মাহমুদ ইউসুফ
বাংলাদেশের সাম্রাজ্যবাদীদের রাজনৈতিক আসন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৫৭ সালে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তরুণ নবাব সিরাজের কাছ থেকে সিংহাসন কেড়ে নেয়। তাদেরকে সার্বিক সহযোগিতা করে নবাবের অমাত্যবর্গ এবং উঠতি পূঁজিপতিদের প্রধান অংশ। রবাট ক্লাইভ, ওয়াটস, ড্রেক, স্ক্রাফটন, ওয়াটসন, জব চার্ণক এর হাতে হাত মিলায় মির জাফর আলি, মিরন, ইয়ার লতিফ খান, ঘষেটি বেগম গংরা। জগৎশেঠ মহতাপচাঁদ, মহারাজা স্বরূপচাঁদ, কৃষ্ণচন্দ্র রায়, রাজা মহন্দ্রে, রাজা রাজবল্লভ, রায় দুর্লভরামদের ষড়যন্ত্রে দেশের স্বাধীনতা চলে যায় ফিরিঙি বণিকদের হাতে।
ক্রমান্বয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের অধীশ্বর হয়ে ওঠে। ভগবানের মর্যাদায় অভিসিক্ত হয় তারা। তবে ভারতবর্ষে তাদের পদচারণা ঘটে পনের শতকের শেষ পর্যায়। পর্তুগাল অধিপতি রাজা ম্যানুয়েলের আশির্বাদ নিয়ে পর্তুগিজ নাবিক দল ভাস্কো ডা গামার নেতৃত্বে ভারতের কালিকট বন্দরে তাদের বাণিজ্য পোতের নোঙর পড়ে ১৪৯৮ সালের ২০ মে। এখান থেকেই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর আগ্রাসন শুরু হয়। ভবঘুরে, জেল পলাতক, ঋণগ্রস্ত, সবরকমের অপরাধী, দুরাত্মা-যারা নীতি বিগর্হিত ও চরিত্রহীনতার জন্য দেশে চাকরি পাওয়ার জন্য ছিলো অযোগ্য, যাদের পারিবারিক মর্যাদা রক্ষার লক্ষ্যে পর্তুগাল সরকার নির্বাসনে পাঠাতে ছিলো উদগ্রীব- এরাই ছিলো গামার সহঅভিযাত্রী। ঐতিহাসিক শ্রী অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় তাঁর ‘ফিরিঙ বণিক’ গ্রন্থে ভাস্কো ডা গামা ও তার সহকর্মীদের যথার্থই জলদস্যু, শঠ, প্রপঞ্চক, ডাকাত, সাম্প্রদায়িক, মুসলিম বিদ্বেষী, ধর্মান্ধ, খুনি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। শুধু গামাই নয় কলোম্বাস, ম্যাগিলান, টাসম্যান, জেমস কুক, সিলভেইরা, আলমিদা, আলবুর্কাক, কার্ভালো, গঞ্জালেস, যোসিয়া চাইল্ড, টমাস রো, উইলিয়াম হকিন্স, লর্ড ক্লাইভ সবাই-ই ছিলো দানবীয় ধর্মদর্শনে উজ্জীবিত।
আযাদি আন্দোলনের মহানায়ক বালকি শাহ ও তাঁর প্রতিরোধ সংগ্রাম
পিরোজপুরে এক কৃষক পরিবারে বালকি শাহের জন্ম। ১৭৮৭ সালে দুর্ভিক্ষপীড়িত কৃষকদের নিয়ে তিনি একটি প্রতিরোধ বাহিনী গঠন করেন। তিনি ইংরেজ বণিক ও জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। (সুপ্রকাশ রায়: ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃ ১০৪-১০৮)। বালকি শাহ কেন বিদ্রোহ করেন এ সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য একটু পিছনে যেতে হবে।
১৬৪০ সালে বাংলায় আগত পর্যটক সিবাস্তিয়ান মানরিক লিখেছেন, বাংলার তৎকালীন সময়ে স্বর্ণ-রৌপ্য মুদ্রার এতো ছড়াছড়ি ছিলো যে, বিত্তবান ব্যবসায়ীদের অনেকে ধামা বা ঝুড়ি ভর্তি স্বর্ণ ও রৌপ্যের মুদ্রা মেপে হিসাব করতেন। ১৬৬৬ সালে বাংলাদেশ পর্যটনকালে ফ্রান্সিস বার্নিয়ার লিখেছেন, এককথায় বাংলা প্রাচুর্যের দেশ-সেখানে সবকিছুরই প্রাচুর্য। আমি এমন কোনো দেশের কথা জানি না যেখানে এখানকার মতো এতো বিচিত্র পণ্য পাওয়া যেতে পারে। প্রতি বছর যে কী বিপুল পরিমাণে এসব পণ্য বিদেশে চালান যেত তা কেউ কল্পনা করতে পারবে না। (Romance of an eastern capital, F.B. Bradely Burt)। ইতিহাসবিদ শ্রী সুধীর কুমার মিত্র লিখেছেন, নবাবেরা অর্থ সংগ্রহ করেছেন, প্রভূত বিত্ত সঞ্চয়ও করেছেন। কিন্তু তা ব্যয় করেছেন এ দেশেই; … সমাজ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রশক্তি হস্তক্ষেপ করে নাই বলে আপামর জনসাধারণের উৎপাদনের উৎস বন্ধ হয় নাই- কৃষি ও শিল্পে তার প্রেরণা ও উৎসাহ স্তব্ধ হয় নাই। মুসলমান আমলের শেষের দিকেও বাঙলায় এমন বহু পরিবার ছিলো যারা সোনার থালায় ভাত খেত। … ইংরেজ এসে থালাও নিয়েছে, বিলাতি পণ্য আমদানি করে এবং তরবারির জোরে উহা দেশে ঢুকিয়ে আয়ের পথটাও শেষ করেছে। ইংরেজ আমলেই ভারতবর্ষে শোষণ নীতির সূত্রপাত হয়। (সুধীর কুমার মিত্রঃ হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গ সমাজ, পৃ ১৮৮)
ইংরেজপূর্ব বাংলা সবদিক থেকেই ছিলো আজব এক স্বর্গপুরী। এই সুখ সমৃদ্ধির ওপর টর্নেডোর আঘাত হানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। রবার্ট ক্লাইভ পলাশির ‘যুদ্ধ জয়ের’ বখশিষ হিসেবে মীর জাফরের কাছ থেকে ২ লাখ ৩৪ হাজার পাউন্ড আত্মসাত করে রাতারাতি ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ ধনীতে পরিণত হয়। মীর জাফর কোম্পানির ৬ জন কর্মচারীকে ১ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড উৎকোচ প্রদান করে। কোম্পানির কলকাতা কাউন্সিলের সদস্যরা প্রত্যেকে ৫০ হাজার থেকে ৮০ হাজার পাউন্ড ঘুষ আদায় করে। (পি. রবার্টসঃ হিস্টরি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, পৃ ৩৮)
কোম্পানি ও কলকাতার অধিবাসীদের ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে এবং সৈন্য ও নৌবহরের খরচ বাবদ কোম্পানি আদায় করে মোট ২৫ লাখ ৩১ হাজার পাউন্ড। তাছাড়া মির জাফর ইংরেজ প্রধানদের খুশি করতে ৬ লাখ ৬০ হাজার ৩৭৫ পাউন্ড উপঢৌকন দেয়। বিভিন্ন ইংরেজ কর্মচারী মীর জাফরের কাছ থেকে ২৪ পরগনা জেলার জমি ছাড়াও ৩০ লাখ পাউন্ড ‘ইনাম’ গ্রহণ করে। ১৭৫৯ সালে ক্লাইভকে ৩৪ হাজার ৫৬৭ পাউন্ড বার্ষিক আয়ের দক্ষিণ কলকাতার জায়গির প্রদান করা হয়। (ব্রিজেন কে গুপ্তঃ সিরাজউদৌলাহ এন্ড দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, পৃ ৪১) ঘুষ নামক দুর্নীতি এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যাপকভাবে আমদানি করে কোম্পানির কর্মচারীরা। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৭ সাল পর্যন্ত মাত্র ১০ বছরে ৬০ লাখ পাউন্ড আত্মসাত করে। একথা ব্রিটিশ সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। (Fourth Parliamentery Report 1773, p 535)।
সুলতানি আমল নবাবি, আফগান আমল, নবাবি আমলের সুসংহত সমাজ ব্যবস্থা ভূমি ও রাজস্ব ব্যবস্থার ওপর ধ্বংসলীলা চালায় ইংরেজরা। ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ঘটায় বাংলাদেশ লুণ্ঠনের অর্থ দিয়ে। ইংল্যান্ডের ক্রমবর্ধমান শিল্পের জন্যে কাঁচামাল সরবরাহের যন্ত্ররূপে ব্যবহারের প্রক্রিয়া চালু করে এদেশকে। তারা ভূমি বন্দোবস্তের নতুন ব্যবস্থা চালু এবং ভূমি রাজস্ব হিসেবে ফসল বা উৎপন্ন দ্রব্য আদায়ের ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। ‘‘এই দুই অস্ত্রের প্রচণ্ড ধ্বংসকারী আঘাতে অল্পকালের মধ্যেই বাংলা ও বিহারের প্রাচীন গ্রাম সমাজের ভিত্তি ধূলিস্যাৎ হলো; বিহার ও বাংলা শ্মশান হয়ে গেলো।’’ (সুপ্রকাশ রায়ঃ ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃ ১০)
স্বাধীন ভারতের প্রথম আজীবন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহেরলাল নেহরু তাঁর ‘ Glimpses of World History’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ভারতের অন্যান্য সমস্ত প্রদেশের চেয়ে বাংলাদেশেই মুসলমানদের সংখ্যা বেশি। এরা ছিলো গরিব প্রজা বা অতি ক্ষুদ্র ভূস্বামী। জমিদার সাধারণত হতো হিন্দু, গ্রামের বানিয়াও তারা। এই বানিয়াই হচ্ছে টাকা ধার দেবার মহাজন আর গ্রামের মুদি। কাজেই জমিদার বানিয়া প্রজার ঘাড় চেপে বসে তাদের রক্ত শুষে নেবার সুযোগ পেতো। সুযোগের যথাসাধ্য সদ্ব্যবহার করে নিতে ছাড়তো না।’’ (জওহেরলাল নেহরুঃ বিশ্ব ইতিহাস প্রসঙ্গ, অনুবাদ- শ্রী সুবোধ চন্দ্র মজুমদার, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কোলকাতা ৯, পৃ ৩৮১)।
বাংলার সম্পদ লুণ্ঠনে ইংরেজরা একা ছিলো না। তাদের পাশে ছিলো বর্ণহিন্দু জমিদার শ্রেণি, দালাল, গোমস্তা ও বেনিয়া গোষ্ঠী। চাষিদের পিঠের ওপর এসব বিভিন্ন প্রকারের পরগাছা শোষকদের একটি বিরাট পিরামিড চেপে বসে। এই পিরামিডের চাপে বাংলার অসহায় কৃষক সর্বশান্ত হয়ে অনিবার্য ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়ায়। কোম্পানি ও জমিদার সম্প্রদায়ের বিভিন্ন প্রকার উপস্বত্বভোগীসহ কর্মচারীরা যে এলাকায় যেতো, সে এলাকা ছারখার করে দিতো। সেখানে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতো। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ বলেছেন, ‘প্রতিবেশী সমাজের জমদারদের জুলুম ও মহাজনের শোষণ- উভয় প্রকারে অতিষ্ঠ মুসলিম কৃষকদের কতক আত্মরক্ষার জন্য সাপ ও বাঘ ভরা আসামের জঙ্গলে চলে গেছে। বাকিরাও ঐ উদ্দেশ্যে তল্পীতল্পা বাঁধতে উদ্যত। ঘুঘু চরানো ভিটার নিঃস্ব চাষী পরিবার ভাঙ্গাকুলা ছেড়া কাঁতার পুটলি কাঁধে যে অতি হাহাকারে আকাশ পাতাল কাঁদিয়ে আসামের পথে চলেছে, সে দৃশ্য যারা নিজ চোখে না দেখেছে তারা নির্মমতা হাজার ভাগের একভাগও আজ উপলব্ধি করতে পারবে না।‘
অব্যাহত লুটপাট আর পাচারের ফলে ইতোমধ্যে ১৭৭০ সালে মহাদুর্ভিক্ষ দেখা দেয় সারা বাংলায়। যা ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে খ্যাত। খাদ্য না পেয়ে প্রচণ্ড ক্ষুধায় জনতা মৃত পশু ও মানুষের মাংস খেতে বাধ্য হয়। গাছের ছাল বাকল পাতা পর্যন্ত উজাড় হয়ে যায়। মৃত্যুমুখে পতিত হয় প্রায় ১ কোটি বাঙালি যার সিংহভাগই ছিলো মুসলমান। এরমাত্র ১৭ বছর পর বাকেরগঞ্জ তথা বাকলা চন্দ্রদ্বীপে সৃষ্টি হয় আর একটি দুর্ভিক্ষ। খাজনার ভয়ে অসংখ্য মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে সুন্দরবনে আশ্রয় নেয়। এই প্রেক্ষাপটে বালকি শাহের আবির্ভাব ও উত্থান। কৃষকরা জমিদার ও কোম্পানির রাজস্ব কর্মচারীদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্যে বালকি শাহের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়।
বালকি শাহের জন্ম মৃত্যু বা যাপিত জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। তবে জন্ম এক কৃষক পরিবারে তা পূর্বেই বলা হয়েছে। তদানীন্তন বাকেরগঞ্জ জেলার সলিমাবাদ পরাগনার অধীনস্থ বখারি মৌজার অধিবাসী এবং একজন ফকির। তিনি ছিলেন বরিশাল অঞ্চলের কৃষক আন্দোলনের প্রধান সংগঠক। হাজার হাজার কৃষক তাঁর অধীনে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে। সশস্ত্র অনুসারী ছিলো প্রায় ১ হাজার। তারা এতোই শক্তিশালী ছিলো যে, স্থানীয় জমিদারদের পাইকগণ ভয়ে তাদের সম্মুখীন হতে সাহস করতো না।
বালকি শাহ ঝালকাঠির সুগন্ধা বা সুগন্ধিয়া গ্রামে দুর্গ নির্মাণ করেন। তিনি সুজাবাদের কেল্লা হতে কয়েকটি কামান সংগ্রহ করেন। শোষিত, বঞ্চিত ও দুর্ভিক্ষপীড়িত কৃষকরা ছাড়াও সুজাবাদ ও ইন্দ্রপাশা দুর্গের অনেক সৈন্য এই নতুন সংগঠকের পতাকাতলে আশ্রয় নেয়। বিদ্রোহী কৃষকদের নিয়ে তিনি সুগন্ধিয়ায় একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি দুর্গের মধ্যে একটি কামানশালা ও একটি গোলাবারুদ তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। কামারশালায় বল্লম ও তরবারি তৈরি হতো। ১৭৯২ সালের ১৬ ফেব্র“য়ারির একপত্রে ইংরেজ কালেক্টর বালকি শাহের বিদ্রোহের বর্ণনা দিয়েছেন। তার বিবরণে দেখা যায়, সুগন্ধার দুর্গে সাতটি কামান ও ১২টি মাস্কেট বন্ধুক ছিলো। সর্বদা বন্ধুকধারী সৈন্য দুর্গ পাহারা দিতো। কয়েকজন গোলাবারুদ তৈরি করতো। বালকি শাহ ১৭৯২ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি প্রচার করেন ‘ফিরিঙিদের রাজত্ব শেষ হয়ে গেছে’। (সিরাজ উদদীন আহমেদঃ বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, পৃ ৪১৬-৪১৭)
বালকি শাহ ব্যক্তিগত কোনো দাবি দাওয়া নিয়ে বিদ্রোহ করেন নি। দেশ ও দশের বৃহত্তর স্বার্থে খ্রিস্টান আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এটা ছিলো সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের বিরুদ্ধে শোষিতদের সাময়িক অভ্যুত্থান। বালকি শাহ সলিমাবাদ, নাজিরপুর ও চন্দ্রদ্বীপ পরাগনার জমিদারদের ব্রিটিশ আনুগত্য পরিহার, করা প্রদান বন্ধ এবং তাঁর নেতৃত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য করেন। রায়তদের সুবিধার্থে বালকি শাহ ভূমিকর নির্দিষ্ট করেন এবং প্রতি কানিতে দুই টাকার বেশি কর আরোপ না করার এবং ইতোপূর্বে তার বেশি কর আদায় হয়ে থাকলে তা অনতিবিলম্বে ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেন। এতে কোনোরকমের ব্যতিক্রম ঘটলে তাদেরকে কঠোর শাস্তির ভয় দেখানো হয়।
নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ এই বাহিনী প্রথমদিকে কোম্পানির বরকন্দাজদের হটিয়ে দেন। কোম্পানি পরে ইউরোপীয় কর্মকর্তার অধীনে শক্তিশালী সিপাহী বাহিনী পাঠায়। তারা বালকি শাহের মাটির দুর্গ ধ্বংস কের এবং তাকে বন্দি করে। ঢাকার নিযামত আদালত বিদ্রোহ এবং রক্তপাত ঘটানোর জন্যে তাঁকে দোষি সাব্যস্ত করে এবং সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়। (এম দেলওয়ার হোসেনঃ বাংলাপিডিয়া)। তাঁর জেল জীবন বা পরবর্তী জীবন সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় না। এভাবেই ধুমকেতুর মতো গর্জে ওঠা এক বিপ্লবীর স্বপ্নসাধ সাম্রাজ্যবাদীদের রোষানলে শেষ হয়ে যায়।
চে গুয়েভারা ছিলেন কিউবার ১৯৫৯ সালের বিপ্লবের অন্যতম নায়ক। কিউবার এই বিপ্লবে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চে। তার জন্ম আর্জেন্টিনা হলেও যুদ্ধক্ষেত্র ছিলো পুরো লাতিন আমেরিকা জুড়ে। বলিভিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্যে সেখানকার মার্কিনপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ করতে গিয়ে ধরা পড়েন। সিআইএ এর এজেন্টরা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে হাত দুটো প্যাকেট করে কিউবায় পাঠিয়ে দেয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন ব্যক্তি চে কে নিয়ে অনেক আলোচনা, সেমিনার এবং গবেষণা করেন। খবরের কাগজে মৃত্যুবার্ষিকীতে বিশেষ আয়োজন থাকে। সন্দেহ নাই চে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এক লড়াকু সৈনিক ছিলেন। কিন্তু এই দেশে যারা সাম্রাজ্যবাদী দানবীয় শক্তির বিপক্ষে জীবন দিয়েছেন তাদের জন্যে আমরা কী করেছি? সাহসী নায়ক মির মদন, মোহনলাল, মজনু শাহ, চেরাগ আলি, মুসা শাহ, ভবানী পাঠক, নিসার আলি তিতুমির, কাজি মিয়াজান, হাবিলদার রজব আলী, হাজী শরিয়তউল্লাহ, মোহসিন উদ্দিন, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কাজী নজরুল ইসলাম, সিধু, কানু, মাওলানা নূর মোহাম্মাদ, ঈশানচন্দ্র রায়, শমসের গাজি, কৃপানাথ, শোভা সিংহ বোস্টম দাস, দুনিরাম পাল, নয়ন নন্দী, রামহরি দালাল, শের দৌলত, গোলাম মাসুম মৈনুদ্দিন, বিশ্বনাথ সর্দার, নুরুল উদ্দিন, গোবর্ধন দিকপাতি, মাওলানা ইসমাইল, শেখ গগন, মোহন মিয়া, রামকান্ত, সৈয়দ ইমামউদ্দিন, শিবনাথ, ফকির চাঁদ, হায়াত মাহমুদ, আইনউদ্দিন সিকদার, আশু আকন্দসহ লাখো কোটি মানুষ পশ্চিমা শোষক ও অসভ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, জেল খেটেছেন, শহিদ হয়েছেন, দ্বীপান্তরিত হয়েছেন, পরিবার পরিজন হারিয়েছে। যারা এদেশের জনম-লীকে কাক পক্ষী, কুকুর, জন্তু জানোয়ার বলে গালি দিতো, যাদের বাড়ির সামনে দিয়ে গেলে জুতো হাতে নিয়ে, ছাতা বন্ধ করে যেতে হতো, যাদের কাছে মুসলমানরা ছিলো লাইভস্টক বা গৃহপালিত পশু। একাডেমিক পাঠ্যপুস্তকে আজ তাদেরই জয়গান। অথচ মহাবিদ্রোহের মহানায়করা একাডেমিক পাঠ্যপুস্তক ও জাতীয় পর্যায় চরমভাবে উপেক্ষিত। কাগজে তাঁদের স্মরনার্থে বিশেষ সংখ্যা বেরোয় না। সত্যের বিপক্ষেই গণমাধ্যমের অবস্থান।
সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, পূঁজিবাদ, জমিদার ও মহাজনি শোষন এবং বাজারের ওপর পুঁজিপতিদের একচেটিয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলো মহাবীর বালকি শাহ। পাশ্চাত্যের সহিংস ও হিংস্র পাশবিক শক্তি তথা ইংরেজদের হটিয়ে দিয়ে স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠার প্রত্যায়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বালকি শাহ। ব্রিটিশ কোম্পানির অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও প্রযুক্তির সম্মুখে টিকতে পারনে নাই। কিন্তু নিজের সর্বশক্তি বিলিয়ে দিয়ে প্রমাণ করেছেন স্বাধীনতাকামিরা কখনও ঘুমিয়ে থাকে না। তাই এই মহান নেতাকে যথাযথভাবে মূল্যায়নের সময় এসেছে। আমাদের ভিতরের ঘুমন্ত সিংহকে জাগিয়ে তুলে বালকি শাহের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করাই হোক সবার মৌলিক কর্তব্য।
হদিস :
১। সিরাজ উদদীন আহমেদ: বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, ভাস্কর প্রকাশনী, দ্বিতীয় সংস্করণ, ৩১ জুলাই ২০০৩, বরিশাল-ঢাকা।
২। ফাহমিদ-উর-রহমান: সাম্রাজ্যবাদ, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, প্রথম প্রকাশ, মে ২০১২
৩। আনিসুল হক চৌধুরী: বাংলার মূল, আধুনিক প্রকাশনী, ডিসেম্বর ১৯৯৫, বাংলাবাজার, ঢাকা
৪। আর কোন পলাশী নয়, পলাশী ট্রাজেডীর ২৪০তম বার্ষিকী স্মারক ১৯৯৭, ৩৮০/বি, মিরপুর রোড, ধানমন্ডি ঢাকা।
৫। ড. আসকার ইবনে শাইখ: ক্রুসেডের ইতিবৃত্ত, মদিনা পাবলিকেশন্স, দ্বিতীয় সংস্করণ, ফেব্র“য়ারি ২০০২
৬। মনিরুজ্জামান শাহীন: ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বরিশাল ১৯২০-১৯৪৭, সুবর্ণ, বাংলাবাজার ঢাকা ১১০০, দ্বিতীয় মুদ্রণ জানুয়ারি ২০১৭
৭। উইকিপিডিয়া ও বাংলাপিডিয়া