মাহমুদ ইউসুফ
সাংবিধানিকভাবে বর্তমান ভারতের জনক এম. কে. গান্ধী। কিন্তু ভারত তো শুধু শতবছরের দেশ নয়। অতিপ্রাচীনকাল থেকেই এ ভূখণ্ডে ইনসানের বসবাস। রাজ ক্ষমতার উত্থান-পতন, বহিরাগতদের উপনিবেশ এবং সভ্যতার অগ্রযাত্রায় ঘটে নানা বিবর্তন। ভৌগোলিক সীমারেখায়ও বারবার বদল হয়েছে। মুঘল যুগে আফগানিস্তান থেকে রেঙ্গুন তক ভারতবর্ষের আয়তন বিস্তৃত ছিলো। ১৯৪৭ সাল থেকে বর্তমানরূপ পরিগৃহীত। বর্তমান ভারতের উদগাতা যেই-ই হোক প্রাচীনকালে যিনি ভারতকে প্রথম ঠিকানা হিসেবে কবুল করেন তিনিই ভারতের আসল ও প্রকৃত জনক। এই উৎস উদ্ঘাটনে গোড়ায় ফিরতে হবে।
আদমের আবির্ভাবে ভূম-লে মানব বসতি শুরু।১ মানবজাতির পিতা (Father of Nations) হিসেবে তাঁর হাতেই সভ্যতার শোভাযাত্রা। তাঁর আগমনে এ পৃথিবী ধন্য। বর্তমান দুনিয়ার সব মানুষই তাঁর বংশধর ও সন্তান-সন্তুতি। তিনি অখ্যাত কোনো ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি ছিলেন আল্লহ প্রেরিত অহির নিশানবাহি তারকা। নবিদের পরম্পরায় আদম আ. যদিও সর্বপ্রথম নবি, কিন্তু তাঁর আমলে ইমানের সাথে কুফর ও গোমরাহির মোকাবেলা ছিলো না। তাঁর শরিয়াতের অধিকাংশ বিধানই পৃথিবী আবাদকরণ ও মানবীয় প্রয়োজনাদির সাথে সম্পৃক্ত। কুফর ও কাফিরদের কোথাও অস্তিত্ব ছিলো না। কুফর ও শিরকের সাথে ইমানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নুহের আমল থেকে শুরু হয়। রিসালাত ও শরিয়াতের দিক দিয়ে নুহই জগতের প্রথম রসুল। এছাড়া তুফানে পৃথিবী নিমজ্জিত হওয়ার পর যারা প্রাণে বেঁচে ছিলেন, তাঁরা ছিলেন হযরত নুহ আ. ও তাঁর নৌকাস্থিত সঙ্গি-সাথী। তাদের দ্বারাই পৃথিবী নতুনভাবে আবাদ হয়। এ কারণেই তাঁকে, ‘ছোটো আদম’ বলা হয়।২ এ প্রসঙ্গে মুয়াররিখ ও গবেষক ড. মোহাম্মদ হাননান বলেন,
‘হযরত আদম থেকে আমাদের এই মানব জাতির শুরু। কিন্তু নুহের সময়ে সমগ্র পৃথিবীতে এক মহাপ্লাবন ঘটে। এই মহাপ্লাবনে দুনিয়ার সকল কিছু ধ্বংস হয়ে যায়। কেউ জীবিত ছিলো না। শুধু নুহের নৌকায় আরোহণ করেছিলেন ৮০ জন নুহের ভক্ত; এই ৮০ জন থেকেই মানব জাতির আবার নতুন যাত্রা।
এই নতুন যাত্রায় জাতিরও সম্পর্ক ছিল। বেঁচে যাওয়া ৮০ জনের মধ্যে ছিলেন নূহের এক পুত্র; নাম তাঁর ‘‘হাম’’। নুহ তাঁর পুত্র হামকে বললেন, ‘‘তুমি মানব বসতি স্থাপনের জন্যে চলে যাও পৃথিবীর দক্ষিণ দিকে’’। পিতার নির্দেশ পেয়ে হাম চলে এলেন আমাদের এশিয়া মহাদেশের কাছাকাছি। সেখানে এসে তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হিন্দকে পাঠালেন ভারতের দিকে। অনেকে মনে করেন, হামের পুত্র হিন্দের নাম অনুসারেই ভারতের নাম হয়েছে হিন্দুস্তান।’ ৩
আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের জনক ইবনে খালদুন৪ (১৩৩২-১৪০৬) এর মতে, হযরত নুহ হলেন আদমের দশম স্তরের বংশধর।৫ আদম → শিষ → আনু → কাএন → মাহলা এল → য়্যারবু → উখনুখ → মুতাশলাখ → লামাক → নুহ → হাম → হিন্দ। হিন্দ বা হিন্দু হলেন নবি আদমের দ্বাদশ প্রজন্ম। ভারতের জাতির পিতা সম্পর্কে প্রথম বাঙালি৬ ঐতিহাসিক গোলাম হোসায়ন সলীম জইদপুরি লিখেছেন:
‘অতীতের মুক্তাসম কাহিনীসমূহের মূল্য নির্ধারণকারীদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, ইতিহাসবেত্তাদের অনেকে বর্ণনা করেছেন যে, নূহ পয়গাম্বরের পুত্র হাম তাঁর পুত-পবিত্র পিতার অনুমতি অনুযায়ী দক্ষিণ দিকে মনুষ্যবসতির জন্য মনস্থ করেন। সেই উদ্দেশ্য কার্যকর করার জন্য তিনি তার পুত্রদের দিকে দিকে মানুষের বসতি স্থাপনের জন্য প্রেরণ করেন। তাঁর প্রথম পুত্রের নাম হিন্দ; দ্বিতীয়ের সিন্ধ; তৃতীয়ের হাবাশ, চতুর্থের জানায; পঞ্চমের বার্বার; এবং ষষ্ঠের নাম নিউবাহ। যে সকল অঞ্চলে তারা উপনিবেশ স্থাপন করেন, সেগুলোর নাম তাঁদের নামানুসারে রাখা হয়েছে। জেষ্ঠ সন্তান হিন্দ হিন্দুস্তানে আসার দরুন এই অঞ্চলের নাম তাঁর নামানুসারে রাখা হয়। সিন্ধু জেষ্ঠ ভ্রাতার সাথে এসে সিন্ধ দেশে বসতি স্থাপন করায় এই অঞ্চলের নাম তাঁরই নামানুসারে সিন্ধু রাখা হয়। হিন্দের চার পুত্র ছিল। প্রথম- পূরব; দ্বিতীয়- বঙ্গ; তৃতীয় দখিন, চতুর্থ- নাহারওয়াল। এরা যে অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করেন, তার প্রতিটির নাম তাদেরই প্রত্যেকের নামানুযায়ী রাখা হয়। হিন্দের পুত্র দখিনের তিন পুত্র ছিল এবং দখিন দেশটি (ভারতের দাক্ষিণাত্য) তাদের মধ্যে তিন ভাগে বিভক্ত হয়। এই তিনপুত্রের নাম ছিল সারহাট, কানার, তালং। দক্ষিণ-দেশবাসীরা (দক্ষিণ ভারত) সকলে এঁদের বংশধর এবং এখন পর্যন্ত এই তিনটি জাতি (গোষ্ঠী) এই অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে।’৭
নুহের উত্তরাধিকারী হিন্দের মাধ্যমে ভারতভূমিতে মানুষের অভিযাত্রা শুরু। হিন্দই ভারতীয়দের আদি গুরু, প্রথম ভারতীয়, উপমহাদেশের প্রথম মানুষ, ভারতের প্রথম নাগরিক, পরম পুরুষ। তাই হিন্দই ভারতের জনক, ভারতীয়দের পিতা। Father of India and Indian Citizens and Indian civilization। আর হিন্দ ও তাঁর ছেলে-সন্তানরা যেহেতু মুসলিম, ইসলামের অনুসারী; সেহেতু মুসলিমরাই ভারতের আদিবাসী, আদিম অধিবাসী, প্রাচীন সম্প্রদায়, নৃ-তাত্ত্বিক নরগোষ্ঠী।
হিন্দু উপখ্যান মোতাবেক ভরত হচ্ছে চন্দ্রবংশীয় পৌরাণিক রাজা দুষ্মন্তের পুত্র। কম্বমুনির আশ্রিতা কন্যা শকুন্তলার গর্ভে তার পয়দা।৮ আধুনিক ভারত নামটির উৎপত্তি চন্দ্রবংশীয় পৌরাণিক রাজা ভরতের নামানুসারে। কথিত আছে, এই বর্ষ বা অঞ্চলটি রাজা ভরতকে দান করা হয়েছিল বলে এর নাম ভারর্ত। ইংরেজি ইন্ডিয়া (India) শব্দটি এসেছে সিন্ধু নদের আদি ফার্সি নাম হিন্দু থেকে। এছাড়াও প্রাচীন গ্রিকরা ভারতীয়দের ইন্দোই (Ινδοί; অর্থাৎ, ইন্দাস (সিন্ধু) নদী অববাহিকার অধিবাসী) নামে অভিহিত করতেন। আযাদির পর ভারতের সংবিধানে ও লোকমুখে ভারত নামটিই প্রচলিত হয়। এছাড়াও মধ্যযুগে উত্তর ভারত অর্থে ফার্সি হিন্দুস্তান (বা হিন্দুস্থান; সিন্ধুনদের দেশ) শব্দটিও ব্যবহৃত হত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই শব্দটি সমগ্র ভারত অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।৯ উল্লেখ্য ভরতের আগ থেকেই এ মাটিতে মানুষের উপস্থিতি। তখন এ ভূভাগ নামহীন ছিলো না। বহুপূর্ব থেকেই এখানে সভ্য মানুষের বসবাস। তাই ভারত নাম কাম্য নয়; পুরোপুরি অযৌক্তিক। হিন্দুস্তান নামই যৌক্তিক। আর্যাবর্ত বা ভরত নাম আর্যব্রাহ্মণদের প্রদত্ত।
হদিস :
১. আদম, আদমি আরবি পরিভাষা। জগতের প্রথম সৃষ্ট মানুষের নাম আদম। (বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক অভিধান, সম্পাদনায়: ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী, স্বরোচিত সরকার, পরিমার্জিত সংস্করণ, অষ্টাদশ পুনমুদ্রণ জানুয়ারি ২০১৫, পৃষ্ঠা ১০৩
২. মুফতী মুহাম্মদ শফী: তাফসিরে মারেফুল কুরআন (মাওলানা মুহিউদ্দিন খান কর্তৃক তরযমাকৃত), খাদেমুল হারামাইন বাদশাহ ফাহাদ কুরআন মুদ্রণ প্রকল্প, সৌদি আরব, পৃষ্ঠা ৪৫২
৩. ড. মোহাম্মদ হাননান: দেশের নামটি বাংলাদেশ কে রেখেছে এই নাম, অনুপম প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ১৫-১৬
৪. ইবনে খালদুন, আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের জনক
৫. আখতার ফারুক: বাংগালীর ইতিকথা, জুলকারনাইন পাবলিকেশন্স, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা আখতার ফারুক, পৃ ৪৯
৬. গোলাম হোসায়ন সলীম ১৭৮৬-১৭৮৮ সনে রিয়াজ-উস-সালাতিন গ্রন্থটি রচনা করেন ফারসি ভাষায়। এটিই বাংলাদেশের প্রথম পুর্ণাঙ্গ ইতিহাস। তিনি ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মালদহ কুঠির বাণিজ্যবিভাগের কেয়ারটেকার বা কুঠিয়াল জর্জ সিডনির ডাক-মুন্সি।
৭. গোলাম হোসায়ন সলীম: বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতীনের বঙ্গানুবাদ, তরযমা: আকবরউদ্দীন), অবসর প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৩-২৪
৮. ড. অতুল সুর , দেবলোকে যৌনজীবন, কলকাতা, পরিমার্জিত সংস্করণ ১৩৯৬, পৃ ১৪৪
৯. ভারত, মুক্তবিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া, সংগৃহীত: ২৬.০৯.২০১৭