মাহমুদ ইউসুফ
সাম্রাজ্যবাদী চতুর চিন্তক ও ইউরোপীয় পণ্ডিতদের উর্বর মস্তিষ্কের বিকৃত চিন্তাধারার ফসল হলো ইন্দো-ইউরোপীয় প্যারেন্ট স্পিচ। মূলধারার ভাষা পরিবার তথা সেমিটিক ভাষার বিরুদ্ধে একটি কাল্পনিক তত্ত্ব দাঁড় করানোই ছিলো তাদের আসল এজেন্ডা। তাদের মনগড়া ভাষাতত্ত্ব, লিপিতত্ত্বই আধুনিক শিক্ষার বাহন হিসেবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাঠ করতে হচ্ছে প্রাচ্য-প্রতীচ্যে। এই কাল্পনিক, বানোয়াট ইন্দো ইউরোপিয় ভাষার উদ্ভব সম্পর্কে কবি গোলাম মোস্তফা বলেন, ১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের তদানীন্তন চিফ জাস্টিস এবং এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল এর প্রেসিডেন্ট স্যার উইলিয়াম জোনস- সোসাইটির এক বার্ষিক সভায় একটি মূল্যবান ভাষণ দান করেন। ওই ভাষণে তিনি ল্যাটিন, গ্রিক, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মানি, পাহলবি, সংস্কৃত প্রভৃতি কতিপয় ভাষার অনেকগুলো শব্দ ও ধাতুরূপ বিশ্লেষণ করে দেখান যে, ওই সব ভাষার মূলে ঐক্য রয়েছে। তিনি তাই অনুমান করেন, ওই সব ভাষাভাষীজনেরা আদিতে এক-ই স্থানে বাস করত এবং এক-ই ভাষায় কথা বলত। কালে কালে বংশবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তারা নানা দেশে ছড়িয়ে পড়িতে বাধ্য হয়। এরূপেই বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন ভাষার সৃষ্টি হয়। এই ইংগিত পেয়ে জার্মান পণ্ডিতদের মনে এক নতুন চিন্তার উদ্রেক হলো। তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় তারা প্রবৃত্ত হলেন। ম্যাক্সমুলার, বপ, কোলাপ্রথ প্রভৃতি পণ্ডিত এই বিষয়ে বহু গবেষণা করলেন। অতঃপর ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে স্যার থমাস ইয়ং নামক জনৈক মিসরভাষাবিদ পণ্ডিত আলোচ্য ভাষাগুলোকে ফ্যামিলি অব ইন্দো-ইউরোপিয়ান ল্যাঙ্গয়েজ বলে অভিহিত করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ওই সব ভাষাভাষী জনগণকে ইন্দো-ইউরোপিয়ান রেস নামে পরিচয় দেন। এরপরই ইন্দো-আর্য্য এবং আর্য্য নামের উৎপত্তি। (উদ্ধৃতি: ওই, পৃ ৬১-৬২)
তথাকথিত প্রগতিবাদী ও সেকুলার ভাষা পণ্ডিতদের মতে, প্রাগৈতিহাসিকালের মানুষদের কোনো ভাষা ছিলো না। তারা আকার ইঙ্গিতে, ইশারা সঙ্কেতে মনের ভাব বিনিময় করত। কিন্তু এটা বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মানুষ পয়দা করেছেন মহান আল্লাহ তায়ালা। ভাষাও পয়দা করেছেন আল্লাহ। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করবেন আর কথা বলতে শিখাবেন না। তাহলে তো অসম্পূর্ণ কাজ করেছেন! এটা হতে পারে না। অপূর্ণাঙ্গ সৃষ্টিকর্ম তার কাজ নয়। বরং মানবসৃষ্টির আগেই ভাষা সৃষ্টি করেছেন তিনি। কারণ অহির কিতাবে থেকে আমরা আল্লাহ ও ফিরিশতাদের কথোপকথন লক্ষ করি। মহাকিতাব আল কুরআনে আল্লাহ বলেন, সেই সময়ের কথা, যখন তোমার প্রভু ফেরেশতাদের বললেন, আমি মিশ্রিত পচা কাদার শুকনো মাটি দিয়ে মানুষ সৃষ্টি করব। অতঃপর যখন আমি তার অবয়ব পূর্ণভাবে তৈরি করে ফেলব ও তাতে আমি আমার রূহ ফুঁকে দেব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদায় পড়ে যাবে। (সুরা হিজর ১৫/২৮-২৯)। তাছাড়া আল্লাহ প্রথম কলম পয়দা করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রসুল স. বলেছেন, আল্লাহ্ তাআলা সর্ব প্রথম কলম সৃষ্টি করে তাকে বললেনঃ লিখ। কলম বললঃ হে আমার প্রতিপালক! কী লিখব? আল্লাহ্ বললেনঃ কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী প্রত্যেক জিনিসের তাকদির লিখ।” অন্য বর্ণনায় এসেছে, কিয়ামত পর্যন্ত যা সংঘটিত হবে সব লেখ।” (তাবারানি, ইবনু জারির, ইবনু আবি হাতিম, আহমাদ, তিরমিযি, আবু দাউদ, বায়হাকি এবং অন্যান্য) বিখ্যাত আলেম ইবনুল আরাবি বলেছেনঃ ‘কলমের পূর্বে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।’ (আরেযাতুল আহওয়াযি) ভাষা না থাকলে কলম বা লেখার দরকারিতা বাতুলতা মাত্র।
আদম আ. কে সৃষ্টির মাধ্যমে দুনিয়াতে মানব বসতি শুরু হয়। আল কুরআন ও বাইবেলে আদম হাওয়া সৃষ্টি, জান্নাতে তাদের অবস্থান এবং পৃথিবীতে প্রেরণ সম্পর্কে আল্লাহ, ফিরিশতা, আদম ও ইবলিসের মধ্যে কথাবার্তার বিভিন্ন রেকর্ড আমরা দেখতে পাই। সেখানে কোনো ইশারা, ইঙ্গিত, প্রতীক, সংকেত ছিলো না। সে ভাষা অতি মাধুর্য, গাম্ভীর্যপূর্ণ, ব্যাকরণসিদ্ধ ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ।
ঐতিহাসিক ড. এম. আবদুল কাদের বলেন, আদম আ. সর্বপ্রথম পয়গাম্বর। আল্লাহ তাঁর নিকট আসমানি প্রত্যাদেশসমূহ প্রেরণ করেন।—আল্লাহ আদমকে কাবা নির্মাণের আদেশ দেন এবং জিবরাইল তাঁকে হাজ্জের আচার পদ্ধতি শিক্ষা দান করেন। (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ প্রথম খণ্ড, পৃ ১৫) আদম আ. এর পর আল্লাহ ইদরিস, নুহ, হুদ, সালেহ, হুদ, ইবরহিম, লুত, ইসহাক, ইসমাইল, ইয়াকুব, শুয়াইবসহ অগণিত নবি রসুল দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন বিপদগামী মানুষকে হেদায়েতের জন্য। ফিরিশতা, নবি, রসুলসহ বিভিন্ন যুগের মানুষেরা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করেছেন। এটা কোনক্রমেই মেনে নেয়া যায় না। তারা সবাই-ই মার্জিত ভাষায় কথা বলেছেন- ইহা মেনে নিতে আমরা বাধ্য। তাছাড়া নুহের কওম, লুতের কওম, আদ জাতি, ইরাম জাতি, নমরুদের জাতি, ফিরাউনের জাতি প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর সুনির্দিষ্ট ভাষা ছিলো।
আদম আ. মৃত্যুকালে শিছ আ. কে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। শিছ আ. কে তিনি দিন ও রাতের সময় নিরূপণ পদ্ধতি শিক্ষা দেন। নুহ আ. এর তুফানের খবর দিয়েছিলেন এবং দিনের প্রতি প্রহরান্তে নির্জনে বসে আল্লাহর ইবাদত করার হুকুম দিয়েছিলেন।—তিনি মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত মক্কায় বসবাস এবং হাজ্জের অনুষ্ঠানাদি পালন করতেন। আদম আ.ও স্বয়ং তাঁর নিকট অবতীর্ণ বাণীগুলো (৫০টি সহিফা) সংগ্রহ করেছিলেন এবং তদনুযায়ী নিজের জীবন পরিচালনা করেন। (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ৩৯৫-৩৯৬) অতএব সৃষ্টি সভ্যতার শুরু থেকেই ভাষা স্বমহিমায় বর্তমান। আর ভাষাটির নাম আরবি বা সামি।
আরবি বর্ণমালা সম্পর্কে ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেন, আরবি, ফিনিসিয়ান, হিব্রু, আরমায়িক, সুরিয়ানি প্রভৃতি বর্ণমালা মূল সামি বা সেমিটিক বর্ণমালা হতে উদ্ভূত। পাশ্চাত্য লিপিবিদগণ অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছেন যে গ্রিক, লাতিন, ইংরেজি প্রভৃতি ইউরোপীয় বর্ণমালার উৎপত্তিও সেই মূল সামি বর্ণমালা হতে। কেউ কেউ প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে, ভারতের ব্রাহ্মলিপিও এই সামি বর্ণমালা হতে উদ্ভূত হয়েছে। (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ প্রথম খণ্ড, পৃ ৭৪) এ-বিষয়ে, এ. সি. মুরহাউস Writing And The Alphabet কিতাবে পষ্ট ভাষায় বলেছেন-, বস্তুত বর্ণমালা আছে মাত্র একটি-ই। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র তাই ছড়িয়েছে এবং বিভিন্ন ছদ্মরূপ ধারণ করলেও মূলে যে তাই এক-ই, তাও চাক্ষুষ দেখানো যায়। হিন্দুদের পবিত্র শাস্ত্রগ্রন্থ সব-ই লেখা দেবনাগরী লিপিতে; মুসলিমদের কোরান লেখা আরবি লিপিতে, ওল্ড টেস্টামেন্ট হিব্রুতে এবং নিউ টেস্টামেন্ট লেখা গ্রিকে। এই সমস্ত লিপি বস্তুতঃ এক-ই মূল উৎস থেকে উদ্গত এবং তার-ই নানান রূপভেদ মাত্র। খৃ.পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্ধের শেষ দিকে নিকট-প্রাচ্যে বিশেষতঃ সিরিয়া ও প্যালেস্তাইনে ব্যবহৃত ঈষৎ-ভিন্ন এক গুচ্ছ সেমিটিক বর্ণমালা তাদের উৎসভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। মিঃ মুরহাউস আরও বলেছেন, সেমিটিক লিখনের আর-এক শাখা প্রাচীন ভারতের খরোষ্ঠী ও ব্রাহ্মী বর্ণমালা।’’
তবে লেখকের তৃতীয় বক্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁর বইয়ের তৃতীয় অধ্যায় শেষ করতে গিয়ে বলেছেন- এই অধ্যায় শেষ করার আগে আমরা সংক্ষেপে ইউরোপীয় লিপির উল্লেখ করব। দক্ষিণ সেমিটিক থেকে উদ্ভূত, সম্ভবতঃ তা সাবা দেশিয় (সাবা আল কুরআন ও বাইবেলোক্ত রানি বিলকিসের দেশ)। এখানে স্বরবর্ন-সমস্যা মেটানো হয়েছিল এই উপায়ে-সেমিটিক ব্যঞ্জন-চিহ্ন ব্যবহৃত হয়, ব্যঞ্জন যোগ অ বোঝাতে; অন্যান্য স্বরবর্ণের জন্য বিশেষ মাত্রা যোগ করা হত- কিন্তু ডায়াক্রিটিক্যাল চিহ্নের মত পৃথক না থেকে তা স্থায়ীভাবে ব্যঞ্জন-চিহ্নের সঙ্গে মিশে যায়। (উদ্ধৃতি: বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস দ্বিতীয় খণ্ড ,পৃ ৭৬-৭৭)