রাশিয়ায় বিশ্ব যুব উৎসবের বহমান স্মৃতি

মুকছিতীন ফারূকী মুগ্ধ ।।

জীবন যেথায় যেমন – কখনো অনেক আনন্দ আবার কখনো একদম মলিন! তবে ভালোর সাথে থাকলে যে ভালো কিছু পাওয়া যায়, এতে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়।

World Youth Fastival-2024 রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে ১৮০ টি দেশ থেকে ১০,০০০ এবং রাশিয়া থেকে স্বেচ্ছাসেবকসহ ১০,০০০ জন যুবক অংশগ্রহণ করেছে। এদের এক একজন ছিলেন এক এক বিষয়ের আইকন! কেউ বিখ্যাত ডাক্তার, কেউ শিক্ষক, কেউ সাংবাদিক, কেউ মোটিভেশনাল স্পিকার, কেউ স্পোর্টস ম্যান, এভাবে মোটামুটি সব ক্যাটাগরি থেকেই অংশগ্রহণ করেছে।

আমার সুযোগ হয়েছিলো ফ্রিল্যান্সার হিসেবে যাওয়ার। পাঁচটি পর্বের বাছাইয়ে ‘Social Media Expert‘ হিসাবে আমি মনোনীত হই। সে সুবাদে সম্পূর্ণ রাশিয়ার খরচে আমাকে ১৮ দিনের জন্য মনোনীত করা হয়। বরিশাল বিভাগ থেকে আর কেউ মনোনীত না হওয়ার বিষয়টি আমাকে অবাক করেছে।

পহেলা মার্চ ২০২৪ থেকে উৎসবটি শুরু হয় Black Sea এর পার্শ্ববর্তী Sochi’r Sirius প্রদেশে। উৎসব উদ্বোধন করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

এখানে সাতদিনের অনুষ্ঠান ও পরবর্তী তিনদিন রাজধানীতে বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধূলা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল আইকনদের সাথে মত বিনিময়, বরফ আচ্ছাদিত পাহাড়ে Ski Run, ২১ আই টি স্কুল, বিখ্যাত আই টি কোম্পানী ENSOR পরিদর্শনসহ রাশিয়ার উল্লেখযোগ্য সকল স্থানগুলো আমাদেরকে দেখানো হয়। রেড স্কয়ারের খোলা জায়গায় চারিদিকের সৌন্দর্য়মন্ডিত দালানের মাঝে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক এক অনুভূতি আমাকে আচ্ছাদিত করে ফেলেছিলো। রাশিয়ার দিনগুলো ছিলো আমার জন্য অত্যন্ত উজ্জ্বল সময়। যে উজ্জ্বলতায় হারিয়ে গিয়েছিলাম শতবার- সহস্রবার।

সারা বিশ্বের যুবকরা যখন নিজের দেশের ট্রাডিশনাল পোশাক পড়ে প্যারেড করছিলো- পই পই করে পতাকা উড়ছিলো, মনে হচ্ছিলো- সমগ্র বিশ্ব যেনো একাকার হয়ে গেছে এখানে।

ছোটবেলা থেকে অনেক রকম সংস্কৃতি, স্কাউটিং, স্পোর্টস, ব্যান্ড, মিডিয়ার সাথে জড়িত থাকায় আমার মনে হচ্ছিলো ‘WYF’ এর সবকিছুই যেন আমার জন্য করা এবং আমি বেশিরভাগ ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে উপভোগ করেছিলাম নিজের মতো করে। একই সাথে আট থেকে দশটি ইভেন্ট চলছিলো, যার যার পছন্দ মতো অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন।

দশদিনের মূল অনষ্ঠান শেষে বিভিন্ন দেশের শুধুমাত্র সেরাদের নিয়ে পরবর্তী সাতদিনের জন্য রিজিওনাল প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম Yaroslavl প্রদেশে।

এখানে ‘গোল্ডেন রিং’ ছিলো আমার দেখা বেশ সুন্দর এক স্থান, যেখানে কৃত্রিমভাবে বানানো বাস্তবিক একটা জায়গা। অনেকে Miniature হিসেবে চিনে থাকবেন। মাত্র পাঁচ হাজার বর্গফুট জায়গার মধ্যে একদম নিপুনতার সাথে কৃত্রিমভাবে বানানো বরফের পাহাড়, চলমান গাড়ী, ট্রাক, ট্রেন স্টেশন, সেনাবাহিনী ক্যাম্প, যুদ্ধের ঐতিহাসিক চিত্র, নদী পথ, অতি সৌর্ন্দয্যমন্ডিত দালান- ছোট একটু জায়গায় সকল কিছুর সমন্বয় এই ‘গোল্ডেন রিং’। অপরূপ রূপে সাজানো হয়েছে এ গোল্ডেন রিং।

‘রাশিয়ান বাথ’ এর নাম অনেকেই শুনে থাকবেন, যেটার অভিজ্ঞতা ছিল একদমই ভিন্ন। ৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার একটা রুমে আমাদেরকে মেডিটেশন করিয়েছিলো, এক ধরনের রাশিয়ান ট্রাডিশনাল পাতা দিয়ে শরীর ম্যাসেজ, এরপর বিশেষ ধরনের চা পান এবং সাথে সাথেই ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল ! কি যে এক অনুভুতি!

Rosa Khutor পাহাড়ের চূড়ায় আরেক অনুভূতি। যেখানে (-)৩০ ডিগ্রী তাপমাত্রা বিদ্যমান ছিল।
৫৭২৫ ফিট উচ্চতায় বরফের এ পাহাড়ে উঠতেCable Car এ চড়ে তিন ধাপে প্রায় ৩০ মিনিটে চূড়ায় পৌঁছাতে হয়। দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছলে দেখা যায় অলিম্পিক জোন, যেখানে ২০১৪ সালে Olympic Winter Game হয়েছিলো।

Yaroslavl এর ডেপুটি মিনিস্টার ও মেয়র মতবিনিময় করেছেন আমাদের সাথে, উপহার দিয়েছেন। Alumni University এর চেয়ারম্যান সিআইপি জনাব আলমগীরও মতবিনিময় করেছেন আমাদের সাথে।

পারমানবিক বোমা দেখবো এতো কাছ থেকে, বুঝতে পারিনি। আমেরিকা- রাশিয়া যুদ্ধের অনেক ঐতিহাসিক সরঞ্জাম আমাদেরকে দেখানো হয়েছে। দেখেছি রাশিয়ার বিখ্যাত নেতা “লেলিনের” ৮১ বছর আগের মমি। তিনি যেন বাস্তবে শুয়ে আছেন।
আরো কত কি!!!!

Yaroslavl তে এক মায়ার জালে আটকে গিয়েছিলো আমাদের সবার মন। গল্প- আড্ডা -ঘুরাঘুরি তে পুরোই বাজিমাত। ইস ! স্বপ্নের মতো লাগছে কেন? আমিই তো ছিলাম স্ব-শরীরে!

টাইট সিডিউল মেনে এতো এতো জায়গায় ঘুরেছিলাম তবে কখনোই ক্লান্তি কাজ করেনি। এতো সুন্দরের মধ্যে আবার ক্লান্তি আসে নাকি?

দেখেছি কৃষ্ণ সাগর / দেখেছি “রোজা খাতরের” চুড়া। স্বপ্ন নয় স্বপ্ন নয়/ এবার স্বপ্ন হয়েছে পূরা ।

তবে আমি কিন্ত আমার ফ্রিলান্সিং ক্যারিয়ারের বেগ তিন গুণেরও বেশি এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছি, রাশিয়াতে আমার পেইজের (Monetization Support By Mugdha) জন্য কিছু ভিডিও বানিয়ে। আমরা বাঙালিরা ভেতরের সৌন্দর্যের থেকে যে বাইরের সুন্দর বেশি দেখি, এটাই তার প্রমাণ।

রাশিয়ানদের সততা আমাকে অনেক মুগ্ধ করছে এবং দেখেছি তারা অনেক বই পড়ে। অযথা কথা বলে না বললেই চলে। ট্রেন, বাস, পার্ক, প্লেন সবখানেই অনেক মানুষকে বই পড়তে দেখেছি। রাশিয়াতে ৭০ % এর বেশি মানুষের বাসায়ই লাইব্রেরি আছে।

আমার সবচেয়ে বেশি ভালোলাগা কাজ করেছে যখন আমি হাজারো মানুষদের মধ্যে কোনো নেগেটিভ মাইন্ডের মানুষ দেখিনি, সবাই সবাইকে গুরুত্ব দিচ্ছিলো, যে কোনো সাহায্যের হাত তো সব সময়ই প্রস্তুত থাকে সবার। এমন না হলে আমরা কিসের মানুষ? আমরা যতো সৎ হবো, পৃথিবী ততো সুন্দর হবে।
পৃথিবী যত সুন্দর হবে, আমরা ততো ভালো থাকবো। রাশিয়ার স্মৃতিচারণ আমাকে উজ্জীবিত করে- আনন্দিত করে। আমি এমন স্মৃতিচারণ করতে চাই ,বহু বহুবার।
আবারো উড়তে চাই- ঘুড়তে চাই’ আর মনে মনে বলতে চাই, “এইতো আমি! হারিয়ে যাচ্ছি যেন স্বপ্ন ভেলায় ভেসে ।”

আমি কৃতজ্ঞতা জানাই আমার প্রেরণাদায়ক বাবা বোরহানউদ্দিন প্রেসক্লাব এর প্রাক্তন সভাপতি ওমর ফারূক তারেক ও মা ভোলা জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা ফেরদৌসী বেগমকে।

মুকছিতীন ফারুকি মুগ্ধ

ফ্রিল্যান্সার, বোরহানউদ্দিন, ভোলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *