নুশহাত নাফিছা ঐশী
বেলা ৩:০০ টা। এই কড়া রোদ্দুরের মধ্যে স্কুল মাঠের এককোনায় বসে আছি। এবার সত্যি সত্যিই মেজাজটা চরমে উঠে যাবে। আরিফ বার বার বলে দিয়েছিল যে ঠিক ৩:০০ টায় খেলা শুরু হবে। আর এখন সে নিজেই উধাও। চুপচাপ বসে আছি। বাকিদের জন্য অপেক্ষা করছি। আর তার সাথে ১৪ আনা রাগ আর ২ আনা বিরক্তি নিয়ে ঠিক করে রাখছি যে বাকিরা এলে ঠিক কী কী বলে রাগ ঝাড়ব। হঠাৎ খেয়াল করলাম উত্তর-দক্ষিন দিকে একটা দেয়াল তোলা হচ্ছে। মধ্যবয়স্ক একজন দেয়ালে ইট গাঁথছে আর তার পাশে একটা ছেলে ইটগুলো এগিয়ে দিচ্ছে। আমার বয়সীই হবে বলে মনে হচ্ছে। স্কুলে পড়লে ফোর-ফাইভে হয়ত পড়তো। আচ্ছা, ও কি আদৌ স্কুলে পড়ে? কি অদ্ভুত! আমি এই মাঝ-দুপুরে খেলার জন্য অপেক্ষা করছি তাতেই আমার কত কষ্ট হচ্ছে, আর ছেলেটা তো কাজ করছে! ওকে যদি খেলতে ডাকি তবে কি ও আসবে? এসব চিন্তা-ভাবনার মধ্যেই আরিফ এসে হাজির হলো। সাথে দেখলাম অন্যরাও আছে। “সরি রে, খুব দেরি হয়ে গেল।” আরিফ কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল। “হে হে! অনেক কিছু ঠিক করে রেখেছিলাম বলার যেন আচ্ছা মতো বকা দিতে পারি। কিন্তু কেন জানি না, রাগ পড়ে গেল। আজকের মতো ছেড়ে দিলাম তোদের, নেক্সট টাইম এমন করলে, বলে হাত মুঠো করে দেখিয়ে দিলাম। আরিফ ওর ফোকলা দাঁত বের করে হাসল। “চল, খেলা শুরু করি।” আরিফ হলো আমাদের টিমের ক্যাপ্টেন। সে সবাইকে দুইটা দলে ভাগ করতে বললো। “নাফিস, তুই এই দলে, শাওন তুই ঐ দলে, কিন্তু আর একজনকে তো দরকার। কী করা যায় বলত?’ আরিফ আমাকে জিজ্ঞেস করলো। হঠাৎ আমার সেই ছেলেটার কথা মনে পড়ে গেল। চোখ বুলাতে গিয়ে চোখে পড়ল ছেলেটাকে, মাঠের এক কোনায় বসে আছে। বললাম, “ঐ তো একটা ছেলে বসে আছে, চল দেখি খোঁজ নিয়ে।” আরিফ বলল, “চল, দেখি খোঁজ নিয়ে।’’ যেই না ওদিকে তাকালাম দেখি ছেলেটা মাঠের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আরিফ ডাক দিল, “এই যে শুনছো! এদিকে আসো” ছেলেটা এক দৌড়ে এগিয়ে এল। আমি বললাম, “আমাদের টিমে একজন প্লেয়ার কম পড়ে গিয়েছে। খেলবে আমাদের সাথে?” ছেলেটা উজ্জ্বল মুখে হাসল। “আমি প্লেয়ার হমু? হিহিহি! খুব হমু! নিবা তোমাগো লগে?” ছেলেটার কথা শুনে আমরা খুব মজা পেলাম। সবাই হাসতে শুরু করলাম। আরিফ হাসতে হাসতে বলল, “এই জন্যই তো ডাকলাম তোমাকে! কি নাম তোমার?” “মতিন, সবাই ডাকে মতি।” “আচ্ছা মতি, তুমি তাউসিফের টিমে খেল।” খেলা শুরু হলো। আমরা শুরু করলাম ব্যাটিং আর আরিফ শুরু করলো ফিল্ডিং। তারপর সবাই একে একে আউট হয়ে গেলে মতির খেলা শুরু হলো। শাওন বল করছিল, প্রথমটাতেই বাউন্ডারি। আমি ভাবলাম, ‘বাহ! মতি তো ভালোই খেলে! ওকে টিমে রাখলে আমরা ভালো স্কোর করতে পারব।” “কি তুই এইখানে খেলতে লইসোস! আর মুই এইখানে তোরে বিস্রাই। শয়তানে পাইছে কাম থুইয়া?” বলতে বলতে মতির গালে ঠাশ করে একটা চর পড়ল। “কিন্তু বাজান, আমি তো অনেক ইট আউগাইয়া রাখছিলাম তোমার ধারে!” “চোপ! কোনো কথা কবি না। কাম থুইয়া খেলাইতে নামছে।” আমরা এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলাম। মতি কাঁদছে, আর মতিকে কেউ একজন হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। একটু খেয়াল করে দেখলাম যে লোকটা সেই মধ্যবয়স্ক লোক যাকে আমি কাজ করতে দেখেছিলাম। আর সাথে এও বুঝলাম যে লোকটা তার বাবা।
আমরা হতভম্ব হয়ে দেখলাম দৃশ্যটা। তারপর সবাই একমুহূর্তের জন্য চুপচাপ। তাকিয়ে দেখি, সবার মুখ বাংলা পাঁচের মত হয়ে আছে। নাফিস বলল,“ধুর! খেলাটাই প- হয়ে গেল।” সবাই মাথা নাড়ল ওর কথায়। একটু পর আরিফ বলল, “নাহ, প- হয় নি। মতি যতটুকু রান করেছে ততটুকু বাদেই আমাদের টার্গেট। চল, খেলা শুরু করি।” আরিফের কথায় আমরা খেলা শুরু করলাম ঠিক ই; কিন্তু কারো মন ই যে খেলার প্রতি মন নাই, তা আমরা কিছুক্ষন পর ই বুঝতে পারলাম । “উহু, কিছুই ভালো লাগছে না।” শাওন বলল, “ এমনি সময় তো আমাদের খেলা শেষ করতেই ইচ্ছা করত না, আর আজকে!” , লিটু বলল, সবাই বুঝলাম কারণটা কী। “চল, দেখে আসি মতি কী করছে,” আমি বললাম। শুনে আরিফ বলল, “গ্র্রেট আইডিয়া! চল গিয়ে দেখি।”
আমরা সবাই একে একে আরিফের পিছু পিছু গেলাম। গিয়ে দেখি মতি ৩-৪ টা করে ইট মাথায় তুলছে আর চোখ মুছতে মুছতে ওর বাবার কাছে গিয়ে রেখে আসছে। আমি বললাম, “আচ্ছা, আমরা সবাই মিলে যদি ওর কাজ এগিয়ে রাখি তবে কি ওর বাবা ওকে আমাদের সাথে খেলতে দিবে?” শাওন বলল , “কি জানি!” লিটু বলল, “মনে নাই গত ক্লাসে ম্যাডাম পড়ালেন,’সবে মিলে করি কাজ, হারি-জিতি নাহি লাজ।’ চল আগে করে তো দেখি। আমরা সবাই একমত হলাম। নতুন কিছু করবো বলে সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে গেলাম মতির কাছে। গিয়ে আমরাও ওর কাজে হাত লাগালাম। আমাদের দেখে মতি খুব অবাক হল, চোখ কপালে তুলে বলল, “আহা! আপনারা কেন এই কাম করবেন! রাখেন তো!” “কোনো কথা নাই মতি! আমাকে আমাদের কাজ করতে দাও।” মতি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল এক মুহূর্তের জন্য। একটু পর ওর চোখের দিকে তাকিয়ে শুধু একটা শব্দ ই বড় বড় করে লেখা দেখলাম- ‘কৃতজ্ঞ’!”
দেখতে দেখতে আমরা অনেক কাজ এগিয়ে ফেললাম। মজার ব্যাপার হলো মতির বাবা সেটা টেরই পেল না। তারপর আমরা সবাই গিয়ে মতির বাবার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মতির বাবা পিছনে ফিরে তাকিয়ে মনে হয় বেশ চমকে গেলেন। আরিফ বলল, “আঙ্কেল! আমরা সবাই মিলে মতির কাজ করে দিয়েছি। এবার কি ওকে আমাদের সাথে খেলার অনুমতি দিবেন?” মতির বাবার মনে হয় আমাদের বিষয়টা বুঝতে এক মুহূর্ত সময় লাগল। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন ,”মতি, যা খেলতে যা।” কথাটা শুনে আমরা সবাই “হুররে!” বলে একটা বিরাট বড় চিৎকার দিলাম আর হই চই করতে করতে মতিকে নিয়ে মাঠের দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও আমি একটা জিনিস স্পষ্ট দেখতে পেলাম-মতির বাবার চোখের কোনায় এই রোদ্দুরের মধ্যেও মুক্তোর মত কী যেন চকচক করছে!