লাকুটিয়া জমিদার বাড়িতে একদিন

রুকাইয়া সুলতানা মুন

 

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপর
একটি শিশির বিন্দু।

শতবর্ষ পূর্বে কবি রবীন্দ্রনাথ বোধহয় এই কবিতা আমার কথা ভেবেই লিখে রেখে গিয়েছেন। বরিশালের দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি অন্যতম। এটি বরিশাল জেলাশহর থেকে মাত্র আট কি.মি. উত্তরে অবস্থিত।ইতিপূর্বে আমার কখনো সেখানে ঘুরতে যাওয়া হয়নি। গতবার শীতে যখন বরিশালে বেড়াতে গেলাম তখন কাজিনরা জেকে ধরল জমিদার বাড়ি দেখতে যাবে। সত্যি বলতে রাজধানীর করোনাকালীন ঘরবন্দি জীবনে আমিও হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।

লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

একটি গাড়ি রিজার্ভ করে সবাই মিলে হইচই করে চলে এলাম জমিদার বাড়ি। বাবুর বাজার থেকে পশ্চিমে সোজা চলে যাওয়া লাল ইট বিছানো রাস্তা জমিদার বাড়ির প্রধান প্রবেশ পথ। পথের একপাশে কয়েকটি উচু মঠ পুরানো দিনের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কোনকালে হয়তো এগুলোতে দেবতাদের আসন ছিল, ঠাকুরমশায় ছিল, ঘন্টা বাজত, শাখ আর উলুধ্বনিতে সকাল সন্ধ্যা মুখরিত হত মন্দিরপ্রাঙ্গন।

লোহার গেট পেরিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম মূল জমিদার বাড়ির আঙিনায়। সেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল প্রসাদের ক্ষয়ে যাওয়া জরাজীর্ণ কংকাল।

চার‘শ বছরের পুরানো এই বাড়িটি ১৬০০-১৭০০ শতকের মাঝামাঝি নির্মান করেন জমিদার রাজচন্দ্র রায়। তবে এই জমিদার বংশের মূল প্রতিষ্ঠাতা ছিল রূপচন্দ্র রায়।ইট সুরকি আর লোহার নির্মিত এই দ্বিতল ভবনটি জমিদার বাবুর বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হত। এই ভবনটি ছাড়াও বাড়ির প্রবেশ মুখে রয়েছে একটি শান বাঁধানো পুকুর এবং দক্ষিন দিকে একটি বিরাট দীঘি।বাড়ির পেছনের দিকে আছে সারি দেয়া কতগুলো লাল ইটের স্মৃতিস্তম্ভ।

আমার কাজিনরা যখন জমিদার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দল বেঁধে সেলফি তুলছে, তখন আমি ভাবছি এই মৃতপ্রায় বাড়িতে একদিন প্রাণপ্রাচুর্য ছিল। নিশ্চই এখানে জমিদার বাবুর রাশভারি পদচারণা ছিল, বৌরানীদের হাস্য-কোলাহলে মুখরিত ছিল আঙিনা, বসার ঘরে নায়েব গোমস্তাদের ব্যস্ত আনাগোনা ছিল, প্রজাদের দেনদরবার ছিল, ঘর ভরা ঝি-চাকর ছিল। যা কিছু ছিল বর্তমান তা আজ সকলি অতীত! তারা আজ কে কোথায়?

জমিদার বাড়ির মঠ

সেসব মানুষগুলো কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও জনহীতকর কাজে রয়ে গেছে তাদের অবদান।

 

লাকুটিয়ার জমিদাররা তৎকালীন সময়ে সাধারণ মানুষের পানীয় জলের জন্য বেশ কতগুলো পুকুর ও দীঘি খনন করেছে। শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে পুষ্পরানী বিদ্যালয় ও রাজচন্দ্র নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই রাজচন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। বরিশাল থেকে লাকুটিয়া পর্যন্ত একটি খাল খনন ও রাস্তা নির্মাণ জমিদারদের উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব।

এই বাড়িটি একসময় বরিশালের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের পীঠস্থান ছিল। তৎকালীন সময়ে দেবকুমার রায়ের নেতৃত্বে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের যে সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছিল তার বিশেষ অতিথি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছিলেন এই বাড়িতে।এদের পরিবারের ছিল রবীন্দ্রনাথের সাথে বৈবাহিক সুত্রের আবদ্ধতা। তিনি যতবার বরিশাল এসেছেন ততবার এই বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন। বাংলা সাহিত্যে প্রথম মহিলা উপন্যাসিক কুসুম কুমারি রায় ছিলেন এই বাড়ির পুত্রবধূ।
বর্তমানে নন্দিত লেখিকা অরুন্ধতী রায় এবং তার পিতা রাজিব রায় এই বংশের সন্তান। জমিদার রাজচন্দ্র রায়ের পুত্র পিয়ারীলাল রায় ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠালব্ধ ব্যারিস্টার।পিয়ারীলালের দুই পুত্র ছিলেন বিখ্যাত বৈমানিক ইন্দ্রলাল রায় ও বক্সার পরেশলাল রায়।

লাকুটিয়ার জমিদাররা ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। একারনে স্হানীয় গোঁড়া হিন্দুদের রোষানলে পড়তে হয় তাদের। গোঁড়া হিন্দুদের বহ্ণিরোষ এড়ানোর জন্য জমিদার রাখাল চন্দ্র রায় ধর্মমতে প্রাশ্চিত্ব করে তার দুই পুত্রকে হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনেন।

লাকুটিয়া জমিদার বাড়ির সর্বশেষ জমিদার ছিলেন দেবেন রায়। একসময় তিনি তার পরিবারসহ কলকাতায় চলে যান এবং তার পরবর্তী বংশধররা সেখানেই বাস করতে থাকেন।
বর্তমানে লাকুটিয়া জমিদার বাড়িটি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *