বাংলাদেশ: স্বপ্ন বনাম বাস্তবতা

খাজা আহমেদ ||

একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার,
সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার।
বাংলাদেশ আমাদের জন্মভূমি, মাতৃভূমি, ভালোবাসা, আবেগ, শক্তি কিংবা দুর্বলতার সবচেয়ে প্রধান স্থান। দেশমাতৃকার প্রতি আগাধ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর ত্যাগের মহিমায় মুক্তিযুদ্ধের মত ঐতিহাসিক এক অধ্যায়ের রচিয়তা আমরাই বীর বাঙ্গালি। স্বাধীনতার পর থেকে ছন্নছাড়া দেশটিকে সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্য নিয়ে যে অবিরাম ছুটে চলার সংকল্প জাতি করেছে তাতে সমানে সমান অংশগ্রহণের দাবি রাখে। অথচ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন শুধু কিছু রাজনৈতিক দল কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। একটি পরিবার যেমনি একজন পরিবার প্রধানের তৈরি করা নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে সুষ্ঠ সুন্দর ও আনন্দময় জীবন গড়ার উদ্দেশ্যে সদস্যদের গতিপথ ও সীমানা নির্ধারণ করে দেয় তেমনি একটি দেশের প্রধান তার দেশের জনগনকে সাথে নিয়ে, সর্বোচ্চ জনস্বার্থ রক্ষা ও সুখ-দুঃখ বিলিয় দেবার কাজে তৎপর থাকে। তার মানে এই নয় যে সকল দায় শুধু দেশ প্রধানের। দেশের আভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে ভূখন্ডে অবস্থিত সকল শ্রেণীরর মানুষের সাহায্য ও সচেতনতা একান্ত প্রয়োজন।

ব্যবসায় শিক্ষা প্রশাসনে একটি নীতি রয়েছে যে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও মালিক তথা মালিকানা স্বত্তাকে পৃথক চিন্তা করতে হবে যা মালিকের নিকট ব্যবসায়ের দায় নির্দেশ করে থাকে। ঠিক একইভাবে যদি বাংলাদেশকে তার ভূখন্ডে বসবসারত প্রতিটি ব্যক্তিস্বত্তা থেকে পৃথক চিন্তা করা হয় তবে নিঃসন্দেহে দেশের প্রতি আমরাও গভীরতর দায়বদ্ধ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে সে দায়ের পরিমান দূরে থাক আমরা কখনো কখনো বাংলাদেশের অংশ হয়ে বাংলাদেশকে অন্ধকারে ঠেলে দেই।

সক্রিয়ভাবে অন্যায়, দুর্নীতি, সহিংসতা, রাহাজানি, দেশের সম্পদ হরণ কিংবা অরাজকতার মত হাজারটা অন্যায় করে দেশের আভ্যন্তরীণ পরিবেশ নষ্ট করে শুধু নিজের নয় সর্বোপরি দেশের জন্য হুমকি ডেকে আনছে। আফসোসের কথা যে আগের মত এ নিয়ে আর লেখালেখি, প্রতিবাদ কিংবা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়না। অন্যায় অবিচার কমেনি, কমেনি নিন্মশ্রেণীর প্রতি শোষণ, শুধু আগের মত শোরগোল হয়না।

আপনি ঐ প্রবাদটি শুনেছেন নিশ্চই যে, “স্পষ্টভাষী শত্রু নির্বাক মিত্র অপেক্ষা ভালো।” যারা প্রকাশ্যে বাংলাদেশের কাঠোমোতে ক্ষতিকারক পোকার মত বিনষ্ট করে চলেছে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি ক্ষতির কারণ আপনার আমার মত মানুষগুলো যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার গুরুদায়িত্ব থেকে দূরে থেকে, পরোক্ষভাবে দেশের প্রতি নিজেদের অকৃতজ্ঞা চর্চা করে থাকি। শুধু কোন রকমে জীবন যাপন করে দিন পার করা মানব সৃষ্টির অপচয়ই নয় বরং স্রষ্টার অবমাননা।

দেশে বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে কথাটির থেকে বুদ্ধিজীবী জন্মান বন্ধ হয়ে গেছে আমার মনে হয়। সতেজ, তরুণ, বুদ্ধিদীপ্ত যুব সমাজকে অবমাননা করে দিনে দিনে বাংলাদেশের মেরুদন্ড দুর্বল করে দিচ্ছে সে বিষয় সামান্য ভ্রুক্ষেপ নেই ক্ষমতাসীন সমাজের।

বাংলাদোশ কেমন আছে এ প্রশ্নের উত্তরের সাথে অনেকগুলো বাড়তি প্রশ্ন ও বিষয় জড়িয়ে আছে যার সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা এখন সময়ের দাবি। দেশের আভ্যন্তরীণ অরাজকতা কিছুটা কমলেও থেমে নেই দুর্নীতির কালো থাবা, কমেনি মাদক দ্রব্য পাচার ও সেবন। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা সাধারন মানুষের ভোগান্তির কথা ভাবার কেউ নেই, নেই ধর্ষনের মত নির্মম অন্যায়ের শাস্তি, অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ দখল, ক্ষমতার দাপটে অবৈধ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা কিংবা শিক্ষা ব্যবস্থার বেহাল দশার ভুক্তভোগী প্রজন্মান্তর। দলীয় স্বার্থ রক্ষায় আইন ও বিচার ব্যবস্থা স্বার্থান্বেষী দল ও ব্যক্তিগণ নিজেদের হাতে নয় রীতিমত মাথায় নিয়ে চলছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রসঙ্গ নিয়ে ভাবলে একদিকে যেমন বাংলাদেশী হিসেবে আনন্দিত হবার ইচ্ছা জাগে ঠিক পরক্ষণে দেশের মধ্যকার সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণীর মানুষ, বৃ্দ্ধাশ্রমের নোংরা ঘরে পরে কাতরানো বাবা-মা কিংবা সরকারী হাসপাতালের বারান্দায় বিনা চিকিৎসায় পরে থাকা মৃতদেহটার কথা মনে পরে শিওরে উঠি। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দরবারে নিজেকে পরিচিত করতে পারছে, সরকার সফলতা ও উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি করেছে, কৃতিত্বগুলোকে বাঙালী নিজ নামে দেশের নামে ছড়িয়ে দিতে পারছে এটা আমাদের জন্য বাঙালী হিসেবে গর্বের অংশ। কিন্তু দেশের মধ্যে বসবাসরত মানুষগুলোর জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নিন্ম শ্রেণীর মানুষকে স্বাভাবিক জীবন উপহার দেয়া, বৃদ্ধাশ্রমের অসহায়দের উত্তম ভরণপোষণ কিংবা যুব সমাজকে হতাশা থেকে দূরীকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ কি বাংলাদেশের এখনকার, এই পরিস্থিতির আর সময়ের দাবি নয়? বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে উপস্থাপনের পূর্বে দেশের আভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তা প্রদান মূল লক্ষ্য হবার যোগ্যতা কি রাখে না?
বছরের বিভিন্ন জরীপে বিশ্বের সকল দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান খুজে ফেরার পূর্বে বাংলাদেশের মানুষের মনের অবস্থা, মানুষ নিয়ে দেশের অবস্থান নিয়ে ভাবা অধিক জরুরি।

একসময় বাংলাদেশের মানুষ নিজেকে বাঙালী না বাংলাদেশী হিসেবে পরিচিত করবে সে দ্বিধায় ভুগত। কিন্তু এখন চিন্তা ধারা অনেক বদলেছে। তাই সুদূর প্রসারিত চিন্তা ধারায় বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ উন্নতির পাশাপাশি বিশ্বের দরবারে পরিচিত করতে হবে। হাতে হাত, কাধে কাধ মিলিয়ে দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় সমান অংশ নিতে হবে, গড়ে তুলতে হবে দেশে প্রয়োগ যোগ্য আইন, সম্মুখে প্রতিবাদ করতে হবে সকল অন্যায়ের।
বাংলাদেশকে নিজের থেকে আলাদা নয়, নিজেকে বাংলাদেশ মনে করতে হবে। দেশের সমস্যাগুলো সরকার বা দলগত মনে না করে ব্যক্তিগত চেষ্টা ও উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সমাধাণ খুজতে হবে। নিজ ও পরিবারকে ভালো চিন্তা, সুবুদ্ধি, দেশপ্রেম ও ধর্মের প্রতি দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবার শিক্ষা দিতে হবে।

বাংলাদেশ ভালো নেই, তার দায় আপনার, আমার তথা আমাদের। আজকের অগোছালো বাংলাদেশ সুখী, নিরাপদ, দুর্নীতিমুক্ত, সমৃদ্ধ, সৃজনশীল ও উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠত হবার কৃতিত্ব আমার আপনার সক্রিয় চেষ্টা ও উদ্যোগের মাধ্যমে আমাদেরকেই অর্জন করতে হবে।

লেখকঃ খাজা আহমেদ
শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *