প্রাচীন রোমে ডমিশিয়ানের সন্ত্রাস
প্রাচীন রোমে ভেস্পাসিয়ান বংশের শেষ সম্রট ছিলেন ডমিশিয়ান [৮১-৯৬ খ্রিষ্টাব্দ]। তার আসল নাম টাইটাস ফ্লোভিয়াস ডমিশিয়ানাস। বড়ভাই রাজা টাইটাস মারা যাওয়ার পর ৮১ সনে তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হন। তিনি ক্ষমতার প্রথম দিকে শান্ত প্রকৃতির ছিলেন। ক্রমান্বয়ে তিনি স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেন। সন্দেহপ্রবণতা ও প্রতিশোধপরায়ণতা তাকে একনায়কে পরিণত করে। তিনি রোমের অনেক দার্শনিককে ফাঁসিতে ঝোলান। তিনি মনে করেছিলেন, যেহেতু তারা একটি আদর্শমুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলেন। সুতরাং তারা সব সম্রাটের বিপক্ষের শক্তি। সা¤্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বসবাসরত ইহুদি-খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেন।
৮৮ সালে জার্মান সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান অ্যান্টোয়িাস স্যাটার্নিয়াস বিদ্রোহ ঘোষণা করলে ডমিশিয়ান জেনোসাইড চালায় তাদের বিরুদ্ধে। সুসংগঠিত রোমান বাহিনীর হাতে মারা পড়ে সাম্রাজ্যের আনাচেকানাচে তাদের মৃত শরীরগুলো পড়ে থাকতে দেখা যেত। এছাড়া তিনি দানিয়ুবে ডেশিয়ান উপজাতির বিরুদ্ধে আগ্রাসি অভিযান পরিচালনা করেন।
ডমিশিয়ানের শেষ বছরগুলোকে ঐতিহাসিকরা সন্ত্রাসের রাজত্ব বলে বর্ণনা করেছেন। শেষে ৯৬ সনে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে নিহত হয়। সম্রাজ্ঞী নিজেও এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার।
[আইজ্যাক আসিমাভ: রোমান সাম্রাজ্য (তরযমা- আফসানা বেগম), উত্তরাধিকার, নবপর্যায়ে ৫১ সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০৪, পৃ ১৩৭-১৪১]
ভারতে দলিতদের ওপর চালানো নৃশংসতার কাহিনি
ভারতে ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দেখা গেছে, দেশটিতে বর্তমানে দলিতদের সংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। এর সঙ্গে অন্যান্য অনুন্নত শ্রেণি যেমন তফসিলি জাতি, উপজাতি ও অনগ্রসর স¤প্রদায়কে ধরলে তারা দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫২ শতাংশ। তারপরও দেখা যাচ্ছে, তারাই সবচেয়ে বেশি সামাজিক নিগ্রহের শিকার।
ভারতের মুম্বাই শহরে সম্প্রতি আয়োজিত একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে দলিত সমাজের নিগ্রহ ও নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিটি ছবিতে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন গল্পের বিবরণ। যেখানে দেখা যায় বৈষম্য ও সহিংসতার কারণে পিছিয়ে পড়া এই সমাজের লোকেরা কিভাবে প্রাণ হারিয়েছেন। পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রে তোলা এসব ছবিতে উঠে এসেছে ভারতে লাখ লাখ দলিত মানুষের বাস্তব জীবনের ছবি যা ধরা পড়েছে ফটোগ্রাফার সুধারাক ওলভের ক্যামেরায়।
ভারতে নির্যাতন ও বৈষম্যের হাত থেকে দলিত সদস্যকে রক্ষায় আইন থাকলেও সরকারি হিসাব অনুসারে, শুধু ২০১৬ সালেই তাদের বিরুদ্ধে এ রকম ৪০ হাজারেরও বেশি অপরাধের অভিযোগ পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছে।অতীতে যেসব বিষয়কে কেন্দ্র করে সমাজের উচ্চ বর্ণের সঙ্গে দলিত সমাজের সংঘর্ষ হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে জমিজমা, বেতন ও মজুরি, পানি, বাড়িঘর ইত্যাদি। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে তরুণ দলিত প্রজন্মের মধ্যে আশা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানে এ রকম কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো:
সাগর সেজওয়াল নামের ২৪ বছরের নার্সিং কলেজের এক ছাত্র। দলিত নেতা এবং এই সমাজের আইকন হিসেবে পরিচিত ড. বি আর আম্বেদকারকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ফোনের রিং টোন দেয়ায় তাকে খুন করা হয় নির্মমভাবে। প্রথমে বোতল দিয়ে পিটানো হয়, কিল ও ঘুষি মারা হয়। পুলিশ জানায়, কয়েক ঘণ্টা পরে তারা মৃতদেহ খুঁজে পান একটি মাঠের ভেতরে। ময়না তদন্তে দেখা গেছে, তার শরীরের হাড় বিভিন্ন জায়গায় ভেঙে গেছে। পুলিশের ধারণা, তাকে মাটিতে শুইয়ে শরীরের ওপর মোটরবাইক উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। অভিযুক্ত আট ব্যক্তি পরে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
২০১৪ সালে ড. বি আর আম্বেদকারের জন্মবার্ষিকীতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করায় ২৫ বছর বয়সী মানিক ওদাগেকে স্টিলের রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে বর্ণহিন্দুরা। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পুনা শহরের। মাধুকর ঘাদজেকে হত্যা করা হয় কারণ ৪৮ বছর বয়সী এই ব্যক্তি তার নিজের জমিতে একটি কুয়া খনন করেছিলেন। তার জমির চারপাশে ছিল উচ্চবর্ণের ১২ জন সদস্যের জমি। তারাই তাকে হত্যা করে।
উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সামনে পা উঠিয়ে বসায় খুন, কুয়োয় নামায় ছেলেমেয়েদের নগ্ন করে ঘোরানো হয় গ্রামে। খাদরা গ্রামে ২০১৪ সালের ২৮ এপ্রিলের ১৭ বছর বয়সী কিশোর নিতিন তার স্কুলে উচ্চবর্ণের একটি মেয়ের সঙ্গে কথা বলায় তাকে খুন করে লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। অভিযুক্ত ১৩ জন ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে আদালত থেকে বেকসুর খালাস পায়। তারপর থেকেই নিতিনের পরিবার এই ঘটনার পুনর্বিচারের দাবি জানিয়ে আসছে। ঘোড়ায় চড়ায় গত মার্চ মাসে দলিত তরুণ প্রদীপ রাঠোকে হত্যা করে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা। শুধু উচ্চবর্ণের লোকেদেরই ঘোড়ায় আরোহণের অধিকার আছে। উহাই ব্রাহ্মণ্যবাদী অভিমত।
সম্প্রতি টাইম ম্যাগাজিনকে সমাজবিজ্ঞানী দীপঙ্কর গুপ্ত বলেন, ‘যখনই নিপীড়িত মানুষ তাদের অধিকারের কথা তোলে, তখনই তাদের ওপর এ ধরনের অত্যাচারের ঘটনা ঘটে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে যুক্তরাষ্ট্রে যখন কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়েছিল, তখন তাদের ওপর এ ধরনের নির্যাতন নেমে এসেছিল। এখন ভারতেও দলিতরা যখন ক্রমে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ বাড়াচ্ছে, তাদের ওপর একই ধরনের নির্যাতন হচ্ছে।’
গরুকে কেন্দ্র করে দেশে যে ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটছে তার নিন্দা করে তৃণমূলের সৌগত রায় বলেন ‘এই ধরনের সহিংসতায় ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৬৩ জন নিহত হয়েছে। আমি এই ঘটনায় হিন্দু-মুসলিম’কে আনতে চাই না কিন্তু ৯৭ শতাংশ ঘটনাই ঘটেছে কেন্দ্রে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর। এরমধ্যে ৮৬ শতাংশ ঘটনা ঘটেছে মুসলিমদের ক্ষেত্রে। আমি সরকার পক্ষের সদস্যদের জিজ্ঞাসা করতে চাই যে আপনারা প্রায়ই কংগ্রেস মুক্ত ভারত গঠনের কথা বলে থাকেন, এবার কি মুসলিম মুক্ত ভারত গঠনের কথা ভাবছেন?’ তিনি আরও জানান বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে এই সহিংসতার ঘটনার হার ৫২ শতাংশ।
তাদের শুধু কর্মকাণ্ডই জঙ্গিবাদী নয়। তাদের কথাবার্তাও হিংস্র সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূলের উদ্দেশে বলেছেন, ‘এনকাউন্টার করতে হলে অবশ্যই করব। গুলি আমরা গুনব। আর লাশ তোমরা গুনবে।’ তাদের কথাবার্তা, কর্মপ্রক্রিয়া, চিন্তাপদ্ধতি সবই সাম্প্রদায়িক, নিষ্ঠুর, পৈশাচিক, দানবীয়, বর্বর।
[সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩১ জুলাই ২০১৭/আযাদী বার্তা, কলকাতা ২৪ জুন ২০১৮/সমকাল ২০ আগস্ট ২০১৬/ঢাকা টাইমস, ০৭ মে ২০১৮/বিবিসি বাংলা, ১৯ জুন ২০১৮/প্রথম আলো ৩১ মার্চ ২০১৮/আনন্দবাজার, কলকাতা, ০২ জুন ও ১৫ জুন ২০১৮]