সমিতির গঠনতন্ত্র। গঠনতন্ত্র পাশ ও আনুষ্ঠানিক কমিটি গঠন হয় ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ। স্থান ছিলো- বরিশাল প্রেসক্লাব মিলনায়তন। এতে সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে চেয়ারম্যান মনোনীত হন বরিশাল মেট্রোপলিটন কলেজের চেয়ারম্যান সাংবাদিক আযাদ আলাউদ্দীন এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর হন জমজম নার্সিং ইনস্টিটিউটের পাবলিক রিলেশন অফিসার মোহাম্মদ এনামুল হক সবুজ (মুন্সী এনাম)। ১১ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটি আগামী তিন বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করছে।
আমাদের সমিতিতে ইতোমধ্যে ৮ লক্ষাধিক টাকা জমা হয়েছে। আমরা মনে করি- নিজেদের সততা আর ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারলে এখন অনেক কিছুই করা সম্ভব। যেমন বড় কোন উদ্যোগ নিয়ে প্রত্যেকে এক লাখ করে টাকা দিলে ৫০ লাখ টাকা হয়ে যায়। আমাদের বন্ধুদের পরস্পরের প্রতি আস্থা ও সে ধরণের মন মানসিকতা এবং সামর্থ্য অনেকেরই রয়েছে। তাই আমরা এই অবিরাম বাংলা বন্ধুমহল নিয়ে খুবই আশাবাদী। ইতোমধ্যে আমরা বরিশাল নগরী সংলগ্ন শোলনা এলাকায় এক একর জমির একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়ে কাজ করছি।
আমাদের স্বপ্ন…
আমরা যেহেতু বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, সেহেতু আমাদের স্বপ্নটাও একটু ভিন্ন ধরণের। আমরা চিন্তা করেছি আল্লাহ যদি আমাদেরকে হায়াতে বাঁচান, যখন আমরা অবসরে যাবো বা ষাটোদ্ধ বয়স হবে তখন যেন আমরা বন্ধুরা একে অপরের কাছাকাছি থাকতে পারি, সেজন্য বরিশাল শহরের কাছাকাছি একটা পল্লী গড়ে তুলবো। যে পল্লীর নাম হবে ‘অবিরাম বাংলা পল্লী’। অনেকটা ঠিক হুমায়ুন আহমেদের নুহাশ পল্লীর মতো। যেখানে গেলে প্রাকৃতিকভাবেই সাহিত্য চর্চার আবহ তৈরী হবে।
আমরা বাস্তব জীবনে কয়েকটি ঘটনা দেখেছি ‘মানুষ অবসরে গেলে অনেক কিছুই থাকে, বিন্তু আড্ডা বা সঙ্গ দেয়ার মানুষ খুব একটা থাকে না। অথচ সেটাই তখন তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আমাদের কয়েকজন শ্রদ্ধেয় স্যারকে দেখেছি যারা এই অবসর সময়ে চরম নি:সঙ্গ সময় কাটাচ্ছেন । তাদের টাকা পয়সা সন্তান সন্তুতি সব আছে। কিন্তু তাদেরকে সময় দেয়ার কিংবা তাদের সাথে কথা বলার কেউ নেই। আমরা যখন স্যারদের বাসায় আমাদের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ নিয়ে গিয়েছিলাম- তখন দেখেছি কয়েকজন স্যারের চরম নি:সঙ্গতা। আমাদেরকে কাছে পেয়ে তারা কি-যে খুশি হয়েছিলেন তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। আমরা মনে করি আমাদের স্বপ্নের সেই ‘অবিরাম বাংলা পল্লী’ আমাদেরকে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাছে রাখবে। সেই স্বপ্নকে বুকে ধারণ করেই এগিয়ে চলছি আমরা…
অবিরাম বাংলা যাকাত ফাউন্ডেশন
অবিরাম বাংলা বন্ধুমহলের দ্বিতীয় উদ্যোগ হচ্ছে ‘অবিরাম বাংলা যাকাত ফাউন্ডেশন’। মানুষের কল্যাণে কিছু করার অংশ হিসেবে আমরা গঠন করেছি এই সহযোগী সংগঠন। এই ফাউন্ডেশন অবিরাম বাংলা বন্ধুমহলের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে সম্প্রতি এটির সভাপতি নিযুক্ত করা হয়েছে আমাদের সহপাঠী, গুডহেলথ ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সালেহ মুসা ও সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম সাগর কে। আমাদের অনেকের উপরই যাকাত ফরজ হয়েছে। সেই যাকাতের টাকার একটা অংশ আমরা এই ফাউন্ডেশনে প্রদান করছি। আমরা আশা করছি এবছর এই ফাউন্ডেশনে লক্ষাধিক টাকা জমা হবে এবং ভবিষ্যতে এর পরিমাণ আরো অনেক বাড়বে। এমরা এসব টাকা দল-মত জাতি-ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের কল্যাণে কুরআনের নির্দেশিত পন্থায় ব্যয় করবো। ##
আযাদ আলাউদ্দীন
চেয়ারম্যান
অবিরাম বাংলা বন্ধুমহল

৩ comments

  1. খুব ভালো উদ্যোগ।
    আমি বাংলা বিভাগ, বিএম কলেজ নামে
    একটি গ্রুপ তৈরি করেছি। এগ্রুপে সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো যায় কিনা বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *