বেদে গুম জঙ্গি সন্ত্রাস
আর্যদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ। চার বেদের মধ্যে ঋগবেদ প্রাচীন। ঋগবেদখানা পড়লে বুঝা যায় যে আর্যরা ছিলো একটা হাঘরে জাত। ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বেদের উৎপত্তি হলেও সমগ্র বেদখানাতে উলঙ্গভাবে প্রকটিত হয়েছে দেবতাদের কাছে, তাদের বৈষয়িক প্রার্থনা- ঋগবেদের ১০ হাজার মন্ত্রের মধ্যে হাজার খানেকেতে শুধু একই কথা বলা হয়েছে- দাও আমাদের শত্রুর ধন দাও, দাও আমাদের শত্রুর সম্পদ, দাও আমাদের শত্রুর গাভী, দাও আমাদের শত্রুর মেয়েছেলে ইত্যাদি। সর্বত্রই বলা হয়েছে- ‘আমার শত্রুকে ধ্বংস কর, তাদের সকল সম্পদ আমাদের দাও, অন্য কাউকে দিও না। কেবল আমাদের মঙ্গল কর।১ বিপরীত সম্প্রদায়ের ধ্বংসই ওদের কাম্য।
ইন্দ্র হলো হিন্দুপুরাণের স্বর্গের দেবতাদের রাজা। আর্যসভ্যতার ইতিহাসবেত্তাদের মতে ইন্দ্র সম্ভবত ভারতে আগত আর্যদের মধ্যে কোন এক রাজা বা পরাক্রান্ত নেতার নাম, যা কালক্রমে দেবতাদের রাজা আখ্যান পেয়েছে হিন্দুধর্মে। ঋকবেদে ইন্দ্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইন্দ্র ঋগেবেদের দেবতাদের মধ্যে প্রধান। দুর্দমনীয় যোদ্ধারূপেই তিনি পরিকল্পিত। অগ্নি এবং পূষা তার ভ্রাতা। তিনি আর্য জাতির রক্ষক, তার জন্য তিনি দস্যুদের বধ করতেও কুণ্ঠিত নন।(ঋগবেদ ৩/৩৪/৯)।২ বহু শত্রুর দমনকারী, বহু বরণীয় ধনের স্বামী ইন্দ্রকে লক্ষ করে গাও। তিনি আমাদের উদ্দেশ্য সাধন করুন, তিনি ধন প্রদান করুন, তিনি স্ত্রী প্রদান করুন, তিনি অন্ন নিয়ে আমাদের নিকটে আগমন করুন।৩ লোভ লালসা, পরধন গ্রাস আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চিরন্তন রীতি।
হে ইন্দ্র! আমাদের রক্ষণার্থে সম্ভোগযোগ্য, জয়শীল, সদা শত্রুবিজয়ী ও প্রভূত ধন দাও। যে ধনদ্বারা (নিযুক্তি সৈন্যদিগের) নিরন্তর মুষ্টিপ্রহার দ্বারা আমরা শত্রুকে নিবারণ করব অথবা তোমার দ্বারা রক্ষিত হয়ে অশ্ব দ্বারা শত্রুকে নিবারণ করব। হে ইন্দ্র! তোমার দ্বারা রক্ষিত হয়ে আমরা কঠিন অস্ত্র ধারণ করি, যুদ্ধে স্পর্ধাযুক্ত শত্রুকে জয় করব। হে ইন্দ্র! তোমার সহায়তায় আমরা বীর অস্ত্রধারীদের সাথে সৈন্যসজ্জাযুক্ত শত্রুকেও পরাভব করতে পার। ইন্দ্র মহৎ এবং সর্বোৎকৃষ্ট, বজ্রধারী ইন্দ্রে মহত্ত্ব অবস্থিতি করুক; তাঁর সৈন্য আকাশের ন্যায় প্রভূত। যে পুরুষেরা সংগ্রামে লিপ্ত হন অথবা পুত্র লাভ ইচ্ছা করেন অথবা যে বিজ্ঞ লোকেরা জ্ঞানাকাক্সক্ষায় থাকেন (তাঁরা সকলেই ইন্দ্রের স্তুতি দ্বারা সিদ্ধি লাভ করেন)।৪ আজও তাদের দানবীয় প্রবৃত্তি আগের মতই আছে।
ঘোড়াই আর্যদের সম্বল ছিলো, তারা সিন্ধু সভ্যতার বাহকদের কাছ থেকে গাভী চুরি করে এনেছিল। দূতী সরমাকে পাঠিয়ে তারা এর সন্ধান করেছিল। তারপর তারা গুহার মধ্যে রক্ষিত গাভীসমূহ অপহরণ করেছিল। (ঋগবেদ- ১/৬/৫)। তারা প্রার্থনা করত, হে ইন্দ্র! শত্রু বধকালে এ উভয় জগৎ তোমাকে ধারণ করতে পারে না, তুমি স্বর্গীয় জল জয় কর, আমাদের সম্যকরূপী গাভী প্রেরণ কর। (ঋগবেদ- ১/১০/৮)। গাভী লাভার্থে ইন্দ্র সিন্ধু সভ্যতার বাহকদের নগরসমূহ বিদীর্ণ করেছিল। (ঋগবেদ- ১/৫৩/৭, ৪/২৬/৩)। সেজন্য ইন্দ্রের নাম হয়েছিল ‘পুরন্দর’। একমাত্র সিন্ধু সভ্যতার বাহকরাই নগরে বাস করত। আর্যরা বাস করত গ্রামে; কেননা, তাদের সমাজ ও সংস্কৃতি ছিলো গ্রামীণ।৫ সোমরসে তুষ্ট ইন্দ্রের সাহায্যে আমরা দস্যুকে ধ্বংস করব এবং শত্রু হতে মুক্তি লাভ করে সম্যকরূপে অন্ন ভোগ করব। (ঋগবেদ- ১/৫৩/৪)। ৬ এখানে দস্যু ও শত্রু বলতে ভারতবর্ষের আদিবাসীদের বুঝানো হয়েছে।
হে ইন্দ্র! তুমি শত্রুবর্ষণকারীরূপে যুদ্ধ হতে যুদ্ধান্তরে গমন কর, বলদ্বারা নগরের পর নগর ধ্বংস কর। হে ইন্দ্র! তুমি নথী ঋষির সহায়ে দূরদেশে মনুচি নামক মায়াবীকে বধু করেছিলে। তুমি অতিথিগ¦ নামক রাজার জন্য করঞ্জ ও পর্ণর নামক শত্রুদ্বয়কে তেজস্বী বর্তনী দ্বারা বধ করেছে; তারপর তুমি অনুচর রহিত হয়ে ঋজিশ্বান নামক রাজার দ্বারা চারদিকে বেষ্টিত বঙ্গৃদ নামক শত্রুর শত নগর ভেদ করেছিলে। সহায় রহিত সুশ্রবা নামক রাজার সাথে যুদ্ধ করবার জন্য যে বিংশ নরপতি ও ৬০,০৯৯ অনুচর এসেছিল, হে প্রসিদ্ধ ইন্দ্র! তুমি শত্রুদের অলঙ্ঘ্য রথচক্র দ্বারা তাদের পরাজিত করেছিলে। (ঋগবেদ- ১/৫৩/৭-৯)। ৭
আর্যরা মনে করে এ পৃথিবী তাদের। কারণ ‘আমি আর্যকে পৃথিবী দান করেছি (ঋগবেদ- ৪/২৬/২)। ৮ অন্য কারও এ ধরাতে বসবাসের অধিকার নেই। অতএব অন্য সকল অধিবাসীকে নির্মুল করতে হবে। অপর জাতি ও সম্প্রদায়ের শক্তি খর্ব করতে হবে, তাদের ধনসম্পদ আত্মসাৎ করতে হবে। এই হলো হিন্দু মনমানসিকতা।
হে মনুষ্যগণ! যিনি দ্যোতমান, যিনি জন্ম গ্রহণ মাত্রেই দেবগণের প্রধান—যুদ্ধকালে শত্রুগণকে বিনাশ করেন, তিনিই ইন্দ্র (ঋগবেদ- ২/১২/১-৩)।৯ হে মনুষ্যগণ! যিনি এ সমস্ত নশ^র বিশ^ নির্মাণ করেছেন, যিনি দাসবর্ণকে নিকৃষ্ট এবং গুঢ়স্থানে অবস্থাপিত করেছেন, যিনি লক্ষ্য জয় করে ব্যাধের ন্যায় শত্রুর সমস্ত ধন গ্রহণ করেন, তিনিই ইন্দ্র (ঋগবেদ- ২/১২/৪)।১০ হে মনুষ্যগণ! যিনি বজ্রদ্বারা বহুসংখ্যক মহাপাপী অপূজককে বিনাশ করেছেন, যিনি গর্বকারী মনুষ্যকে সিদ্ধি প্রদান করেন না, যিনি দস্যুগণের হন্তা, তিনিই ইন্দ্র। —যিনি বল প্রকাশকারী অহিনামক শয়ান দানবকে বিনাশ করেছিলেন, তিনিই ইন্দ্র।— যিনি বজ্রবাহু হয়ে স্বর্গারোহণ্যেদ্যত রৌহিণকে বিনাশ করেছিলেন, তিনিই ইন্দ্র (ঋগবেদ- ২/১২/১০-১২)।১১ এদেশের প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীর পরাজয়ে ওরা ইন্দ্রের জয়গান করছে। মিথ্যার জয়গানই ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কীর্তি।
Source :
১. ড. অতুল সুর: হিন্দু সভ্যতার বনিয়াদ, কলিকাতা ৯, প্রথম প্রকাশ জুন ১৯৯১, পৃ ৩৬
২. উইকিপিডিয়া/ ঋগে¦দ-সংহিতা[ প্রথম খ-], পৃ ৪৩, ৩২৮
৩. ঋগবেদ- ১/৫/২-৩, ঋগে¦দ-সংহিতা [ প্রথম খ-], হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রিট মার্কেট, কলকাতা ৭, পৃ ৬২
৪. ঋগবেদ- ১/৮/১-৬, ঋগে¦দ-সংহিতা [ প্রথম খ-], হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রিট মার্কেট, কলকাতা ৭, পৃ ৬৪-৬৫
৫. ড. অতুল সুর: হিন্দু সভ্যতার বুনিয়াদ, পৃ ৩৭; = ঋগে¦দ-সংহিতা [প্রথম খ-], হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রিট মার্কেট, কলকাতা ৭, পরিমার্জিত সংস্করণ ২০০৪, পৃ ৬৩, ৬৬, ১১২, ৩৮২, ৪৭
৬. ঋগে¦দ-সংহিতা [ প্রথম খ-], হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রিট মার্কেট, কলকাতা ৭, পরিমার্জিত সংস্করণ ২০০৪, পৃ ১১২
৭. ওই, পৃ ১১২
৮. ওই, পৃ ৩৮২
৯. ওই, পৃ ২৬৫
১১. ওই, পৃ ২৬৫
১১. ওই, পৃ ২৬৫