রিয়াজুল ইসলাম রিয়াজ
সূচনাপর্বে আরবি লিপি:
আরবি লিপি নগর সভ্যতার অন্যতম একটি প্রাচীন শৈলী। মুসলিম শিল্পকলার মধ্যে এটি নি:সন্দেহে সর্বাধিক পরিমার্জিত ও সুষমামণ্ডিত। মুসলমানদের উদ্ভাসিত, সর্বাপেক্ষা দীপ্তময় ও বিষ্ময়কর বিভূষণ, যার উত্থান-পতন ঘটেছে নগর সভ্যতার পালাবদলের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। আরব অধিবাসীদের মধ্য ধেকে বিশেষ করে হিজাজ অধিবাসীরা ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে ছিল বেদুইন বা যাযাবর জাতি। তারা লিখন বা পঠন শিল্পের মাধ্যমে তাদের জীবন অতিবাহিত করেনি, শিক্ষা-দীক্ষার কোন বাধা-ধরা নিয়ম বেদুইন জীবনে কোনোদিন ছিলোনা, এমনকি শিক্ষার সাথে তাদের কোন সম্পৃক্ততাও ছিলোনা। ফলে তাদেরকাছে হিজাজের কোন লিপিশিল্পের নিদর্শনও ছিলনা। তবে ইসলাম আগমনের পূর্বে তাদের এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। কেবল এ ব্যাপারে অতি উৎসাহীরা একান্ত ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এ পথে এগিয়ে আসে। তারা লিখন ও পঠন শিল্পে তথা শিক্ষার সাথে পরিচিত হয়। কারণ এ সময়ে তারা আরবের উত্তর-দক্ষিণ জুড়ে একটি সুসভ্য জাতির সাথে বসবাস করত যারা লিখন শিল্পে অসংখ্য নিদর্শন নকশা রেখেছে। যাদের মধ্য দুটি জাতি ছিলো বেশ প্রসিদ্ধ ‘উত্তরাঞ্চলের আল-আনবাত জাতি যারা নাবাতি ভাষায় লিখতেন এবং ইয়ামেনের হিমারীয় জাতি যারা মসনদি ভাষায় লিখতেন।’ তাদের মধ্য (আল আনবাত ও হিমারীয়) থেকে যারা লিখন ও পঠন শিল্পে পারদর্শী ছিলেন তাদের সংখ্যা ছিলো খুবই নগণ্য। যাদের আগমন ঘটেছে ইরাক এবং সিরিয়া শাম দেশ থেকে। উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে এবং একটি সুসভ্য জাতির সাথে সমপৃক্ত থাকার কারণে তারা শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক পারদর্শিতা লাভ করেছে। তাই তাদের নিকট থেকেই লিপিকলাটা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে এই আরবি লিপিকলাকে জন্ম দিয়েছে নাবাতি বা ছুরইয়ানি হস্তলিপি। তাই আরবি ভাষাকে লেখা হয় নাবাতি এবং ছুরইয়ানি এই দুটি লিপিকলা অনুযায়ী।
মূল আরবি লিপি:
ভাষা বিশ্লেষকদের মতে আরবি লিপির প্রাচীন রূপ হল (সেকেলে নসখি) নসখি রূপ এবং (সেকেলে কুফি) কুফি রূপ। তবে এ দুয়ের মধ্য প্রথমটি নাবাতি লিপির অনুগামী। আরবরা এই নাবাতি লিপিকলা শিক্ষালাভ করেছে সিরিয়ার আল আনবাত জাতিদের বিজ্ঞ পণ্ডিতদের থেকে। কথিত আছে যে দুমাতুল জনদল নামক স্থানের অধিপতি উকয়দর ইবনে আবদিল মালাকের ভাই বশার আল কিনদি মক্কায় এসে আবু সুফইয়ানের বোনকে বিবাহ করেন এবং মক্কায় কিছু সংখ্যক উৎসাহী ব্যক্তি তার নিকট আনবাতি অর্থাৎ নসখি লিপি শিখেন। আর দ্বিতীয়টি (কুফি রূপ) হল ছত্রানজালী আছ ছুরইয়ানী লিপির অনুগামী। এ লিপিতে সাধারণত ধর্মীও গ্রন্থ লেখা হত। আরবরা এই ছত্রানজালি আছ ছুরইয়ানি লিপিটা শিক্ষালাভ করেছে হিজরতের কিছু পূর্বে ইরাক থেকে। ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে কুফি লিপিটা পরিচিত ছিলো হিরীয় সম্প্রদায়ের সাথে। ৬৩৮ সালে কুফা নগরী প্রতিষ্ঠার প্রায় এক শতাব্দী কাল পূর্বে হিরা নগরীতে এর উদ্ভব হয়। কুফা প্রতিষ্ঠা হওয়ার পূর্বে হিরার দিকে সম্মন্ধ করে একে হিরা শৈলী বলা হয়। তবে মুসলিম প-িতদের মতে, নসখি লিপির শোভন সংস্কারের নাম কুফি।
কুফা নগরের নামানুসারে এর নমকরণ করা হয়েছে। ইসলাম পূর্ব যুগে হিরা ছিল ইরাকের একটি আরবি লিপি শহর। যা কুফার মুসলমানরা কুফার নিকটে নির্মাণ করেছিল। তাই উল্লেখিত লিপিকলাদ্বয়ের মূল হল আরবি লিপি অথবা আরবি লিপির ক্রমধারার শেষ (হালকা) পর্যায়। কারন আরবী লিপির উন্নয়নের ক্রমধারাকে কয়েকটি পর্যায় ভাগ করা হয়। যার প্রথম হালকা (পর্যায়) হলো আরামীয় লিপি যা প্রাচীন মিশরীয় লিপি থেকে গঠিত। এবং দ্বিতীয় হালকা (পর্যায়) হল, আরামীয় লিপি যা ফিনিকির এবং ছত্রাঞ্জালি আছ ছুরইয়ানি এই লিপিকলাদ্বয় গ্রহণ করা হয়েছে আরবী লিপিশৈলী থেকে।
আধুনিক আরবি লিপি:
আরবদের ধর্মীও আকাশে ইসলাম উদয় হওয়া পর্যন্ত আরবি লিপিকলাটি দুটি পরিচিত ধারায় অব্যহত ছিল। এটা সামান্যসংখ্যক লোকের মাঝে খুব কম বিস্তৃতির কারণে এবং সীমাবদ্ধ হওয়ায় আমাদের নিকট এ কথা বলতে সহজ হয় যে, তখনকার সময়ে (ইসলামের পূর্বে) আরব জাতি ছিলো একটি অশিক্ষিত জাতি। আর যখন আরব ভুখণ্ডের ধর্মীও আকাশে ইসলাম নামক সূর্যটি উদ্দিত হয়, তখন মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন তাদেরকে পবিত্র কুরআনে এই বলে নামকরণ করেছেন যে, আল্লাহর বানী: ‘তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন।’ (সূরা আল জুমুয়া, আয়াত: ০২)
আর ইসলাম অগমনের পরে আল কুরআন হল আরবি লিপির সর্বপ্রথম সমুন্নত ও সুউচ্চ মিনার। কেননা মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন তাঁর স্বীয় রসূল (সা.) এর ওপর এ ব্যাপারে যা অবতীর্ন করেছেন তা হলো: ‘পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।’ (সূরা আল আলাক: ১-৫) আর মহিয়ান আল্লাহ রব্বুল আলামিন তাঁর মহত্তকে উল্লেখ করে শপথ করে অন্য একটি সূরাতে বলেন যে, ‘নূন শপথ কলমের এবং সেই বিষয়ের যা তারা লিপিবদ্ধ করে।’ (সূরা আল কলম আয়াত: ০১)। ইসলাম আগমনের সূচনালগ্ন থেকেই রাসূল (সা.) এর সুযোগ্য লেখকবৃন্দের মাধ্যমে আরবী লিপির উৎকর্ষ শূরু হয়। এ যুগ থেকেই আরবি লিপিকলা পর্যায়ক্রমে এক সুন্দর লিখন শিল্প হিসেবে বিশ্বের দরবারে একটি স্থায়ী আসন লাভ করে। কেননা তাঁরা (লেখকবৃন্দ) বিভিন্ন প্রয়োজনে রসূল (সা.) এর নির্দেশে অহি লিখতেন এবং বিভিন্ন রাজা-বাদশাদের কাছে চিঠি-পত্র প্রেরণ করতেন। যিনি সর্বপ্রথম এই বিষয়ে ব্যপক পন্থায় প্রসারতার কাজ করেন তিনি হলেন একমাত্র রাসূল (সা.)। কেননা আরব জাতির মধ্য আরবি লিপির প্রসারতা ও সার্বজনীনতার ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন আগ্রহী ব্যক্তি এবং তিনি তা বেশ পছন্দও করতেন বটে। যার প্রমাণ রয়েছে বদরযুদ্ধের বন্দীদের সাথে রসূল (সা.) এর নমনীয় ব্যবহারের মাধ্যমে। কারণ বদর যুদ্ধের নিরক্ষর বন্দীদের ফিদইয়া বা মুক্তিপণ ছিলো সম্পদের বিনিময় এবং তাদের মধ্য শিক্ষিত বন্দীদের ফিদইয়া বা মুক্তিপণ ছিল প্রত্যেক বন্দীকে মদিনা অধিবাসীদের ১১ জন বালককে শিক্ষিত করা। আর এটাই ছিলো ইসলামের সর্বপ্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তখন থেকেই মুসলমানদের মধ্য লেখক তৈরির যাত্রা শূরু হয়। মক্কাতে যখন মুহাম্মাদ (সা.) রিসালাত নিয়ে আগমন করেন তখন আরবে যারা লেখা-পড়া জানত তাদের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। ঐতিহাসিক ওয়াকিদির (মৃ: ২০৭ হি:) বর্নণা অনুযায়ী মক্কায় তখন মাত্র ১৭ জন লোকে লিখতে পারত। তবে হিজরতের পরে এই লিপিকলার ব্যপক প্রচার শূরু হয়। এ ব্যাপারে পরস্পরের সহযোগিতাও বেড়ে যায়। রসূল (সা.) এর সাহাবিগণ ও খোলাফায়ে রাশেদিনগণ (রা.) এই পদ্ধতির অনুস্মরণ করেন। কিন্তু তাদের যুগের অধিকাংশ সৃষ্টিই লেখকবৃন্দের মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করেছিল। তাই তাদের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে অসংখ্য দাপ্তরিক (রাষ্ট্রীয়) চিঠি-পত্রের এবং মহাগ্রন্থ আল কুরআনের প্রসিদ্ধ লেখকবৃন্ধ। পক্ষান্তরে খোলাফায়ে রাশেদিনগন এবং অধিকাংশ মর্যাদাবান সাহাবায়েকেরাম (রা.) লেখনি শিল্পে পারদর্শী ছিলেন। তারা রাসূল (সা.) এর মর্যাদায় গীতি লিখেছেন। এটা ছিলো সাহাবায়েকেরামগণের (রা.) একটি শ্রেষ্ঠত্ত। তাই তাদের মধ্য যারা আরবী লিপি জানত, তীর পরিচালনা করতে পারত এবং সাতার জানত তাদেরকে আরবরা কামিল নামে নামকরণ করত। এ জন্যই তারা আরবি লিপি শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং পরস্পরে প্রতিযোগিতায় মেতেছে। তবে জ্ঞাত যে, ওই যুগে পবিত্র কুরআন ব্যতীত অন্য কোনো লিখিত কিতাব ছিলোনা। জামিউল কুরআন হযরত ওসমান (রা.) এবং তাঁর স্বনামধন্য লেখকবৃন্দ পবিত্র কুরআন লিখে সমাপ্ত করতেন। অতঃপর সমগ্র এলাকায় পৌছিয়ে দিতেন। তাই তারা ইসলামের প্রাথমিক যুগেই এর লিখিত কিতাব পেয়েছে এমনকি উহা লেখার ক্ষেত্রে পরস্পরে প্রতিযোগিতাও করেছে। তখন ওই এলাকায় এভাবেই লেখক সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রত্যেক লিপিশিল্পের জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব এলাকার লেখনী শিল্পে তাদের নির্দিষ্ট পন্থা অবলম্বন করেছে। এ সময় থেকেই আরবি লিপিকলা সর্বক্ষেত্রে সমুন্নত হল এবং বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে পরল।
রিয়াজুল ইসলাম রিয়াজ
জাতীয় শ্রেষ্ঠ শিক্ষক
(এমফিল স্কলার ও পিএইচডি গবেষক)