দেখায় লেখায় নিজস্বতায় কবি ফিরোজ মাহমুদ

হারুন আল রাশিদ

এক

কিছু মানুষের প্রতি অভিমান সারাজীবনই থেকে যায়। যাদেরকে ভালোবাসি। কাছে না থাকার শূন্যতা অনুভব করি সর্বক্ষণ। যারা আপন মানুষ। আত্মার পরমাত্মীয়। যাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার সম্পৃক্ততা হৃদয়ের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে।

বলছি, কবি ফিরোজ মাহমুদের কথা। নব্বই দশকের ঝলকে ওঠা কবি। নতুন সুর, নতুন ব্যঞ্জনায়, ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপন করে কবিতাকে নিয়ে যান নান্দনিকতার উর্বর জমিতে। একই বক্তব্য সমসাময়িক কবিদের থেকে আলাদা স্বরে উচ্চারণ করে নির্মাণ করেন মৌলিক কবিতা। ভিন্ন স্বাদ, ভিন্ন দ্যোতনায় যার কবিতা পাঠকের মন প্রভাবিত করে জ্যোতি ছড়ায় স্থায়ীভাবে।

অনেক বছর পর আকস্মিক সব অভিমান জড়ো হয়ে আছড়ে পড়ছে এই মানুষটার ওপর। কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না নিস্ক্রিয়তা! কেনো কলমকে থমকে দিয়ে চমকে দিলেন পাঠককে। স্থবিরতা একধরণের অভিশাপ। যা এই কবির জন্য সম্পূর্ণ বেমানান।

নব্বই দশকের মাঝামাঝি উত্থান। অল্পদিনের ব্যবধানে সমসাময়িকদের ম্লান করে ঝিলিক দিয়ে উঠলেন কাব্যাকাশে। সম্পূর্ণ আলাদা স্টাইল তৈরী করে বাংলা কবিতাকে ঝাঁকি দিয়ে জানান দিলেন আপন অস্তিত্বের। দেখায় লেখায় নিজস্বতা বজায় রেখে স্থান করে নিলেন সাহসী উচ্চারণে।

বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশে কাক এবং কবির সংখ্যা সমান। তীব্র প্রতিবাদ করছি কবিদের সম্মানের ওপর আঘাত করা এই নিকৃষ্ট কথার। কবির সংখ্যা অনেক হলেও কবি ফিরোজ মাহমুদের সংখ্যা নেহায়েত অল্প। ফিরোজ ভাইর কবিতার পাঠক মাত্রই বুঝতে সক্ষম হবেন, চাইলেই বড় কবি হওয়া যায় না। সৃজনশীল কবিতা লেখার জন্য কি মসলা, উপাদান লাগে কবিতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে চোখে আঙুল দিয়ে তা বুঝিয়ে দেন ফিরোজ মাহমুদ।

লিখলেই যদি কবিতা হয়ে যেতো তাহলে কবিতা নির্মাণের জন্য এতোটা পরিশ্রমের প্রয়োজন হতো না। ফিরোজ ভাই একবার বলেছিলেন, ‘ চারমাসে কবিতাটা সম্পূর্ণ করলাম।’ তখনও বুঝিনি কথাটার সারমর্ম। আজ কিছুটা হলেও সক্ষম হয়েছি। বুঝতে পেরেছি কবিতার কারিগর কতোটা শ্রম দিয়ে, ঘাম দিয়ে তৈরী করেন কবিতার ইমারত।

দুই

ফিরোজ মাহমুদ যেকোনো বই পড়ে শেষ করার পর আমার কাছে অনুভূতি ব্যক্ত করতেন। তার কথায়ই বুঝতে পারতাম কতোটা নিবিড়ভাবে পাঠ করেছেন বইটা। মুগ্ধ হয়ে যেতাম অনুভূতি প্রকাশের সৌন্দর্যে।

একবার আমার কাছ থেকে পড়ার জন্য নিলেন কবি আল মাহমুদের `যেভাবে বেড়ে উঠি’ ও বুলবুল সারওয়ারের ভ্রমনোপন্যাস `ঝিলাম নদীর দেশে’ বই দুইটা। এক সপ্তাহ পর ফেরত দিয়ে বললেন, ‘জীবনে অপূর্ণতা রয়ে যেতো যদি এগুলো পাঠ না করতাম। বিশেষ করে কবি আল মাহমুদের `যেভাবে বেড়ে উঠি’ বইটার ব্যাপারে খুবই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। আমাকে বললেন, ‘কেনো বইটা আমাকে আগে পড়তে দেননি? আহ! কি লেখা। আল মাহমুদ আল মাহমুদই। আসলেই তার তুলনা নেই। আল্লাহ কি যে প্রতিভা দিয়েছেন এই মানুষটাকে।

আমার চিন্তা-চেতনায় মিশে আছেন প্রাণের কবি, প্রিয় কবি আল মাহমুদ। কবির গদ্য, পদ্য এমন কি বাচন ভঙ্গি সবই ভালো লাগতো। কি সুন্দর থেমে থেমে আবেগ দিয়ে গুছিয়ে কথা বলতেন। এখনো কানে বাজে বাংলা সাহিত্য পরিষদের মাসিক সাহিত্য সভার নিয়মিত সভাপতির বক্তব্য। আহারে! আমার আত্মার পরমাত্মীয় এই মানুষটা চলে গেলেন গত বছর মহান প্রভুর ডাকে। ইতালিতে বসেই ফেসবুকে খবর পাই। পরে অবশ্য যোগাযোগ করেছি অনেকের সাথে।

ফিরোজ ভাইর সাথে আমার বেশকিছু বিষয়ের মিল ছিলো। সবচেয়ে বড় মিল অধ্যয়নের। আমার পছন্দের বইগুলো ছিলো তারও পছন্দের তালিকায়। এছাড়া আমার মতোই ছিলেন প্রচন্ড আল মাহমুদ ভক্ত। সুযোগ পেলেই আল মাহমুদের কবিতার পোস্ট মর্টেম করতেন। অন্যদের পড়া আর ফিরোজ ভাইর পড়ার মধ্যে পার্থক্য ছিলো বিস্তর। তার পাঠ ছিলো বিশ্লেষণমুখী। ‘এই শব্দটা কেনো এখানে ব্যবহার করা হয়েছে? এই বাক্যটা কেনো এভাবে সাজানো হয়েছে? কেনো এই কথাটা এভাবে বলা হয়েছে?’ এসব নিয়ে গভীর গবেষণা। এজন্যই গুণীরা বলেন, ‘ কবির দেখা ও পাঠ ব্যতিক্রম অন্যদের চাইতে।

ছাত্রজীবন থেকেই ছিলেন নানাবিধ কর্ম-কান্ডের সাথে জড়িত। এজন্য সিনিয়র কবিদের কাছ থেকে প্রায়শঃই বকাঝকাও শুনতেন। একসাথে হাজারও কাজ করার পক্ষে ছিলেন না অনেকেই। কবি নয়ন আহমেদ বলতেন, ‘চর্তুমুখী ভাবনা লক্ষ্যে পৌঁছাতে বাধাগ্রস্ত করে।’ ঠিকই বলেছিলেন নয়ন ভাই। পনের বছর পর কথার বাস্তবতা নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। ফিরোজ মাহমুদের মতো এমন সচেতন উঁচুমানের কবি নির্মমভাবে বঞ্চিত করেছেন কাব্যপ্রেমীদের। কবিতার সাথে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতায় লেখালেখির ক্যারিয়ারকে গলাটিপে হত্যা করার পর্যায়ে চলে এসেছিলেন। ভাগ্যিস মাসিক মুক্তবুলির সম্পাদক আযাদ আলাউদ্দীন সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমারও পীড়াপীড়ির কমতি ছিলো না প্রবাস থেকে। না লেখার জন্য রাগ দেখিয়েছি। ফোন করা বন্ধ করেছি। এতোকিছুর পর কবির সদ্য চেতন ফিরে এসেছে। নড়েচড়ে বসছেন ইদানিং। লিখতে আরম্ভ করছেন। আলহামদুলিল্লাহ। এটা বাংলা কবিতার জন্য কাঙ্ক্ষিত সুখবর। ফিরে এসেছেন। লিখতে শুরু করেছেন। যদিও সহযোদ্ধাদের চাপে। তারপরও কবিতার নীলাকাশে যেনো এটা রিনিঝিনি খুশির বার্তা। এখন শুধুই আকাঙ্খা, জ্বলে উঠুক পূণর্বার দেখায় লেখায় নিজস্বতায় কবি ফিরোজ মাহমুদ।

 

হারুন আল রাশিদ

ইতালি প্রবাসী লেখক, কবি ও ছড়াকার

সম্পাদক: ঝিলিক, ছড়ার কাগজ

 

৩ comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *