মুক্তবুলি ডেস্ক
বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষা উপকূলের অনেক জায়গায় গোলগাছ জন্মায়। নোনা জল ছাড়া জন্ম হয় না গোল গাছ। নোনা জলে জন্ম হলেও বেশ মিষ্টি তার গুড়। এসব এলাকার নোনা গোলের মিঠা গুড় ভারতেও যায়। নানা প্রয়োজনে ব্যবহার হয় গোলগাছ।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল জেলাগুলোর খাল-বিল-নদীতে জন্ম নেয় গোলগাছ। উপকূলের অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারের ঘরের চালা-বেড়া সবই তৈরি হয় গোলপাতায়। শহুরে পার্কের বসার ঘরের ছাউনিতে কিংবা ধনীর ছাদে বাগানের শৌখিন বৌঠকখানার চালায় গোলপাতা ইদানিংকাল বেশ নান্দনিক ও শোভাবর্ধক হিসেবে সমাদরে শোভা পাচ্ছে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে গোলপাতা পরিচিত উদ্ভিদ। যদিও স্থানীয়ভাবে একে ‘গোল’ বা ‘গোলগাছ’ বলা হয়। যারা দেখেননি তাদের ধারণা হতে পারে এই গাছের পাতা হয়তো গোলাকৃতির। কিন্তু তা নয়। নামে গোলপাতা হলেও এর পাতাগুলো তিন থেকে নয় মিটার অবধি লম্বা হয়। ঠিক দুই তিন বছরের নারকেল গাছের মতোই এর আকৃতি। গোলগাছের কান্ড ছোট এবং কান্ডের সঙ্গে অনেক শেকড় বিদ্যমান থাকে।
বাংলাদেশে সাধারণত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে গোলপাতা বেশি কাটা হয়। সরেজমিনে উপকূলীয় একাধিক বাজার ঘুরে দেখা যায়, গোলপাতার অনেক চাহিদা। চাহিদা-যোগান ও বাজারভেদে প্রতি শ’ (১০০ গোলপাতা) বিক্রি হয় প্রায় ৫০০-৬০০ টাকায়। আবার স্থানভেদে পোন প্রতি ৪০০-৪৫০ টাকা হিসেবেও বিক্রি হয় গোলপাতা (এক পোনে ৮০ ডাটি পাতা থাকে)।
গোলপাতা শুধুই মাথা গোজার ঠাঁই করে দেয় তা নয়, বরং উপকূলীয় পরিবেশ রক্ষায় গোলপাতার আছে বিশেষ অবদান। উপকূলের জীবন ও জনপদে গোলগাছ জন্ম নেয় একটি অর্থকারী আর্শীবাদ হিসেবে।
বাংলাদেশের অনেক জেলার বিভিন্ন উপজেলায় গোলপাতা জন্মাতে দেখা যায়। উপকূলীয় জেলাগুলোর নদী তীরবর্তী অঞ্চল যেমন বরগুনার পাথরঘাটা, তালতলি, বরগুনা সদর উপজেলা; পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া, রাঙাবালি, গলাচিপা; ভোলার সদর উপজেলা, মনপুরা, চরফ্যাশন; ঝালকাঠির নলছিটি, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, মংলা, খুলনা অঞ্চলে গোলপাতা মোটমুটি চোখে পরে। তবে সুন্দরবনে প্রচুর পরিমাণ গোলপাতা জন্মে।
প্রতি বছর গোলপাতার মৌসুমে সুন্দরবন থেকে গোলপাতা সংগ্রহ, পরিবহন ও বিক্রিতে জড়িত হয় প্রায় ৪০০ বাওয়ালি ও তাদের পরিবার। এ কাজের দ্বারা এসব পরিবারগুলো যেমন আর্থিকভাবে সাবলম্বী হচ্ছে তেমনি আয় বাড়ছে সরকারের রাজস্ব খাতের।
এই গাছ থেকে খেজুর গাছের মতোই শীত মৌসুমে রস পাওয়া যায়। এই রস দিয়ে তৈরি হয় গুড়। যেটি স্থানীয়ভাবে ‘গোলের গুড়’ নামে পরিচিত। নোনা পানিতে গোলপাতার জন্ম ও বিস্তার হলেও এর রস খেতে খুবই মিষ্টি স্বাদের। সুস্বাদু এই গুড়ের চাহিদাও অনেক। বছরের পৌষ থেকে ফাল্গুন মাস অবধি রস সংগ্রহ চলে। গোলপাতার গুড়ের কেজিপ্রতি বাজার মূল্য প্রায় ৮০-৯০ টাকা।
গোলগাছের রসে রয়েছে নানা খাদ্য উপাদান, যেমন শর্করা (১৪-১৮%)। গোলগাছের রস মানবদেহের পানিশূন্যতা পূরণ, পেটের কৃমি দমন, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিসহ নানা উপকারে আসে।
গোলের ফলের ভেতরে তালের আটির মতো যে নরম অংশ থাকে তা মজাদার খাবার হিসেবে গ্রামীণ জনপদে ব্যাপক সমাদৃত। মরে বা শুকিয়ে যাওয়া গোলগাছের সকল অংশ রান্নার জন্য ব্যবহার হয়।
গোলপাতা একটি প্রকৃতিনির্ভর পাম জাতীয় উদ্ভিদ। গোলপাতার ইংরেজি প্রতিশব্দ nipa palm, বৈজ্ঞানিক নাম Nypa fruticans। এই ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদটি নদী-খালের কাদামাটি আর পানিতে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয়। তবে গোলপাতার বীজ রোপণ করেও গোলপাতা চাষ করা যায়। চাষের ক্ষেত্রে অবশ্য বীজ (স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় এই বীজের নাম গাবনা) বপন ছাড়া বাকি সব কিছুই প্রকৃতি নির্ভর।
গোলগাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত কাদা-পানির প্রবাহ না থাকলে এই গাছের জন্ম ও স্বাভাবিক বৃদ্ধি সম্ভব নয়। তাই যারা আর্থিক প্রয়োজনে গোলপাতা চাষ করে তারা মূলত নদী-খালকেই আবাদস্থল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।
নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা চিন্তা করে সরকারি ও সামাজিক বনায়নের উদ্যোগে গোলগাছকে প্রাধান্য দেয়া উচিৎ বলে মনে করছেন পরিবেশবিদগণ। অপরদিকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদী তটরেখায় গোলগাছ রোপণ ও এর বাগান সৃষ্টি করা হলে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি উপকূলীয় নদীকেন্দ্রীক জনপদগুলোতে গোলপাতা কিংবা গোলের রস হতে পারে দারিদ্র বিমোচন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের অন্যতম একটি হাতিয়ার।