সাবরিনা শুভ্রা ।।
প্রশ্ন হচ্ছে সংস্কৃতি কী? বলা যায়, কোনো অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সংগীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতিনীতি, শিক্ষা-দীক্ষাÑ এ সবই সংস্কৃতি। তাই বলা হয়ে থাকে, কোনো জাতি বা গোষ্ঠীকে জানতে হলে তার সংস্কৃতির দিকে তাকালেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়। অন্যদিকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হচ্ছে, একটি জাতি বা রাষ্ট্রের নিজস্ব সংস্কৃতি অন্য একটি জাতি বা রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দেয়া। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আধুনিক সভ্যতার একটি বড় অভিশাপ। আজকাল সংস্কৃতি শব্দটির পাশে যোগ হচ্ছে আকাশ সংস্কৃতি। মূলত কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে টিভি চ্যানেলগুলোর বিশ্বব্যাপী প্রচারকেই আকাশ সংস্কৃতি বলা চলে।
আমাদেরও আছে গর্ব করার মতো হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। কিন্তু ভিনদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতিকে আজ সুকৌশলে কোণঠাসা করছে। এককথায়, দিনে দিনে বিদেশি সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু ঐতিহ্য রক্ষায় দায়িত্বশীলরা যে উদাসীন। তারা কি এমনটি ভাবেন না যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাব থেকে রক্ষা করতে না পারলে একদিকে যেমন হারিয়ে যাবে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতি, তেমনি আমরা পিছিয়েও পড়ব।
আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে যেভাবে বিদেশি, বিশেষ করে ভারতীয় সংস্কৃতির মোড়কে বাস্তবতাবিবর্জিত কাল্পনিক ও মূল্যবোধের অবক্ষয় সৃষ্টিকারী সংস্কৃতির নগ্ন আগ্রাসন চালানো হচ্ছে। তাতে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে খুব বেশি দেরি আছে বলে মনে হয় না। বলতে চাচ্ছি, ভারতের ফেনসিডিল আগ্রাসনে আমাদের যুব সমাজ শেষ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হওয়ার পর এবার দেশটির একাধিক টিভি সিরিয়ালের আগ্রাসনে রীতিমতো মগজ ধোলাই হতে চলেছে এই জাতির। জন্মপরিচয় আর নামে মুসলমান হলেও আচার-আচরণে, ভাবনা-চিন্তায় আমরা কেন ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক হয়ে পড়ছি? তাহলে কি ‘স্বকীয়তা’ বলতে আমাদের কিছু থাকবে না? আমরা কি ভারতীয় সিরিয়াল নির্মাতাদের টার্গেট হয়েই বাঁচব? না, তা হতে পারে না। হওয়া উচিত নয়।
বলতে দ্বিধা নেই, ভারতীয় এসব চ্যানেলের কারণে বাংলাদেশি চ্যানেলগুলো আজ হুমকির মুখে। বলা যায়, ভারতীয় চ্যানেলের চাপে বাংলাদেশি চ্যানেলগুলো যেন নিজেদের হারিয়ে খোঁজার উপক্রম। সেই সঙ্গে হুমকির মুখে পড়েছে দেশীয় সংস্কৃতি। আমাদের বাচ্চারা এখন মায়ের ভাষা বাংলা শেখার আগেই হিন্দিতে কথা বলা রপ্ত করে ফেলছে! আর এটি হচ্ছে ভারতীয় চ্যানেলগুলোর কারণে। তাদের সিরিয়ালগুলোয় এমন কিছু শিশু চরিত্র দেখা যায়, যেগুলো শিশু চরিত্র হলেও তাদের সংলাপ, আচরণ ও মুখভঙ্গির মধ্যে সামান্য হলেও শিশুসুলভ কিছু থাকে না। উদ্বিগ্ন হতেই হয় যখন দেখি, শিশুদের দিয়ে হিংসা, ঈর্ষার প্রতিযোগিতামূলক আচরণের অভিনয় করানো হচ্ছে। এতে কি শিশুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে না? এসব সিরিয়াল দেখে আমাদের শিশুরা কী শিখছে? তাদের ওপর কি এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে না? আমরা কি ভুলতে বসেছি যে, শিশুরা সুষ্ঠু সংস্কৃতির চর্চা করলে সেটা তার সঠিক মেধাবিকাশে কাজে লাগবে। আর সঠিক মেধাবিকাশের মাধ্যমেই একটা শিশু নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে? তাহলে আমাদের সমাজে দিন দিন সুষ্ঠু সংস্কৃতিচর্চা কমে যাচ্ছে কেন? এ নিয়ে কি রাষ্ট্রের কোনো দায় নেই?
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মুক্তবাজারের কল্যাণে আমাদের দেশে ভারতীয় স্টার প্লাস, স্টার জলসা, জি বাংলা, জিটিভি, স্টার ওয়ান, সনি, জি স্মাইল, ইটিভিসহ ভারতের ডজন তিনেক চ্যানেল দেখানো হচ্ছে। যদিও বিটিভিসহ আমাদের দেশের ৩০টির বেশি টিভি চ্যানেল রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছেÑ এর একটিও কি ভারতের কোনো অঙ্গরাজ্যে সম্প্রচারিত হয়? ভারতে আমাদের চ্যানেল প্রচারিত না হওয়ার জন্য কি আমাদের টিভি অনুষ্ঠানের নিম্নমান দায়ী? আমি অন্তত তা মনে করি না। কেননা আমাদের দেশের টিভিতে যেসব অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়, তা শুধু গতানুগতিক সংস্কৃতির চর্চাই নয়, বরং শিক্ষামূলকও। তাহলে কি বলা যায় না, নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি অগাধ ও প্রবল শ্রদ্ধাবোধই ভারতে আমাদের চ্যানেলগুলো প্রচার না হওয়ার প্রধান কারণ? তাহলে আমরা নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি উদাসীনÑ এমন মন্তব্য করা যায় না?
এবার আসছি সূত্র ঠিক রেখে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে। ঈদের সময়ের কথা বলি। মাসখানেক আগে থেকেই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে ঈদ কেনাকাটায়। দেখা যায় রাজধানীর সব স্তরের মার্কেট থেকে শুরু করে বিভাগ-জেলা-উপজেলা পর্যায়ের মার্কেটগুলো ছেয়ে যায় বাহারি নামের ভারতীয় পোশাকে। এসব পোশাক বিক্রি হয় দেদার। নিঃসন্দেহে গভীর উদ্বেগের বিষয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমাদের ঈদের কেনাকাটায় ব্যাপক প্রভাব ফেলছে ভারতীয় টিভি সিরিয়ালগুলো। সেটা কতটা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে তা বোঝা যায় যখন শুনি, কোনো মেয়ে আত্মহত্যা করেছে তাকে পছন্দের ‘পাখি’ কিংবা ‘কিরণমালা’ পোশাক কিনে না দেয়ার কারণে। আরও শুনেছি, স্বামী তার স্ত্রীকে ভারতীয় সিরিয়ালের পছন্দের পোশাক কিনে না দেয়ায় স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাক দেয়ার ঘটনা। তাহলে ভারতীয় টিভি সিরিয়ালগুলোর কুপ্রভাব মহামারী আকার ধারণ করার আগেই ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন নয়? কিন্তু কথা থেকে যায়Ñ বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? তবে সাহস করে কেউ বাঁধতে পারলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে নিশ্চয়ই। আমরা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা যা কিছু নিজেদের সংস্কৃতি বলে ঘোষণা করব বা মেনে চলব, তা হওয়া চাই রুচিপূর্ণ, নান্দনিক ও সুন্দর। অন্যদের অনুকরণ করার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ আমাদের সংস্কৃতি যথেষ্ট সমৃদ্ধ। সেই সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতিমনাও হতে হবে। কেননা সংস্কৃতি জাতির প্রাণ। জাতির প্রাণ রক্ষার দায়ও যে আমাদেরই।
সাবরিনা শুভ্রা
গবেষক, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
ধন্যবাদ ম্যাম,
চমৎকার কিছু উপাদান পেলাম।
উপকৃত হলাম।