সৈয়দ আবদুল মান্নান: কীর্তিমানের মৃত্যু নেই

মাহমুদ ইউসুফ ।।

বরিশাল তথা দক্ষিণ বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক, গবেষক, গ্রন্থকারের জীবনচরিত নিয়ে ভাবলে সৈয়দ আবদুল মান্নানের নামটাই সর্বপ্রথম মনের পর্দায় ভেসে উঠবে। সাহিত্য সাধনায় তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ব্যয়িত হয়। জীবন কাহিনি, ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমকালীন প্রেক্ষাপটে তিনি লিখেছেন বহুগ্রন্থ, বহু প্রবন্ধ। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতারয় তিনি অবগাহন করেছেন। কলমের কালিতে সৃষ্টিও করে গেছেন সেইসব অভিজ্ঞতার ঝুড়ি। নতুন করে মুদ্রিত হওয়া উচিত তার পুস্তকরাজি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে তার দান অফুরন্ত। একদা পাঠক ও সাহিত্যমোদীদের কাছে ছিলো তাঁর তুমুল জনপ্রিয়তা। বর্তমানে আমাদের কাছে সেসব পানশে মনে হয়। বলকে বাস্তবতাকে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। তার মতো গুণীদের সম্মান জানাতেই হবে আমাদের। অনুবাদ সাহিত্যে তাঁর অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। সাহিত্যাঙ্গনের সবক্ষেত্রেই তাঁর কৃতিত্বের স্বাক্ষর স্পষ্ট। কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। তাইতো সৈয়দ আবদুল মান্নান আজও জাতীয় জীবনের যাত্রিক। সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ বংশপদবি নামের শেষে সংযুক্ত করেন একই নামে দুইজন বিখ্যাত ব্যক্তি হবার কারণে।

নয়াজামানার নবউদ্দীপনার নকিব সৈয়দ আবদুল মান্নান ছিলেন ঝালকাঠির কৃতি সন্তান। ১৯১৩ সালের ১ জুলাই নলছিটি উপজেলার (বর্তমানে ঝালকাঠি সদর) চাঁচৈর গ্রামের এক বনেদি পরিবারে তাঁর জন্ম। লেখক, সাংবাদিক, চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি খ্যাতিমান। পিতার নাম সৈয়দ আবদুর রাজ্জাক ও মাতার নাম সফুরা বেগম। আর্থিক দৈন্যতার কারণে তিনি উচ্চশিক্ষা লাভে ব্যর্থ হন। সাংসারিক অসচ্ছলতার দরুন ১৯৩১ সালে মাধ্যমিক পাশের পর শিক্ষা জীবনে আর অগ্রসর হতে পারেন নি। বরিশাল জেলা বোর্ডে ১৯৩৫ সালে প্রথম চাকরি গ্রহণ করেন। ১৯৩৬ সালে বরিশাল কালেক্টরিতে যোগদান করেন। পরে তিনি খুলনা কালেক্টরিতে বদলি হন। ১৯৪৫ সালে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় গমন করেন এবং শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ‘নবযুগ’ পত্রিকায় যোগদান করেন। ক্রমে কলকাতায় তিনি দৈনিক আজাদ, ইত্তেহাদ ও সওগাত পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেন। পূর্ব পাকিস্তানে আসার পর তিনি ১৯৫০ হইতে ১৯৫১ পর্যন্ত দৈনিক সংবাদে কর্মরত ছিলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি সরকারের তথ্য বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৭৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন। ২৩ আগস্ট ১৯৮০ তারিখে এ মহানায়কের জীবনাবসান ঘটে। তাঁর উত্তরাধিকাররা ঢাকার পান্থপথের বাসিন্দা।

তাঁর প্রথম গ্রন্থ বনের ফুল ১৯৩৬ ও দ্বিতীয় গ্রন্থ তাপস কাহিনী ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয়। আসরারে খুদী (১৯৪৫), আবু বকর সিদ্দীক (১৯৪৬), মহাকবি ইকবাল (১৯৪৬), কায়েদে আজম (১৯৫৪), গুলেবকাওলী (১৯৫৩), এক যে ছিলো সওদাগর (১৯৫৩), যেমন কর্ম তেমন ফল (১৯৫৫), তাফহিমুল কুরআন, সোনালী যুগের কাহিনী (১৯৫৬), বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন (১৯৫৬), অভিযাত্রী মার্কোপোলো (১৯৫৭), ইকবালের শিক্ষা দর্শন (১৯৫৮), স্বপ্ন যাদের সফল হলো (১৯৫৮), পাকিস্তানের ঐতিহাসিক পটভুমিকা (১৯৫৯), হযরত ইউসুফ (১৯৬২), ইসলাম পরিচিতি (১৯৬৩), ইসলামী সমাজ গঠনে নারীর দায়িত্ব (১৯৬৩), সংঘাতের মুখে ইসলাম (১৯৬৩), শেষ প্রান্তর (১৯৬৩), নবীদের কিসসা (১৯৬৩), ইসলাম ও আধুনিক চিন্তাধারা (১৯৬৩), মরণজয়ী (১৯৬৪), খুনরাঙা পথ (১৯৬৫), ভেঙে গেলো তলোয়ার (১৯৬৫), দক্ষিণ আফ্রিকা (১৯৬৭), ইসলামে মুক্তপন্থা (১৯৬৯), বালাকোটের শহীদ শাহ মুহম্মদ ইসমাইল (১৯৭০), রাষ্ট্রতত্ত্বের ইতিহাস (১৯৭৩) প্রভৃতি তাঁর লিখিত ও অনুদিত মূল্যবান গ্রন্থ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *