জাদুঘর- ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বাহক

কামাল উদ্দিন তুহিন

বাংলায় ‘জাদুঘর’ কথাটি আরবি “আজায়ব্ ঘর” শব্দটির সঙ্গে তুলনীয়। বাংলায় ‘জাদুঘর’ কথাটির অর্থ হল, ‘যে গৃহে অদ্ভুত অদ্ভুত পদার্থসমূহের সংগ্রহ আছে এবং যা দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হতে হয়’। আকাদেমি বিদ্যার্থী বাংলা অভিধান মতে, ‘জাদুঘর’ শব্দের অর্থ, ‘যে-ঘরে নানা অত্যাশ্চর্য জিনিস বা প্রাচীন জিনিস সংরক্ষিত থাকে’। যদিও বাংলা জাদুঘর নামকরণ নিয়ে ছিল নানা ধরেণর মত বিরোধ।  ঢাকায় যখন জাতীয় জাদুঘরের প্রথম ভবন তৈরি হয়, এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন  করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর আবদুল মোনায়েম খান। তিনি এই জাদুঘর শব্দের ঘোর বিরোধী ছিলেন কারণ জাদুঘরে আল্লাহর পবিত্র কালাম কোরআন রাখা আছে, তা কি জাদু? এই প্রশ্নে। পরে অবশ্য এই প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বিস্ময় জাগানিয়া অর্থে জাদুঘর নামকরণের কথা বলেন।

ইংরেজি museum (মিউজিয়াম) শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ থেকে। ইংরেজি বহুবচনে এই শব্দের রূপটি হল museums (বা অপ্রচলিত শব্দ, musea)। শব্দটির মূল উৎস গ্রিক শব্দ Μουσεῖον (Mouseion); যার অর্থ গ্রিক পুরাণের শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক মিউজদের মন্দির।  প্রাচীন গ্রিসে এই জাতীয় মন্দিরগুলিকে কেন্দ্র করে পাঠাগার ও শিল্প পুরাকীর্তির সংগ্রহশালাও গড়ে উঠতে দেখা যেত। ২৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রথম জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর এই প্রথম জাদুঘরে ছিলো নিদর্শন-সংগ্রহশালা ও লাইব্রেরি, ছিল উদ্ভিদউদ্যান ও উম্মুক্ত চিড়িয়াখানা । তবে এটা ছিল মূলত দর্শন চর্চার কেন্দ্র। তখন আসলে কি ধারণা থেকে জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয় এটি মূলত প্রতিষ্ঠাতার পছন্দ অনুযায়ী তৈরি হয়েছিল এবং যারা দেখতে যেতেন তারা তাদের পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন অংশে অথবা কেউ সব অংশেই দেখতে যেতেন৷ পরে অবশ্য অনেক জাদুঘরই প্রতিষ্ঠিত হয়।  সেখানে রাজা বা ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, তাদের ক্ষমতার নিদর্শন সংগ্রহ করতেন। সেগুলোতে অবশ্য সর্বসাধারণ প্রবেশ করতে পারত না। সতেরো শতকে প্রথম পাবলিক মিউজিয়াম গড়ে ওঠে ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অ্যাশমোলিয়ান মিউজিয়াম’। এরপরে আঠারো শতকে রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় তৈরি হয় ব্রিটিশ মিউজিয়াম। তখনো আসলে এসব জাদুঘর ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্পন্ন ব্যক্তিদের দখলে।  পরে অবশ্য রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের ফলে এগুলো তাদের সংগ্রহশালা থেকে বের হতে থাকে।  জাদুঘরের সংখ্যা বাড়তে থাকে উনিশ শতকে৷ বিশ শতকে শিল্পোন্নতি ও উপনিবেশবাদের অবসানের পরে প্রায় সব স্বাধীন দেশ তাদের ইতিহাস -ঐতিহ্য সংরক্ষণের কাজ হাতে নেয় এবং জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে। আমাদের দেশেও এখন অনেক জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে – জাতীয় জাদুঘর, চট্টগ্রামের জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর, ঢাকার নগর জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, বিজ্ঞান জাদুঘর, সামরিক জাদুঘর। অসংখ্য প্রতিষ্ঠিত -অপ্রতিষ্ঠিত  জাদুঘর রয়েছে এখন আমাদের দেশে।
জাদুঘরের মাধ্যমে মানুষ শুধু ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে জানেনা, তারা তাদের আত্মপরিচয় লাভ করে। সেখানে মানুষ তার নিজের জাতির স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে, সংস্কৃতির সন্ধান পায়, আত্মবিকাশের প্রেরণা লাভ করে। সেখানে মানুষ সামাজিক, পারিবারিক এবং ধর্মীয় অনুভূতির শিক্ষা পায়।
ইসলামের প্রচার-প্রসারে জাদুঘরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ইসলামী ইতিহাসের সমৃদ্ধ অধ্যায় মানুষের সামনে তুলে ধরতে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেক সমৃদ্ধ ইসলামী জাদুঘর। এর মধ্যে  উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে-
দ্যা মিউজিয়াম অব ইসলামিক আর্ট
কাতারের রাজধানী দোহায় অবস্থিত ‘দ্য মিউজিয়াম অব ইসলামিক আর্ট’কে বলা হয় সবচেয়ে আধুনিক ইসলামী জাদুঘর। প্রতিবছর পাঁচ লাখ মানুষ কাতারের জনপ্রিয় এই জাদুঘরটি পরিদর্শন করে। ৪৫ হাজার বর্গমিটারের বিশাল পাঁচতলা জাদুঘরের অভ্যন্তরে জায়গা হচ্ছে প্রায় চার লাখ স্কয়ার ফিট। জাদুঘরে আরব ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র, শিলালিপি, তৈজসপত্র, গহনা, অস্ত্র, বইয়ের পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত রয়েছে। ইসলামী ইতিহাসের বিভিন্ন যুগ অনুযায়ী আলাদা গ্যালারিতে ভাগ করা হয়েছে। ইসলামের প্রথম যুগের জন্য রয়েছে আলাদা শিল্প গ্যালারি। জাদুঘরে স্থান পাওয়া সামগ্রীর ভেতর ধাতব বস্তু, কারুশিল্প সামগ্রী, কার্পেট, পাথর, সিরামিক পণ্য, কোরআনের দুর্লভ পাণ্ডুলিপি, মুদ্রা, জুয়েলারি, অস্ত্র, কয়েন, কাচের জিনিসসহ ইসলামীশিল্পের নানা নিদর্শন। জাদুঘর ভবনেই একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি স্থাপন করা হয়েছে। যাতে আরবি ও ইংরেজি ভাষার দেড় লাখের বেশি বই রয়েছে। এবং প্রায় ২০০ বিরল বই রয়েছে, যা আর কোথাও পাওয়া যাবে না।

জেরুজালেম জাদুঘর
জেরুজালেমে রয়েছে ইসলামি জাদুঘর। ঐতিহাসিক আল আকসা মসজিদের সন্নিকটেই অবস্থিত এই ইসলামী জাদুঘর।১৯২২ সালে আল আকসা মসজিদে সংরক্ষিত প্রাচীন নিদর্শনাবলি নিয়ে যাত্রা শুরু করে জাদুঘরটি। পরবর্তী সময়ে জেরুজালেম ও ফিলিস্তিনের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের সাক্ষী অনেক নিদর্শন ও স্মারক উপহার হিসেবে পায় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। কোরআনের প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, আকসায় ব্যবহৃত বিভিন্ন আসবাব, অত্র অঞ্চলের বিশিষ্ট ব্যক্তির স্মৃতিচিহ্ন, প্রাচীন মুদ্রা ও তৈজসপত্র ইত্যাদি স্থান পেয়েছে জাদুঘরটিতে। ইসলামী শাসনের স্বর্ণযুগের দুর্লভ ও হাজার বছরের প্রাচীন অনেক নিদর্শন রয়েছে জেরুজালেম ইসলামী জাদুঘরে। উত্তর আফ্রিকা, মিসর, সিরিয়া, তুরস্ক, ইরান, পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশ থেকে এসব নিদর্শন ও স্মারক সংগ্রহ করা হয়েছে। এখানে রয়েছে উমাইয়া আমলের কাঠের সেট, ১৯৬৯ সালে ইসরায়েলের দেওয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া নূর আল দ্বিন মিম্বরের ধ্বংসাবশেষ, মামলুক আমলের মূল্যবান নথিপত্র (প্রায় এক হাজার), ধাতব, মার্বেল ও টাইলস। এ ছাড়া রয়েছে কুফি, নকশি ও থোলথ আরবি লিপির একাধিক ক্যালিগ্রাফি। দুর্লভ ও ঐতিহাসিক কোরআনের সমৃদ্ধ সংগ্রহ জেরুজালেম ইসলামী জাদুঘরের গর্বের বিষয়। এখানে রয়েছে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত হুসাইন (রা.) ও হাসসান (রহ.)-এর কোরআনের ব্যক্তি কপিটি। এ ছাড়াও সুলতান সোলায়মান আল কানুনি, সুলতান বায়েজিদ, সুলতান বার্সবি ও মরক্কোর বাদশার স্মৃতিবাহী কোরআনের কপি রয়েছে এই জাদুঘরে, যা তাঁরা মসজিদুল আকসায় উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন।

আল হায়াত মিউজিয়াম
বিশ্বের ইসলামী জাদুঘরগুলোর ভেতর বিশেষ মর্যাদার দাবিদার বাহরাইনের কোরআন জাদুঘর ‘আল হায়াত মিউজিয়াম’। দুষ্প্রাপ্য সব কোরআনের কপি ও কোরআন সংশ্লিষ্ট বিষয় দিয়ে সাজানো এই জাদুঘরটি।
ইউরোপের অন্যতম সমৃদ্ধ জাদুঘর বার্লিন পারগামুন মিউজিয়াম। বার্লিনে অবস্থিত ইসলামিক জাদুঘরে স্পেনের বিখ্যাত আল হামরা প্রাসাদসহ মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার প্রতিলিপি স্থান পেয়েছে।  ইসলামিক জাদুঘরে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার। যেখানে ইসলামী শিল্পকলা ও প্রত্নতত্ত্ববিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বই রয়েছে। মাঝেমধ্যে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ইসলামী চিত্রকলার বিশেষ প্রদর্শনীরও আয়োজন করে।

দ্য ইসলামিক আর্টস মিউজিয়াম’
দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ ইসলামী জাদুঘরের গর্বিত মালিক মালয়েশিয়া। ‘দ্য ইসলামিক আর্টস মিউজিয়াম’টি রাজধানী কুয়ালালামপুরে অবিস্থত। ১২টি প্রদর্শনকক্ষে প্রায় সাত হাজার স্মারক ও নিদর্শন রয়েছে। যার মধ্যে হাতে লেখা কোরআন, ইসলামী স্থাপত্যের প্রতিরূপ, গহনা, চীনা মাটি, কাচের পাত্র, বস্ত্র, অস্ত্র, বর্ম ইত্যাদি।

ইসলামিক মিউজিয়াম অব অস্ট্রেলিয়া
ইসলামিক মিউজিয়াম অব অস্ট্রেলিয়া প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১০ সালে। এটাই অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম ইসলামী জাদুঘর। অস্ট্রেলীয় সমাজে মুসলমানের ভূমিকা তুলে ধরাই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। স্থানীয় মুসলিম সংস্কৃতি তুলে ধরার পাশাপাশি দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মুসলিম শিল্পীদের সহযোগিতা করা জাদুঘরের অন্যতম লক্ষ্য। মুসলিম শিল্পীদের শিল্পকর্ম প্রদর্শনের জন্য জাদুঘরে স্থাপন করা হয়েছে অস্থায়ী গ্যালারি। জাদুঘরের স্থায়ী গ্যালারিতে রয়েছে মূল্যবান ও চমৎকার সব শিল্পকর্ম।

কায়রো ইসলামী জাদুঘর
পিরামিড ও জাদুঘরের দেশও বলা হয় দেশটিকে। মিসরের পিরামিড ও জাদুঘরের প্রতি আগ্রহ রয়েছে বিশ্বের ভ্রমণপ্রেমী মানুষের। এই মিসরেই রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন, বৃহৎ ও সমৃদ্ধ ইসলামী জাদুঘর। ইসলামী ইতিহাসের সাক্ষী লক্ষাধিক নিদর্শন রয়েছে এখানে। মিসর ও আরব ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র, শিলালিপি, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং বিচিত্র সব নিদর্শনে সমৃদ্ধ জাদুঘর।
প্রদর্শিত স্মারকের মধ্যে ধাতব বস্তু, কারুশিল্প সামগ্রী, কার্পেট, পাথর, সিরামিক পণ্য, কোরআনের দুর্লভ পাণ্ডুলিপি, মুদ্রা, জুয়েলারি, অস্ত্র, মসজিদের মিহরাব প্রভৃতি অন্যতম। এ ছাড়া রয়েছে দুর্লভ পাণ্ডুলিপি, বইয়ের কপি, চিত্রকলা, ধাতু ও চীনা মাটির তৈজসপত্র, গহনা, অস্ত্র, হাতির দাঁতের জিনিস। বর্তমানে জাদুঘরের সংগ্রহে রয়েছে প্রায় দেড় লাখ মূল্যবান সম্পদ। রয়েছে ২৫টি জাদুঘরের হল।

মক্কা মিউজিয়াম
সৌদি আরবের মক্কার মানাফিয়া অঞ্চলে ‘মক্কা মিউজিয়াম’ নামে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইসলামি জাদুঘর নির্মাণ করা হচ্ছে।
জাদুঘরটি নির্মাণে সেরা নির্মাণ সরঞ্জাম এবং সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। আন্তর্জাতিক মানের এ জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হলে- এটা হবে পর্যটক ও মুসলিম ইতিহাস প্রেমীদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণের স্থান। এখানে এসে পর্যটকরা ইসলামের ইতিহাস, নতুন অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রম উপভোগ করতে পারবেন।
সৌদি সরকারের পরিকল্পনায় রয়েছে, এই জাদুঘরে মূল্যবান ঐতিহাসিক বস্তু এবং প্রাচীন ইসলামি যুগের জিনিস সংগ্রহ করে উপস্থাপন করা হবে। আশা করা হচ্ছে, জাদুঘরটি ইতিহাসপ্রিয়, বিজ্ঞান গবেষক, মুসলিম পণ্ডিত, সুস্থ ইসলামি চিন্তাধারার লালনকারী ও ইসলামি সংস্কৃতির অনুসারীদের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হবে।

তথসূত্র:

১. উইকিপিডিয়া,  জাদুঘর ও ইসলামিক জাদুঘর

২. দৈনিক কালের কন্ঠ- দেশে দেশে ইসলামী জাদুঘর ২০ আগস্ট ২০১৯

৩. ‘ঐতিহ্যায়ন- ২০০৩’ –

কামাল উদ্দিন তুহিন 

শিক্ষার্থী, এ্যানিমেল সায়েন্স অ্যান্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

৫ comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *