মুক্তবুলির জন্য আমাদের পিরোজপুর সফর

রিয়াজ পাটওয়ারী ।।
১৪ আগস্ট, রবিবার। ‘মুক্তবুলি’র সম্পাদক ও প্রকাশক আযাদ আলাউদ্দীন ভাইয়ের সাথে পিরোজপুর সফরের দিন ধার্য্য ছিল পূর্বনির্ধারিত। সকাল ৮টায় যাত্রা শুরুর কথা থাকলেও বৈরি আবহাওয়ার কারণে যাত্রা শুরু করতে হয়েছে সাড়ে ১০টায়। ১৩ আগস্ট রাত থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি। পানিতে পরিপূর্ণ ছিল বরিশাল নগরীর বিভিন্ন সড়ক। এর আগে কোন দিন যাওয়া হয়নি পিরোজপুরে। অ্যাডভেঞ্চারের আশায় মনের ভিতর শুরু হয়েছে ছটফট। অবশেষে সব উপেক্ষা করে হালকা বৃষ্টির ভিতরই রওনা দিলাম। রূপাতলী পৌছা মাত্রই শুরু হয়েছে ঝুম বৃষ্টি। বাংলাদেশ বেতার বরিশাল কার্যালয়ের সামনে একটি দোকানে চা খেতে খেতে বৃষ্টি উপভোগ করলাম। আযাদ আলাউদ্দীন ভাইয়ের ব্যক্তিগত কাজ থাকার কারণে বৃষ্টি কমলে চলে যাই বেতার কার্যালয়ে। কাজ ছিলো ৯/১০ মিনিটের, সেখানে পৌছে পড়ি আরেক ঝামেলায়! বৃষ্টির পানিতে বেতার কার্যালয়ের বাউন্ডারীর ভিতর জমেছে হাটু পরিমাণ পানি, তাই মোটরসাইকেল ব্রেক করার মতো উপায় ছিলোনা! অনেক কষ্ট করে বাউন্ডারির একপাশে গিয়ে গাড়ীটি ব্রেক করলেও জুতা না ভিজিয়ে নামা সম্ভব হয়নি।
বেতার কার্যালয়ে পৌছার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফের শুরু হয় পুরো দমে বৃষ্টি। প্রায় দেড় ঘন্টা পর কিছুটা কমলে শেষ হয় আমাদের যাত্রাবিরতি। হালকা হালকা বৃষ্টিতেই পুরো ভিজার কারণে ঝালকাঠিতে যাত্রা বিরতি দেয়া হয়। ফের বাড়ে বৃষ্টি, ঝালকাঠিতে জোহরের নামাজ আদায় ও দুপুরের খাবার শেষ করে বসে ছিলাম বৃষ্টি কমার আশায়। ঝালকাঠি সদর রোডের সিটি লাইব্রেরিতে নিয়মিত রাখা হয় মুক্তবুলি ম্যাগাজিন, সেটিও সেদিন ছিলো বন্ধ। পরে ঝালকাঠির লেখক নজরুল ইসলামের কাছে মুক্তবুলি ম্যাগাজিনের ১০টি কপি রেখে আসি। তিনি পরদিন সেগুলো সিটি লাইব্রেরিতে পৌঁছে দেন। এদিকে বৃষ্টি কমার সম্ভাবনা না থাকায় পিরোজপুরের যাত্রা বাতিল করে ভিজে ভিজে বরিশাল চলে আসি আমরা, যে যার বাসায় চলে যাই। ফের নির্ধারণ করা হয় পিরোজপুর সফরের তারিখ।
১৭ আগস্ট বুধবার সকাল সাড়ে ১১টায় বরিশাল থেকে যাত্রা শুরু করি, আবহাওয়া ছিল প্রচন্ড গরম। নগরীর রূপাতলী হাট সুপারশপের ‘সুন্নাহ কর্নারে’ বিক্রয়ের জন্য মুক্তবুলি ম্যাগাজিন ও মহানবি হযরত মুহম্মদ (স.) বইগুলো জমা দেই। কালিজিরা ব্রিজ সংলগ্ন একটি পাম্প থেকে ফুয়েল নিয়ে সাড়ে ১২টায় শুরু হয় আমাদের যাত্রা, বেলা দেড়টায় আমরা পৌছি বেকুটিয়া ফেরিঘাটে।
ফেরিঘাটে চোখে পড়ে পরিচিত খাবারের অপরিচিত এক রূপ ‘লাল কলা’। যার ভেতরটা বাদামি রঙ্গের, হালি ৫০ টাকা। ব্যতিক্রম দেখে উৎসাহে খেলাম সেই কলা, ভালোই লাগলো। ফেরিঘাটের খাবার পছন্দ হয়নি তাই হালকা নাস্তা করে ফেরির অপেক্ষা না করে ট্রলার যোগে কঁচা নদী পাড়ী দেই। ট্রলার ভাড়ার কথা জিঙ্গেস করে পেয়েছি আরেকটা চমক। মটরসাইকেলের প্রতি ভাড়া ৫০ টাকা সাথে ড্রাইভার ফ্রি (ড্রাইভারের ভাড়া নেয়া হয়না) ও অপরজানের ২০ টাকা, মোট ৭০ টাকা। স্রোতের কারণে অনেক দূর ঘুরে দীর্ঘ ১৬ মিনিট পর ২১জন যাত্রী ও ৪টি মটর সাইকেল নিয়ে অপরপ্রান্তে পৌছে ট্রলার।
ট্রলার থেকে নেমে দীর্ঘ ৭ কিলোমিটার গিয়ে পৌছি পিরোজপুর সিইও অফিস মোড়। স্থানীয়রা বলেছেন চৌরাস্তা মোড়ের খুব নিকটে সিইও অফিস হওয়ায় এর নামকরণ করা হয়েছে সিইও অফিস মোড়। স্থানীয় কয়েকজনের কাছে জিঙ্গেস করে আমরা পৌঁছি জেলা পরিষদ মার্কেটে অবস্থিত হোসাইনিয়া লাইব্রেরিতে। সেখানে গত ৪ বছর যাবত বরিশাল থেকে কুরিয়ারের মাধ্যমে মুক্তবুলি ম্যাগাজিন প্রেরণ ও বিক্রি করা হয়। কিন্তু আমরা কেউই একে অপরের পূর্ব পরিচিত নই। এই সফরের মাধ্যমেই হলো আমাদের পারস্পরিক পরিচয়। সেখানে শুরু হয় চা চক্র। দেখা হয় অধ্যাপক সোহরাব হোসেন জুয়েলের সঙ্গে। তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত গীতিকার, লেখক ও সাংবাদিক।

সেখানে আমাদেরকে রিসিভ করতে আসেন মুক্তবুলির পিরোজপুরের সমন্বয়ক অনির্বাণ চক্রবর্তী। হালকা পাতলা শ্যামলা প্রকৃতির মানুষ হলেও তার মনটা অনেক বড় এবং খুবই আন্তরিক তিনি। পিরোজপুর সদরে অবস্থিত একটি খাবার হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে বের হই। চা পান করে যাই অনির্বাণ চক্রবর্তী দাদার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাণী বিপণীতে। সেখানে তাকে মুক্তবুলির নতুন কপি দেয়া শেষে শুরু হয় সাহিত্য ও বইয়ের আড্ডা। প্রায় ১০ মিনিট পর আমাদের সাথে যুক্ত হন অনির্বাণ দাদার আত্মীয় জীবন চক্রবর্তী। তিনিও খুব আন্তরিক মানুষ।
বিকাল সাড়ে ৩টায় পিরোজপুরের কবি সাহিত্যিক ও লেখকদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা ও আবৃত্তি অনুষ্ঠান। হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট’র সহকারী পরিচালক প্রিয়াংকা সিকদার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পিরোজপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মাধবী রায়। বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন বরিশাল মেট্রোপলিটন কলেজের চেয়ারম্যান এবং মুক্তবুলি ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক আযাদ আলাউদ্দীন। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাহিত্য শৈলীর সম্পাদক কবি প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাস, প্রবীণ কবি দেলোয়ার হোসেন আলম, কবি সন্তোষ কুমার শীল, কবি সমর কৃষ্ণ হালদার, কবি দেবনাথ মন্ডল, ‘করোনা পদাবলি’ রচয়িতা কবি সঞ্জয় কুমার রায়, তরুণ কবি আরিফুল ইসলাম, মাসুম খান, অনির্বাণ চক্রবর্তী প্রমুখ। শিল্পীদের গান এবং কবিদের আবৃত্তিতে প্রাণবন্ত হয় পুরো অনুষ্ঠান।
সন্ধ্যায় সিইও অফিস মোড়ে কবিদের নিয়ে শুরু হয় চা চক্র। সময় সল্পতার কারণে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে আমরা রওনা দেই বরিশালের উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার ফেরিতে উঠি, আসার সময় আমাদের সাথে আরেকজন সফর সঙ্গী যোগ হয়েছেন, তিনি অনির্বাণ দাদার আত্মীয় জীবন চক্রবর্তী, বরিশালেই থাকেন তিনি। ফেরি থেকে নেমে রাজাপুরের সাংবাদিক আবু সায়েম আকন’র নিমন্ত্রণে বাগরী বাজারে হালকা নাস্তা শেষ করি। তারপর রাজাপুর প্রেসক্লাবে শুরু হয় আমাদের আড্ডা। সেখান থেকে বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। রাত ১০টায় বরিশাল নগরীর হাতেম আলী চৌমাথায় অবস্থিত ‘মেহমানখানায়’ এসে আমাদের যাত্রা শেষ হয়। তবে বারবার মনে পড়ে কবি অনির্বাণ চক্রবর্তীর আন্তরিক ভালোবাসা ও হৃদ্যতার কথা। সবার ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে যাবে মুক্তবুলি ম্যাগাজিন।

রিয়াজ পাটওয়ারী ।। বার্তাসম্পাদক, দৈনিক ন্যায় অন্যায়, বরিশাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *