শাহানারা স্বপ্না ।।
এক স্তূপ বইয়ের পাহাড়ের ওপাশে মুখে সুন্দর দাড়ি সাদা টুপি মাথায় নিতান্ত সাধারণ লোকটি বসে। দেখতে একেবারেই নিরীহ, নিরহঙ্কারী। হলে হবে কি, জানি তো তিনি কি রকম ‘ধানী মরিচ’! প্রখর ব্যক্তিত্বশালী এই জ্ঞান মহীরুহের অনেক গল্প শুনেছি। তিনি সাহিত্যিক অধ্যাপক শাহেদ আলী সাহেবের ভগ্নিপতি। আগেই বলা ছিল, নির্ধারিত সময়েই এসেছি।
সাহিত্য ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে যে সাহস সব জায়গায় মাথা উঁচিয়ে থাকে, ওই পাথুরে মুখ দেখা মাত্র তা মিলিয়ে গেল! লেখার জন্য ছুটে এসেছি বটে কিন্তু এখন তা নিতান্তই ক্ষুদ্র আর অবান্তর মনে হতে লাগল! রাজ্যের সঙ্কোচ পায়ে বেড়ি দিচ্ছিল।
তবুও স্মার্টলি প্রবেশ করলাম তার কলাবাগানের অফিস কক্ষে। কার্ড বাড়িয়ে দিলে বসতে বল্লেন। তিনি কি একটা কাগজ দেখছিলেন। হয়তো জরুরি কিছু। ওটি হাতে করেই ভেতরের দিকে গেলেন।
এত বই! চুপচাপ বসে থাকতে পারছিলাম না। বিশেষ করে নবাব ফয়জুন্নেসার ‘রূপজালাল’ দেখে আর লোভ সামলাতে পারলাম না। এটাই তো এতদিন ধরে খুঁজছি! টেনে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম।
তন্ময়তার মধ্যে কতক্ষণ কাটল জানি না! হঠাৎ কর্কশ কণ্ঠের ধমক শুনে ধ্যান ভাঙল- ‘কি! উকিল হয়েছেন বলে কি সব বৈধ হয়ে গেল? কিছু জিজ্ঞাসাবাদের দরকার নেই’!
খুবই লজ্জিত হলাম। কিন্তু নিয়ে তো আর যাইনি পড়ছি মাত্র, তাজ্জব! সতেজে বললাম- ‘বই তো পড়ার জন্যই’!-‘হুঁ! বই পড়া? এ দেশে বই পড়া বলে কিছু আছে নাকি! কে পড়বে বই?’ বলেই হাত উঁচু করে কোথাও যাওয়ার জন্য নির্দেশ করলেন- ‘চলেন, দেখবেন’!
যে ক্ষ্যাপা বুড়ো! তাড়াতাড়ি উঠে ওনার পেছনে পেছনে চল্লাম! তিনি কথা বলতে বলতে পথ প্রদর্শক হয়ে চলছেন। অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে ঘুরে ঘুরে উঠছেন। তার কর্মময় জীবন, বইয়ের সাথে সখ্যতা, অপরিসীম পরিশ্রমসাধ্য লেখা, অধ্যবসায়ী নিবিড় অধ্যয়ন, সারা জীবনের সঞ্চিত বই লুট, নষ্ট এবং দুই বছর জেলে থাকার ইতিবৃত্ত অল্প সময়ে জানতে পারলাম।
বিশাল ফ্লোরজুড়ে লাইব্রেরি। কিন্তু সব ক’টা তাক খালি! কিছু বই ছেঁড়া-খোঁড়া পড়ে আছে অনাদরে অবহেলায়! তেমন আলো নেই, অন্ধকার প্রায় ভৌতিক আচ্ছন্নতায় মুহ্যমান। মহাকাল ধূলির আস্তর ফেলে শোকাবহ একটা ইতিহাস যেন ঢেকে দিতে চাইছে!
শোকার্ত, বিস্মিত এবং লাজওয়াব থেকে নীরব অনুসরণে আবার ফিরে অফিস রুমে এলাম। মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে তার উষ্মা দূর হয়েছে। যিনি আপাদমস্তক শিক্ষাবিদ, একজন পড়ুয়া পাঠকের পরিচয় পেয়ে সন্তুষ্ট!
নিজের লেখা তুলে দিলেন অখ্যাত সাহিত্য পত্রিকার অখ্যাত এক সম্পাদকের হাতে! সেদিন তার মতো জ্ঞানী ও গুণীজনের বদান্যতায় অভিভূত, কৃতজ্ঞতায় বাক্যহারা হয়েছিলাম।
মৃত্যু দিনে স্মরণ করছি এ জ্ঞান-বৃক্ষকে।
ড. কাজী দীন মুহাম্মদ ১৯২৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম কাজী আলীমুদ্দিন। মায়ের নাম মোসাম্মাৎ কাওসার বেগম। তিনি ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অনার্সে ভর্তি হন। কৃতিত্বের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে লন্ডনে পাড়ি জমান। লন্ডনের বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের ওপর গবেষণা করেন ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে জোগদান করেন। ১৯৭৬ সালে জাতীয় প্রফেসর হন। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৮১-৮৪ সাল পর্যন্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর গবেষণা পরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি বাংলাদেশের সব ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ও বোর্ডের সদস্য ছিলেন। বাংলা একাডেমির নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ টেক্সটবুক বোর্ডের পাঠক্রমের সদস্য ছিলেন।
তিনি এ দেশের জ্ঞান জগতের এক অনন্য মনীষা, বিরল প্রতিভা, বিরাট মহীরুহ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ভাষাবিদ অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভাষাতাত্ত্বিক, ইসলামী চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক এবং একজন মৌলিক গবেষক- ড. কাজী দীন মুহম্মদ। এ জ্ঞানতাত্ত্বিক নীরব সূর্যের মতো আলোকিত করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জগৎকে।
শিক্ষা, সাহিত্য, ভাষা ও জ্ঞান-গবেষণার ক্ষেত্রে যেসব মনীষী বাংলাদেশে অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন, তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে প্রফেসর ড. কাজী দীন মুহম্মদ বিশিষ্ট ও অন্যতম। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে তিনি তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের গবেষণায় রেখেছেন মূল্যবান অবদান। ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের পর তিনি দ্বিতীয় বাঙালি যিনি ভাষাতত্ত্বে পিএইচডি লাভ করেন। এ বিষয়ের ওপর শিক্ষকতা ও গবেষণা করে তিনি আন্তর্জাতিক ভাষাতাত্ত্বিকের গৌরব অর্জন করেন।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদ অলঙ্কৃত করে ১৯৫১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ভাষা শিক্ষা ও সাহিত্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা, ইসলামী চিন্তা-গবেষণায় এবং ‘কলেজ অব এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ’ (সেডস)-এর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি ও বিভিন্ন শিক্ষা-কার্যক্রমের সাথে জড়িত থেকে তিনি শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন। তিনি রচনা করেছেন মূল্যবান ৩৮টি অনন্য গ্রন্থ। এ ছাড়া প্রচুর অগ্রন্থিত প্রবন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।
ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ ধার্মিক। ইসলামিক শিক্ষা জনসাধারণের দোর গোড়ায় পৌঁছে দিতে অসাধারণ পরিশ্রম করেছেন। ‘ইসলাম প্রচার সমিতি’, ‘বাংলাদেশ মসজিদ মিশন’সহ অনেক সংগঠনের তিনি ছিলেন সমর্থক, পৃষ্ঠপোষক ও প্রচারক। এমনকি তিনি অনেক ওয়াজ মাহফিলে সারগর্ভ, সাবলীল ওয়াজও করেছেন। তিনি একাধারে বাংলা ভাষা ও ইসলাম ধর্মের সুগভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন।
তিনি বহু ভাষাবিদ ও অতুলনীয় পাণ্ডিত্যের অধিকারী। ইংরেজি ভাষায় রয়েছে তার মৌলিক ও অনুবাদ গ্রন্থ। আরবি-ফার্সি ভাষায়ও ছিলেন সুপণ্ডিত। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত কুরআন মাজিদ, বোখারি, তিরমিজি, মোয়াত্তা, আবু দাউদ ইত্যাদি হাদিস গ্রন্থগুলোর অনুবাদ ও সম্পাদনার কাজও তিনি করেছেন।
তিনি দেশে-বিদেশে প্রচুর সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করেছেন। বক্তা হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। শিক্ষা সফরে গিয়েছেন বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে। ভ্রমণ করেছেন প্রায় ৪২টিরও বেশি দেশে।
একাত্তরে তার সংগৃহীত অত্যন্ত মূল্যবান, দুষ্প্রাপ্য ও দামি বইপত্রসহ প্রায় ১৩ হাজার বই লুট হয়ে যায়, এর স্মৃতি ও ক্ষতি আমৃত্যু পূরণ করা সম্ভব হয়নি। নিজের লেখা ১০টি মূল্যবান পাণ্ডলিপিও এর মধ্যে ছিল। তিনি ধর্মবেত্তা ও সুফি-সাধক হিসেবে সফল, উদার ও মহানুভব। কঠোর ন্যায়নীতি, নিয়মনিষ্ঠা, সুশৃঙ্খলা, কর্ম ও কর্তব্যপরায়ণতা বাস্তবায়ন করেছেন নিজ জীবনে। কর্মে অচঞ্চল, অঙ্গীকারে অবিচল, প্রাণশক্তিতে বলীয়ান একজন পরিপূর্ণ আদর্শ মানুষের মূর্তপ্রতীক তিনি।
জ্ঞানতাপস এই মহামনীষী বিগত ২৮ অক্টোবর ২০০১ জুমাবার, রাত পৌঁনে ১২টায় ইন্তেকাল করেন। পরদিন বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর রূপসীর পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
ধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে সারাজীবন তিনি সাধনা করেছেন সত্য আদর্শের। বিশ্বাসই ছিল তার সব কাজের মূলমন্ত্র। জীবনের শেষ সময়েও মগ্ন থেকেছেন স্রষ্টার নৈকট্য তালাশে। আদর্শিক জীবনযাপনের জন্য কোনো অন্যায়ের কাছে কোনো দিনও মাথানত করেননি। সমাজে তার মতো মনীষীদের জীবন ও কর্ম যতবেশি আলোচিত হবে, নবীন প্রজন্ম, সমাজ, রাষ্ট্র ততবেশি উপকৃত হবে। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাকে দিয়েছেন অতুলনীয় সম্মান। বিশ্বাসী মানুষদের সম্মিলিত প্রার্থনায় হয়তো তিনি শান্তিতেই আছেন। আল্লাহ পাক তার সব ভুলত্রুটি ক্ষমা করে তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন।