আযাদ আলাউদ্দীন : একজন সাংবাদিকের বেড়ে ওঠা

মো. জাবের আল আবদুল্লাহ

পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন- যাদের জীবনী পড়লে জানা যায়, তাদের সফলতার পিছনে তিনটি হাতিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আর তা হলো- স্বপ্ন, চেষ্টা ও পরিশ্রম।
এই তিনটির সমন্বয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন তারা, তাদের লক্ষ্যের উচ্চ চূড়ায়। এজন্যই আজ তারা গুনীজন হিসেবে পরিচিত। আর তাদের জীবনীতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা। তেমনি একজন গুনী মানুষ দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার বরিশাল ব্যুরো চিফ এবং জনপ্রিয় ম্যাগাজিন মুক্তবুলির প্রকাশক ও সম্পাদক আযাদ আলাউদ্দীন।

জন্ম ও বাল্যকাল
তিনি পহেলা মার্চ ১৯৮২ সালে ভোলা জেলার তজুমদ্দিন উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের মোহাম্মদ ভেলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম : অধ্যক্ষ মাওলানা আবদুল খালেক। তিনি মির্জাকালু সিনিয়র মাদরাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। মায়ের নাম: নজিফা খাতুন।
বাবা মা আদর করে তার নাম রাখলেন মোহাম্মদ আলাউদ্দিন। পরবর্তীতে তিনি আযাদ আলাউদ্দীন নামে পরিচিতি লাভ করেন।
বর্তমানে তারা ৩ ভাই ও ৩ বোন । বড় ভাই- মাওলানা মোহাম্মদ মহসিন- তজুমদ্দিন মহিলা আলিম মাদরাসার উপাধ্যক্ষ, ছোট ভাই- মো. মাকছুদ উল্যাহ- ইসলামী ব্যাংক ভোলার চরফ্যাশন শাখায় কর্মরত।
তবে তারা মেঘনা নদী ভাঙনের স্বীকার হয়ে ৩০ বছর পূর্বে তজুমদ্দিন থেকে বোরহানউদ্দিন উপজেলার কুঞ্জেরহাট বাজার সংলগ্ন কাচিয়া ইউনিয়নের পদ্মামনসা গ্রামে জমি কিনে নিজস্ব বাড়ি তৈরি করেন। বাড়ির নাম- অধ্যক্ষ মাওলানা আবদুল খালেক সাহেবের বাড়ি। বর্তমানে এটাই তাদের বাড়ির স্থায়ী ঠিকানা।
ছোটবেলা থেকেই তিনি অসাধারণ মেধার অধিকারী ও পরিশ্রমী ছিলেন। তার বাবা ছিলেন একজন আদর্শ মানুষ, ছিলেন সৎ, ধার্মিক এবং মানুষের প্রতি তাঁর ছিল অপরিসীম মমত্ববোধ। গরিব অসহায় ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি সবসময় সাধ্যমত বই-পুস্তক কেনা থেকে শুরু করে সকল ধরনের আর্থিক সহায়তা করতেন। তাঁর হাতে গড়া বহু গরিব ছাত্র যারা আজ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত।
বাবার সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বেড়ে উঠেছেন সাংবাদিক আযাদ আলাউদ্দীন।

শিক্ষাজীবন
তার শিক্ষা জীবন শুরু হয় ১৯৮৭ সালে, ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের মোহাম্মদ ভেলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়নের পর, ১৯৮৯ সালে মোহাম্মদ ভেলা ওমরিয়া দাখিল মাদরাসায় চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৯০ সালে ৫ম শ্রেণি ইবতেদায়ী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। একই মাদরাসায় সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনার পর ১৯৯৩ সালে মির্জাকালু ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসায় ৮ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেই মাদরাসা থেকেই ১৯৯৬ সালে দাখিল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ন হন।
দাখিলে সর্বমোট ১০০০ নম্বরের মধ্যে তার প্রাপ্ত নম্বর ৭২২। একই মাদরাসা থেকে তিনি ১৯৯৮ সালের আলিম পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ন হন। আর আলিমে সর্বমোট ১০০০ নম্বরের মধ্যে তার প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৫৯৩।
এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বরিশাল সরকারি বিএম কলেজের বাংলা বিভাগে অনার্স ১৯৯৮-৯৯ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়ে ২০০১ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ন হন। অনার্সে তার প্রাপ্ত গড় নম্বর ছিল ৫৫%। ২০০২ সালে একই কলেজ থেকে বাংলা বিভাগে মাস্টার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন। মাস্টার্সে তার প্রাপ্ত গড় নম্বর ৫০%।
তিনি মূলত কঠোর পরিশ্রমী ছাত্র ছিলেন। একদিকে পড়ালেখা- অন্যদিকে লেখালেখি। আসলেই একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা ছাড়া এমন কিছু সম্ভবপর হয়না।

লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সূচনা
আযাদ আলাউদ্দীন গ্রামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন। তিনি সপ্তম শ্রেনীতে থাকতেই সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। পত্রিকা ম্যাগাজিন বিভিন্ন বই পুস্তক পড়তেন এবং লেখালেখির চেষ্টা করতেন। ১৯৯৫ সালে তিনি ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্র। তাদের গ্রামের পুরাতন মির্জাকালু বাজারটি ছিলো ভোলা জেলার অন্যতম একটি ব্যবসায়িক জোন। তখন সেই একটি বাজারেই প্রতিদিন একশত কপির বেশি দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকা বিক্রি হতো। তিনি দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন। পত্রিকায় সব লেখার পাশাপাশি খুব মনোযোগ দিয়ে চিঠিপত্র কলাম পড়তেন। পড়তে পড়তে তার ভাবনায় এটা কাজ করতো যে দেশের বিভিন্ন এলাকার পাঠকরা তাদের স্ব স্ব এলাকার সমস্যা-সম্ভাবনার কথা চিঠিপত্র কলামে তুলে ধরছেন। তিনিও তো তাদের এলাকার সমস্যা-সম্ভাবনার কথা এই পত্রিকার চিঠিপত্র কলামে তুলে ধরতে পারেন।
সেই ভাবনা থেকেই একটি লেখা লিখলেন  ‘মির্জাকালু ডাকঘরের নানা সমস্যা’। এফোর সাইজ কাগজের এক পিঠে সুন্দরভাবে পূর্ণাঙ্গ ঠিকানাসহ লিখে ২ টাকার খামে ভরে পাঠিয়ে দিলেন দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার ঠিকানায়। এরপর প্রতিদিন পত্রিকা আসলে তিনি প্রথমে চোঁখ বুলান ‘চিঠিপত্র’ কলামে। দিন যায় সপ্তাহ যায় কিন্তু তার লেখা ছাপা হয় না। ভাবলেন হয়তো আর ছাপা হবে না। আশা ছেড়ে দিয়েছেন। প্রায় একমাস পর একদিন বিকেলে মির্জাকালু বাজারের প্রসিদ্ধ কাপড় ব্যবসায়ী হারুন চৌধুরী তাকে ডাক দিলেন এবং বললেন, আজকের পত্রিকায় তোমার লেখা ছাপা হয়েছে। আমরা পড়েছি, খুব ভালো লিখেছো, আমাদের ভালো লেগেছে। নিয়মিত লেখার চেষ্টা করো। এরপর তার দোকানে বসে জীবনের প্রথম ছাপার অক্ষরে নিজের লেখাটি পড়লেন তিনি- আর মনে প্রশান্তি অনুভব করলেন। পরিচিত আরেক দোকানদারের ডাক ‘আজকে তোমার লেখা ছাপা হয়েছে পত্রিকায়’ দেখেছো? তিনিও উৎসাহ দিলেন। সেই যে লেখালেখির প্রথম প্রেরণা তিনি পান। তারপর থেকে আর কলম থেমে থাকেনি তার। চিঠিপত্র কলামে নিয়মিত লিখতে লিখতে হয়ে গেলেন লেখক। এরপর ঢাকা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশ হতে থাকে তার লেখা।
এরপর তিনি ১৯৯৮ সালে আলিম পরীক্ষার পর লেখালেখিতে পুরোপুরি যুক্ত হন। মূলত বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ফিচার লিখতেন। তখন দৈনিক মুক্তকণ্ঠ পত্রিকার রমরমা বাজার। একদিকে পত্রিকাটি ফোরকালার ছাপা, অন্যদিকে নান্দনিক মেকআপ-গেটআপ। আর ফিচার পাতাগুলোও ছিলো বেশ সমৃদ্ধ। পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা ছিলো বেশ তুঙ্গে। সেই মুক্তকণ্ঠে একাধিক ফিচার ছাপা হওয়ার পর লেখালেখির প্রতি তার আরো আগ্রহ বেড়ে যায়।
এরপর দৈনিক জনতা পত্রিকায় চলতে থাকে তার সাংবাদিকতা। তখন দৈনিক জনতা পত্রিকার সাহিত্য এবং ফিচার সম্পাদক ছিলেন বোরহানউদ্দিনে জন্মগ্রহণকারী কবি ‍ও শিল্পী হাসান মাহমুদ। তিনি তার নিয়োগপত্র ও আইডি কার্ড পেতে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেন। প্রতিদিন তিনি ফিচারধর্মী নিউজগুলো ছবিসহ কুরিয়ারে কিংবা ডাকযোগে ঢাকা অফিসে প্রেরণ করতেন। আর জরুরি নিউজ পাঠাতেন ফ্যাক্সে। এভাবে চলতে থাকে তার সাংবাদিকতা। বোরহানউদ্দিন উপজেলা শহর থেকে মির্জাকালু বাজার প্রায় ১০/১২ কিলোমিটার দূরে হলেও সাংবাদিকতার টানে প্রতিদিন চলে আসতেন উপজেলা শহরে। আস্তে আস্তে পরিচিত হন তখনকার কর্মরত অন্যান্য সাংবাদিকদের সাথে।
তিনি ১৯৯৯ সালে কম্পিউটার শেখার জন্য ৬ মাস ভোলা শহরে অবস্থান করেন। তখনো চলতে থাকে তার সাংবাদিকতা। এসময় ভোলা শহরে কর্মরত সাংবাদিকদের সাথে পরিচিত হন। বেশি জরুরী হলে ফ্যাক্সে আর কম জরুরী হলে কুরিয়ারে নিউজ পাঠাতেন। এভাবে কাজ করতে করতে পর্যায়ক্রমে বোরহানউদ্দিন প্রেসক্লাবের সদস্য পদ লাভ করেন তিনি। পরের বছর বোরহানউদ্দিন প্রেসক্লাবের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। এভাবে ছয়মাস ভোলা শহরে অবস্থানকালে কম্পিউটার শেখা আর সাংবাদিকতার কাজ শিখে অবশেষে ভর্তি হন বরিশাল সরকারি বিএম কলেজের বাংলা বিভাগে।
অনার্স লাইফ শুরু হওয়ার পর ফিচার লেখায় মনোনিবেশ করেন। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের ফিচার পাতায় তার লেখা ছাপা হতে থাকে। এভাবে চলতে থাকে তার অনার্স লাইফ। কলেজ, লাইব্রেরি আর লেখালেখিই ছিলো তার প্রিয় ঠিকানা।

সাংবাদিকতায় আত্ননিয়োগ
তার পেশাগত জীবন শুরু হয় ১৯৯৮ সালে দৈনিক জনতা পত্রিকার বোরহানউদ্দিন উপজেলা সংবাদদাতা হিসেবে। একই সময়ে তিনি দৈনিক ইনকিলাব, মুক্তকণ্ঠ ও যুগান্তর পত্রিকায় ফিচার লিখতেন। ২০০১ সালে বাংলায় অনার্স পাশের পরপরই। ২০০২ সালে বরিশালের স্থানীয় দৈনিক দক্ষিণাঞ্চল পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। ২০০৩ সালে একই পত্রিকার বার্তা সম্পাদক পদে পদোন্নতি পান। ২০০৪ সালে দৈনিক নয়া দিগন্তের বরিশাল ব্যুরো স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে নিয়োগ পান তিনি, একই সাথে ২০০৫ সালে দৈনিক বরিশাল বার্তা পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়ে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। ২০০৬ সালে তিনি বৈশাখী টেলিভিশনের বরিশাল অফিসে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। ২০০৮ সালে বৈশাখী ছেড়ে দিগন্ত টেলিভিশনের বরিশাল ব্যুরো চিফ হিসেবে যোগ যোগ দেন। ২০১০ সালে দিগন্ত টেলিভিশনের পাশাপাশি দৈনিক বরিশাল ভোরের আলো পত্রিকায় প্রধান বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।
২০১৩ সালে সরকার দিগন্ত টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়ার পরপরই আবার দৈনিক নয়া দিগন্তের বরিশাল ব্যুরো চিফ হিসেবে যোগ দেন। এখনো একই পদে কর্মরত আছেন এই দীপ্তিমান সাংবাদিক।
সর্বোপরি ২০১৮ সাল থেকে জনপ্রিয় দ্বি-মাসিক ম্যাগাজিন মুক্তবুলি প্রকাশ করে সম্পাদনা করছেন সাংবাদিক আযাদ আলাউদ্দীন। মুক্তবুলির সকল লেখককে একই ফ্রেমে নিয়ে এসেছেন একটি ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে। লেখকদের তিনি আন্তরিকভাবে ভালোবাসেন এবং সম্মান করেন।
এছাড়াও ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বরিশাল বেতারে সংবাদ অনুবাদক হিসেবে কাজ করেন তিনি।
সাংবাদিক জীবনে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি), ম্যাস লাইন মিডিয়া সেন্টার (এমএমসি), নিউজ নেটওয়ার্ক, এমআরডিআই সহ অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ ও সনদ অর্জন করেন সাংবাদিক আযাদ আলাউদ্দীন।

সাংস্কৃতিক কার্যক্রম
১৯৯২ সাল। তখন তিনি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। শিল্পী সাইফুল্লাহ মানছুরের কন্ঠে রেকর্ড প্লেয়ারে ফিতায় বাজানো ‘তুমি রহমান… তুমি মেহেরবান…গানটির মাধ্যমে প্রথম ইসলামী সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হন তিনি। এরপর বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার থেকে প্রকাশিত ইসলামী সংগীত সিরিজের অ্যালবামগুলো সংগ্রহ করেন। ঢাকার সাইমুম ও চট্রগ্রামের পাঞ্জেরি শিল্পীগোষ্ঠীর অ্যালবামগুলো প্রকাশ করে স্পন্দন অডিও ভিজ্যুয়াল সেন্টার। এসব গান শোনার পর পর্যায়ক্রমে ইসলামী সংস্কৃতির দিকে আকৃষ্ট হতে থাকেন তিনি। সংগ্রহ করেন কবি মতিউর রহমান মল্লিকের গানের বই ‘ঝংকার’। তৎকালীন সমসাময়িকদের মধ্যে যাদের কণ্ঠ ভালো তাদেরকে এসব গানের অ্যালবাম শুনতে উদ্বুদ্ধ করেন। এমনকি তিনি নিজেও রাতে ক্যাসেট বাজিয়ে শুনতে শুনতে অনেক গান মুখস্ত করে ফেলেন। এক পর্যায়ে ভোলার মির্জাকালু ও হাকিমউদ্দিন এলাকায় তৈরি হয় ইসলামী গানের একটি গ্রুপ। সেই গ্রুপে ছিলেন- মুসা তারেক, তৈয়ব উল্যাহ, আবু আবদুল্লাহ সবুজ, হারুন অর রশিদ, মোরশেদ আলম, আজিম উদ্দিন খান প্রমুখ। এই গ্রুপটি তখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিশেষ করে তাফসিরুল কুরআন মাহফিলে একক ও যৌথভাবে ইসলামী গান পরিবেশন করতো। পরবর্তীতে এই গানের দলের নাম দেয়া হয় আল হেরা শিল্পীগোষ্ঠী।
ভোলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শুরু হয় সৃজনশীল সংস্কৃতি চর্চার আনুষ্ঠানিক পথচলা। তখন এই শিল্পীগোষ্ঠীতে ভালোমানের বেশ কয়েকজন কণ্ঠশিল্পী ও অভিনেতার দুর্দান্ত পারফর্মে এগিয়ে যায় তাদের এই সংগঠনটি। সে সময়ে আলহেরা শিল্পীগোষ্ঠীর পরিচালক ছিলেন আবু আবদুল্লাহ। আর আযাদ আলাউদ্দীন ছিলেন সহকারি পরিচালক। ১৯৯৯ সাল ছিলো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মশতবার্ষিকী। সেবছর কবি মতিউর রহমান মল্লিকের সমন্বয়ে সারাদেশে জমকালো আয়োজনে দিবসটি পালন করে বাংলাদেশ সংস্কৃতিকেন্দ্র।
ভোলার আলহেরা শিল্পীগোষ্ঠীও অনেক চমকপ্রদ ভাবে অনুষ্ঠানটি পালন করেন। অভিনেতা আরিফুল হক ভোলার সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। পুরো অনুষ্ঠানটি সমন্বয় করেন আবু আবদুল্লাহ ও আযাদ আলাউদ্দীন। সফল ওই অনুষ্ঠানটির কিছুদিন পর বরিশাল বিএম কলেজের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন তিনি। সেই সুবাদে বরিশাল চলে যান ।
২০০০ সালের কোন একদিন বরিশালের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠীর একজন সংগঠক এলেন তার মেসে। বললেন- আমরা শুনেছি আপনি ভোলা আলহেরা শিল্পীগোষ্ঠীর সহকারি পরিচালক ছিলেন। এখন থেকে আমাদের সাথে বরিশালের হেরাররশ্মিতে কাজ করবেন। তিনি সম্মতি জানালেন। তাকে ব্রাউন কম্পাউন্ড এলাকার জর্জবাড়িতে একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়া হলো। সময়মতো ওই অনুষ্ঠানে গেলেন তিনি। সেখানে হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠীর কমিটি গঠনের অনুষ্ঠান চলছিল। তাকে সহকারি পরিচালক হিসেবে ঘোষণা করা হল। সেই থেকে শুরু হলো বরিশালের হেরাররশ্মিতে তার পথ চলা।

স্মরণীয় স্মৃতি
২০০৪ সালে সাংবাদিকতা পেশার সুবাদে বরিশাল বেতারে প্রথম ‘কথিকা’ লেখার আমন্ত্রণ পান আযাদ আলউদ্দীন। তখন তিনি দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলের বার্তাসম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দৈনিক দক্ষিণাঞ্চল পত্রিকায় বেতারের বহিরাঙ্গন অনুষ্ঠানগুলো গুরুত্ব সহকারে কভারেজ করতেন। বেতারে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারিরা তাদের বহিরাঙ্গন অনুষ্ঠানের প্রেসবিজ্ঞপ্তি ও ছবি তার অফিসে দিয়ে যেতেন। সেগুলো সম্পাদনা করে পত্রিকায় ছাপাতেন তিনি। একদিন বেতারের তৎকালিন আঞ্চলিক পরিচালক মীর শাহ্ আলম তাকে বললেন বেতারে কথিকা লিখুন। তিনি লিখতে রাজি হওয়ার পর অনুষ্ঠান বিভাগ থেকে কথিকার বিষয়বস্তু জানিয়ে চিঠি দেয়া হলো। কথিকার বিষয় ছিলো ‘পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণের ভূমিকা’। এভাবে প্রতি সপ্তাহে একটি করে প্রতিমাসে প্রায় চারটি কথিকার স্ক্রিপ্ট লিখে জমা দিতেন। অনেক সময় বেতারে গিয়ে ভয়েস রেকর্ডিং করে আসতেন। এভাবে চলার দীর্ঘদিন পর ২০০৭ সালে বরিশাল বেতারে  স্থানীয় সংবাদ বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে বার্তা বিভাগে যোগ দেন উপ-বার্তা নিয়ন্ত্রক সুব্রত কুমার রায়। তিনি এসে পুরো সেটআপ সাজানোর কাজ শুরু করেন।
বরিশাল বেতারে স্থানীয় সংবাদ প্রচার শুরু হওয়ার আগেই অর্থাৎ জুন মাসের দিকে আযাদ আলাউদ্দীন সহ চারজন সাংবাদিক অস্থায়ী নিয়োগের ভিত্তিতে যোগদান করে পরীক্ষামূলকভাবে কাজ করছিলেন। অপর তিনজন হলেন- সিনিয়র সাংবাদিক কাজী মকবুল হোসেন, প্রাচুর্য রানা ও এম মিরাজ হোসাইন। তারা প্রতিদিন জেলা সংবাদদাতাদের পাঠানো নিউজগুলো সম্পাদনা করে ৫মিনিটের স্থানীয় সংবাদ স্ক্রিপ্ট তৈরি করতেন। যাকে সংবাদপত্রের ভাষায় বলা হয় ‘ডামি’র কাজ। অর্থাৎ পূর্ব প্রস্তুতি। সরকারিভাবে এই পদটির নাম ‘সংবাদ অনুবাদক’ হলেও মূলত তারা কাজ করেছে সংবাদ সম্পাদনার। প্রতিদিন তাদের দুজনের ডিউটি পড়তো। আযাদ আলাউদ্দীন এবং প্রাচুর্য রানা একদিন ডিউটি করতেন, পরদিন ডিউটি করতেন কাজী মকবুল হোসেন ও এম মিরাজ হোসাইন। এভাবে চলতে থাকে তাদের বেতার নিউজের কাজ। জুন থেকে কাজ করে সম্মানী ভাতা পেলেও পুলিশ ভেরিপিকেশন শেষ করে, তাদের নিয়োগে চুড়ান্ত সাইন হয় জুলাইর মাঝামাঝি সময়ে।

অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ১৬ জুলাই ২০০৭ ! সেদিন ডিউটিতে ছিলেন আযাদ আলাউদ্দীন এবং প্রাচুর্য রানা। তারা নিউজ লিখে সংবাদ বিভাগের উপ-বার্তা নিয়ন্ত্রক সুব্রত কুমার রায়ের হাতে জমা দিলেন। তিনি দেখে চুড়ান্ত স্ক্রীপ্ট তুলে দিলেন একজন নিউজ প্রেজেন্টারের হাতে। কাকতালীয়ভাবে দেখলেন সেই নিউজ প্রেজেন্টার হচ্ছেন আযাদ আলাউদ্দীনেরই বাংলা বিভাগের সহপাঠি নেজারুল ইসলাম বাবু ! পরে বাবুকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন- বরিশাল বেতারের প্রথম স্থানীয় সংবাদ লেখক হলাম আমরা (আযাদ আলাউদ্দীন ও প্রাচুর্য রানা) আর সংবাদ পাঠক হলে তুমি নেজারুল ইসলাম বাবু। এভাবেই বরিশাল বেতারের প্রথম স্থানীয় সংবাদ প্রচারের ইতিহাসের সাথে যুক্ত হয়ে রইলেন তারা। পরে আবশ্য তার খুব বেশিদিন কাজ করা হয়নি বেতারে। তখন ডিউটি বাবদ সম্মানী ছিলো খুবই কম। এরপর ৬ মাস কাজ করে পর্যায়ক্রমে তিনি ছেড়ে দেন বরিশাল বেতার। যদিও অবশ্য এখন এই কাজের সম্মানী বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। তাদের সে সময় যুক্ত হওয়া সিনিয়র সাংবাদিক কাজী মকবুল হোসেন এখনো যুক্ত আছেন বরিশাল বেতারে।
এভাবে সিডর সাংবাদিকতা, ভোলার লালমোহনে এমভি কোকো-০৪ লঞ্চডুবির মতো অসংখ্য নিউজ কভারেজের নেপথ্যের তথ্য আছে আযাদ আলাউদ্দীনের জীবনের ডায়েরির পাতায়। যার থেকে শিক্ষা নিতে পারেন উদিয়মান লেখক এবং সাংবাদিকরাও।

ব্যক্তিগত জীবন

আযাদ আলাউদ্দীন ২০১০ সালের ২২ এপ্রিল বরিশাল সরকারি বিএম কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল হালিম খানের ছোট কন্যা অবিদা সুলতানা লিপির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আবিদা সুলতানা লিপি বিএম কলেজ থেকে সমাজকল্যাণে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে । ছেলে তাহসিন আবির (০৮) ও মেয়ে আনিকা তাবাসসুম ইলমি (০৭) বরিশাল নগরীর মল্লিকা কিন্ডারগার্টেনে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে।

যেসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত আছেন

১. চেয়ারম্যান, বরিশাল মেট্রোপলিটন কলেজ, ২. ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সাতরং সিস্টেমস, বরিশাল, ৩. সদস্য- বরিশাল প্রেসক্লাব ৪. পরিচালক, বরিশাল সংস্কৃতিকেন্দ্র ৫. বরিশাল ব্যুরো চিফ, দৈনিক নয়া দিগন্ত, ৬, সদস্য- কুরআন-হাদিস অধ্যয়ন ও কল্যাণ ফোরাম ৭. সাধারণ সম্পাদক- ভোলা জেলা জনকল্যাণ সমিতি, বরিশাল ৮. সদস্য- বোরহানউদ্দিন প্রেসক্লাব ৯. সভাপতি- অবিরাম বাংলা বন্ধু মহল ১০. প্রকাশক ও সম্পাদক- মুক্তবুলি, ১১. কার্যনির্বাহী সদস্য, ন্যাশনাল ডেইলিজ ব্যুরো চিফ অ্যাসোসিয়েশন (এনডিবিএ), বরিশাল। ১২. সদস্য, সাংবাদিক কল্যাণ তহবিল, বরিশাল প্রেসক্লাব।

যেসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন

১. সাবেক সহকারি পরিচালক, আলহেরা শিল্পীগোষ্ঠী, ভোলা। ২. সাবেক পরিচালক, হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠী, বরিশাল ৩. সাবেক সাহিত্য সম্পাদক, বোরহানউদ্দিন প্রেসক্লাব, ৪. সাবেক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক, বরিশাল প্রেসক্লাব ৫. সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক- বরিশাল প্রেসক্লাব, ৬. সাবেক পাঠাগার সম্পাদক, বরিশাল প্রেসক্লাব ৭. প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক, বিএম কলেজ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন । ৮. সাবেক সদস্য, বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি।

লেখক: মো. জাবের আল আবদুল্লাহ শিক্ষার্থী, লালমোহন ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা, ভোলা।

আযাদ আলাউদ্দীন সম্পর্কে আরো জানতে নিচের লিংকটি কপি করে কিংবা ক্লিক করে ভিডিওটি দেখুন

https://www.facebook.com/Muktobuli-2819243221450231/videos

৩ comments

  1. লেখাটা পড়ে খুব ভাল লাগল। একজন সফল সংগ্রামী ব্যক্তির জীবন কাহিনী। তার আরও উন্নতি ও সফলতা কামনা করছি।

Leave a Reply to সুনিল বরন হালদার Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *