আযাদ আলাউদ্দীন
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদে স্থান পাওয়া কবিতার লাইন- ‘আপনা মাংশে হরিণা বৈরী’ কিংবা মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র রায়গুনাকরের অন্নদামঙ্গল কাব্যের ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ উক্তিগুলো আজো প্রবাদ হয়ে উচ্চারিত হচ্ছে মানুষের মুখে মুখে। এরূপ মানের কবিতার লাইন ইদানিং আমাদের চোখে খুব একটা পড়ে না। কিন্তু কেন এই অবস্থা ? সাম্প্রতিক সাহিত্যের এই ভাবনা থেকেই নিবন্ধটির উৎপত্তি।
আমরা জানি- বাংলা কাব্যে আধুনিক যুগের সূচনা করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ হয়ে বাংলা কবিতার বাক প্রবাহিত হয়েছে নানা ধারায়। ঠিক যেন পদ্মা-মেঘনা-যমুনার প্রবাহিত জলধারার মতোই।
বাংলা কবিতাগুলোকে যদি বাংলাদেশের নদীর সাথে তুলনা করি তাহলে দেখবো- আগেকার নদীগুলো ছিলো খরস্রোত। অবিরাম কল কল ছল ছল শব্দে বয়ে যেতো পানি প্রবাহ। তেমনি তখনকার নদীগুলোর গভীরতার মতোই অধিকাংশ কবির কবিতার গভীরতা দেখে এখনো আমরা মুগ্ধ হই। এসব কালোত্তীর্ন কবিদের কবিতা অতিক্রম করার মতো সাহিত্য এখন তেমন একটা সৃষ্টি হতে দেখিনা।
বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডায় এসব বিষয় নিয়ে যখন ভাবি কিংবা কথা বলি তখন মনে হয়- বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীর বুকেই তো এখন চর জেগে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নদীর গতিপথ। কোথাও বা ধু ধু বালুচর। তাহলে কি ইদানিং সময়ের কবিদের সাহিত্য চর্চার গতিপথে কি কোনো চর জেগেছে। তা না হলে তাদের সৃষ্ট অধিকাংশ সাহিত্যের মাঝে আগেকার কবিদের মতো লেখার সেই গভীরতা নেই কেন?
শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় ব্যবহৃত উপমাগুলোর মাঝে খুজে পাওয়া যায় প্রকৃত বাংলাদেশকে। যেমন- ‘স্বাধীনতা তুমি/পিতার জায়নামাজের উদার জমিন’ কালোত্তীর্ন এসব উপমা খুজে পাওয়া যায় আল মাহমুদের কবিতায়ও। যেমন- সোনালী কাবিনে তিনি লিখেছেন- ‘বধূ বরণের নামে দাড়িয়েছে মহামাতৃকূল/গাঙের ঢেউয়ের মত বলো কন্যা কবুল কবুল’।
এরূপ কিংবা এরচেয়ে ভালো মানের কবিতা এখন আর সৃস্টি না হওয়ার কারণেই হয়তোবা বাংলা কবিতার পাঠকের সংখ্যা দিন দিন কমছে। বর্তমান সময়ের কবিতাগুলোর পাঠক মূলত কবিরা। সাধারন পাঠকরা উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা কিংবা ভ্রমণ কাহিনী পড়তে যতটা আগ্রহী, কবিতার ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো। কবিতার প্রতি অনেকটা অনীহা তাদের। এর কারণ কী? আমার কাছে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কারণ মনে হয়েছে কবিতার ‘দুর্বোধ্যতা’। নব্বই দশক পরবর্তী সময়ের অনেক কবির কবিতাই এই দুর্বোধ্যতার দোষে দুষ্ট।
বিভিন্ন সময় সাহিত্য চর্চা করতে গিয়ে দেখেছি- ইদানিং সময়কার কবিদের যেসব কবিতা জনপ্রিয় হয়েছে তার সবগুলোই সহজ-সরল ও উপমা সমৃদ্ধ। কোন দুর্বোধ্য কবিতা জনপ্রিয় হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবুও কেন দুর্বোধ্যতার পেছনে এতো ছোটাছুটি? অনেক কবি যুক্তি দেখাতে চান- আমার কবিতা নিয়ে ভবিষ্যতে গবেষণা হবে, আমি যদি সাধারনের মুখের ভাষায় কবিতা লিখে ফেলি তাহলে সাধারণ পাঠক আর আমার মধ্যে পার্থক্য রইলো কী? আমি কিন্তু এই শ্রেণির মতামত দেয়া কবির সাথে মোটেও একমত নই।
আমার যুক্তি হচ্ছে- কবিতা পড়া ও বোঝার জন্য একজন পাঠকের ভালো মন ও আবেগ থাকার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু আবেগের সেই জায়গা তো এখন ক্রমেই দখল করে নিচ্ছে যান্ত্রিকতা কিংবা তথাকথিত ডিজিটাল প্রযুক্তি। এসবের মোকাবেলায় কবিতাকে বাচিয়ে রাখতে হলে কবিদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথমে প্রয়োজন সহজ-সরল উপমা সমৃদ্ধ মাটি ও মানুষের কবিতা লেখা। আপনার লেখা যদি সব শ্রেণির পাঠক বুঝতে না পারেন তাহলে আপনার লেখার সার্থকতা কোথায়?
আমার একজন প্রিয় লেখক-সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন- ‘মানুষের মুখের ভাষাই কলমের ভাষা হওয়া উচিত’। আমিও তার সাথে সম্পূর্ণরূপে একমত। তবে আধুনিক কবিরা এ মতের সাথে একমত হবেন কি? ##
শতভাগ একমত পোষন করছি।