মাহমুদ ইউসুফ ||
আবহমানকাল থেকেই বরিশাল প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন। বন্যা, তুফান, ঘূর্ণিঝড়, হারিকেন, সাইক্লোন, টর্নেডো, কালবৈশাখী, জলোচ্ছ্বাস, সামুদ্রিক ঝড়, প্লাবন, ঝটিকাবর্ত, প্রলয়, বজ্রবিদ্যুৎ প্রবল প্রতাপে হানা দেয় দক্ষিণ বাংলায়। এখানে বিপদ আসে বার বার। বেদনা, হতাশা, গ্লানি, ট্রাজেডিতে লোকসমাজ ভারাক্রান্ত। ভাই তার বোনকে হারায়, পিতা তার সন্তানকে হারায়, স্ত্রী তার স্বামীকে হারায় আবার কোনো কোনো পরিবারই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তুফান বানে। দুর্যোগের সাথে যুদ্ধ করতে করতেই শিশু কিশোররা বড় হয়। পানিভাগের সংখ্যাধিক্য থাকাতেই ঝড়-বন্যার মুখোমুখি হতে হয় প্রতিবছর। প্রাচীনকাল থেকেই দুর্যোগ দুর্দশা আমাদের নিত্য সঙ্গী। বন্যা, ঝড়-তুফানের সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও জাগরুক মহকালের আয়নায়। সাগরবক্ষে হারিয়ে গেছে এ অঞ্চলের জানা-অজানা কত প্রাণ, কত ঐতিহ্য, কত কীর্তি, কত স্থাপনা। অতি আদিকালের সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও মুঘল যুগ থেকে বরিশালের বিবরণীতে বন্যার একটি মোটামুটি চিত্র পাওয়া যায়। সেসব নিয়েই আজকের আয়োজন।
১৫৫৮
সম্রাট আকবরের রাজত্বের উষালগ্নে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে এক ভয়ঙ্কর ঝড় ও পানিপ্লাবন হয়। পাঁচ ঘণ্টার অধিককাল সে ভয়ঙ্কর ঝটিকাবর্ত স্থায়ী হয়। প্রায় দুই লাখের অধিক মানুষের সলিল সমাধি ঘটে। তৎকালে এখানকার গভর্নর ছিলেন রাজা পরমানন্দ বসু (১৫২০-১৫৭০)। বাঙলার স্বাধীন সুলতান ছিলেন গিয়াসুদ্দিন বাহাদুর শাহ (১৫৫৫-১৫৬০)।
১৫৬৪
বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা জলোচ্ছ্বাসে সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি চাষের জমিতে উঠে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। কমিয়ে দেয় উর্বরা শক্তি। প্রাণহানি তো ছিলোই। স্থানীয় শাসক ছিলেন রাজা পরমানন্দ বসু। আর বাঙলার স্বাধীন নরপতি ছিলেন সুলায়মান খান কররানি (১৫৬৩-১৫৭৩)।
১৫৮২
প্রবল হারিকেন বাতাসসহ বাকেরগঞ্জের ওপর দিয়ে অতিক্রম করে। সরকার বাকলা মহাক্ষতির সম্মুখীন হয়। ঝড়ের আঘাতের ক্ষতির মাত্রা লিপিবদ্ধ হয় এভাবে- হারিকেন ও বজ্রপাতে বাকেরগঞ্জ-পটুয়াখালীর উপকূলবর্তী বাড়িঘর এবং নৌকা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। লোকালয় লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। অগুনতি বনি আদম মৃত্যুমুখে পতিত হয়। মুঘল সুবাদার ছিলেন খান ই আজম। এ সময়ে রাজা জগদানন্দ বসু (১৫৭০-১৫৮৪) সরকার বাকলা শাসন করতেন।
১৫৮৪
পাঁচ ঘণ্টার হারিকেন এবং বজ্রপাতসহ ঝড় বাকেরগঞ্জ নিকটবর্তী উপকূলের ঘর ও নৌকা ধবংস করে। শুধু শক্ত ভিত্তির ওপর গড়া মন্দির রক্ষা পায়। মৃত্যু পরিসংখ্যান দুই লাখে পৌঁছে। জনসংখ্যা ছিলো প্রায় চার লাখ। মুঘল সুবাদার ছিলেন শাহবাজ খান (১৫৮৪-১৫৮৭)। রাজা জগদানন্দ বসু তুফানে নৌকা ডুবে মারা যায়। রাজকুমার কন্দর্প নারায়ণ রাজপরিবারের লোকজন নিয়ে মন্দিরের চূড়ায় উঠে আত্মরক্ষা করেন।
১৫৮৫
ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় মেঘনা নদীর মোহনায় বাকেরগঞ্জের পূর্বদিকে আঘাত হানে, বিনষ্ট হয় খেতের ফসল। সমগ্র ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণ পরিসংখ্যান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। বাকলার গভর্নর ছিলেন রাজা কন্দর্প নারায়ণ (১৫৮৪-১৫৯৮)। মুঘল সুবাদার ছিলেন শাহবাজ খান।
১৬৮৮
নদী ও সাগর থেকে উত্থিত প্রবল ঝড়ে প্রায় ৬০ হাজার লোক মারা যায়।
১৬৯৯
তীব্র ঘূর্ণিঝড় সুন্দরবন উপকূলে আঘাত হানে।
১৭০৭
এক খণ্ড প্রলয় ঘটে। ঝালকাঠির জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এছাড়া পটুয়াখালীর বন-বনানির ব্যাপক ক্ষতি হয়।
১৭৩৭
এ ঝড়ে প্রায় ৩০ হাজার লোক নিহত হয়। বৃক্ষরাজি উপড়ে পড়ে, পশুপাখির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
১৭৬৩
ঝড় ও ভূমিকম্পে পিরোজপুরে ভাণ্ডারিয়ার রামপুর চেচরি বিলের সৃষ্টি হয়। সেটা দর্শনীয় স্থান হিসেবে খ্যাত।
১৭৬৭
বরিশাল-বাকেরগঞ্জের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাতপ্রাপ্ত ঘূর্ণিঝড়ে ৩০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল বলে জানা যায়। এ ঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিলো ৪৩ ফুট।
১৭৬৯
বাংলা ১১৭৬ সালে অনেক জনপদ ধ্বংস হয়। ভয়াবহ ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
১৭৭৩
ঝড় জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিকম্পে অশেষ বিপদের সম্মুখীন হয় জনতা। মানুষ, গবাদিপশু, গাছপালা, পথঘাট বিপর্যস্ত হয়।
১৭৮৬
মেঘনা নদীর বানে তীরবর্তী গ্রামের ফসল ও জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। এর প্রকোপে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে বাকেরগঞ্জে ব্যাপক প্রাণহানি। গবাদি পশু প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
১৭৮৭
ভূমিকম্প ও ভয়াবহ বন্যার ফলে তিস্তার গতিপথ বদলে যায়। এর ফলে উত্তরবঙ্গের নদীগুলো স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলে। বরিশালেও এর প্রভাব পড়ে মারাত্মক। পদ্মার স্রোত আড়িয়াল খাঁ দিয়ে প্রবল বেগে প্রবাহিত হয়। ফলে একরাতে হঠাৎ নয়া ভাঙ্গানী নদীর (মুলাদী নদী) সৃষ্টি হয় এবং মেঘনা নদীর সাথে ছবিপুর নদী হিজলা-মুলাদীর নিকট মিলিত হয়। এ সময়েই হিজলা বা উত্তর শাহবাজপুর ও ভোলার অনেকাংশ ভেঙ্গে যায়। দক্ষিণ শাহবাজপুর বা ভোলা এ সময় হতে উত্তর শাহবাজপুর ও বরিশালের মূল ভূখণ্ড হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ভোলা, দৌলতখাঁ ও তজুমদ্দিন থানার এক বৃহৎ অংশ বিলীন হয়ে যায়। শ্রীরামপুর, মাইজারদী ও ইদিলপুর ছিলো সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা।
১৭৯০
এ বন্যায় পটুয়াখালীতে পশু-পাখি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৮২২
মে মাসে ঘূর্ণিঝড়, সাথে বয়ে আনা জলোচ্ছ্বাস ও উত্তাল ঢেউ বরিশাল, হাতিয়া দ্বীপ ও নোয়াখালীতে আঘাত হানে। ৩৯ হাজার ৯৪০ ব্যক্তি ও ১৯ হাজার গবাদিপশু মারা যায় এবং ১৩ কোটি টাকা মূল্যের সহায়সম্পদ ধ্বংস হয়। এটি গোলকযোগ নামে পরিচিত। জুন মাসে আরেকটি প্রবল সাইকেèান সংহার মূর্তিতে ধেয়ে আসে। জুনের ৬-৯ তারিখে বরিশাল-বাকেরগঞ্জ অঞ্চলে বয়ে যাওয়া এ ঘূর্ণিঝড়ে ৫০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়। প্রায় ১ লাখ গবাদিপশু মারা যায় এ ঝড়ে।
১৮২৫
তৎকালে দক্ষিণ বাংলায় কোনো গুরুত্বপূর্ণ বাঁধ বা অন্যকোনো ধরনের বন্যা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ছিলো না। ফলে বাকেরগঞ্জ ও এর আশপাশে বিধ্বংসী বন্যা প্রবল বেগে আছড়ে পড়ে।
১৮৩১
অক্টোবর মাসে সংঘটিত বন্যায় বরিশাল ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কবলে পড়ে।
১৮৩২
এ বন্যায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে পটুয়াখালী।
১৮৩৯
১৯-২১ সেপ্টেম্বর তারিখে সুন্দরবন হয়ে বাকেরগঞ্জের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়।
১৮৫২
১২-১৫ মে সুন্দরবনের ওপর দিয়ে অতিক্রম করে।
১৮৫৪
এ বন্যায় প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক। পটুয়াখালীর ওপর আঘাত হানে।
১৮৫৫
এ বন্যায় মানুষ মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। তবে প্রাকৃতিক সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৮৬২
পানি প্লাবনে বাকলায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতি। ফসল, ফলফলাদির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
১৮৬৪
১০ মে, ২রা জ্যৈষ্ঠ ১২৬৯। প্রচণ্ড ঝড়ে অনেক জনপদ ধ্বংস হয়। এ ঝড়কে জ্যৈষ্ঠের ঝড় বলা হয়। অসংখ্য বনি আদম, গবাদি পশুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও ভূমিকম্প হয়। এ ঝড়কে কেন্দ্র করে নিম্নরূপ প্রবাদ আছে-
তালগাছে বিড়ালের ছাও শালিক নেয়ট পাড়ে
কত মানুষ মারা গেল জ্যৈষ্ঠ মাসের ঝড়ে।
১৮৬৭
১লা নভেম্বর তারিখে বিধ্বংসী বন্যার কবলে পড়ে বাকেরগঞ্জ। শস্যের ব্যাপক ক্ষতি। দক্ষিণ শাহবাজপুর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৮৬৯
১৬ মে তারিখে ঝড়ের তাণ্ডবে বাকলা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। স্টেশন রোডসমেত অন্যান্য সড়ক ডুবে যায়। সুপেয় পানি দূষিত হয়। শুরু হয় মহামারী। মহামারীতে ভোলার এক দশমাংশ লোক মারা যায়।
১৮৭০
এ ঘূর্ণিঝড়ে রাস্তাঘাট ও গ্রামাঞ্চল মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৮৭৬
গ্রেট বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন। বরিশাল ও পটুয়াখালী দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। শুরু ২৯ অক্টোবর, বিলুপ্তি ১ নভেম্বর। ভয়াবহ আঘাতের সময়টা ছিলো ১৬ কার্তিক ১২৮৩। গতিবেগ ঘণ্টায় ২২০-২৩০ কিমি। মেঘনা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬.৭১ মিটার স্ফীত হয় গলাচিপা ও বাউফল ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে। পানি সমুদ্রতট থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪০ ফিট ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ২ লাখ ১৫ হাজার লোকের জীবনহানি। বন্যার অব্যবহিত পরে কলেরার প্রাদুর্ভাব। আরও অধিক মানুষ মারা যায় দুর্যোগ পরবর্তী মহামারী এবং দুর্ভিক্ষে। প্রাণহানি ও ভয়ঙ্করের দিক থেকে পৃথিবীর ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাসে ষষ্ঠ স্থান। নোয়াখালী ও চট্টগ্রামও বিপর্যস্ত হয় এ ঝড়ে।
১৮৮২
বড় ধরনের ঝড়ের কবলে পড়ে উপকূলীয় এলাকা।
১৮৮৫
প্রলয়ঙ্কারী ঝড়। লোকালয় বিনষ্ট, নৌকাডুবি।
১৮৯০
পটুয়াখালী-বরগুনার এ ঝড়ে রাস্তাঘাট ও গাছপালার মূলোচ্ছেদ ঘটে।
১৮৯৫
১৩০২ বঙ্গাব্দের ১৫ ও ১৬ আশি^ন প্রবল ঝড়ে বরিশাল শহরের বেশিরভাগ গৃহাদি ও বহুসংখ্যক বৃক্ষ উপড়ে পড়ে।
১৮৯৭
এ ঝড়ে জনমানুষের তেমন ক্ষতি না হলেও প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
১৯০৯
১৭ আশি^ন ১৩১৬ বঙ্গাব্দে প্রচণ্ড ঝড়ে ক্ষতবিক্ষত হয় বরিশাল।
১৯১০
পাথরঘাটার কালমেঘা ও ভোলার মনপুরা দ্বীপে প্রচণ্ড আঘাত হানে। ফসলহানি ও জানমালের বিশেষ ক্ষতি হয়।
১৯১২
বরগুনা-পটুয়াখালীতে এ ঝড় আঘাত হানে।
১৯১৯
মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ের সাথে তীব্র স্রোত মেঘনা নদীর পূর্ব মোহনায় আঘাত হানে, প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি। সেপ্টেম্বর মাসে আরেকটি সামুদ্রিক ঝড় বয়ে যায় বাকেরগঞ্জের ওপর দিয়ে।
১৯৪০
ঝড়-তুফানে পটুয়াখালী জেলা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। লোহালিয়া নদীতে ‘মেঘনা’ নামক স্টিমার যাত্রীসহ ডুবে যায়।
১৯৪১
২২-২৬ মে ঝড় আঘাত হানে। মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার। ভোলা, বরিশাল ও নোয়াখালীর ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল এ ঘূর্ণিঝড়। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ভোলা অঞ্চল। এ ঝড়ে সৃষ্টি হওয়া জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিলো ১০-১২ ফুট।
১৯৪২
অক্টোবর মাসে তীব্র ঘূর্ণিঝড় সুন্দরবনের উপর আঘাত হানে। ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক। উল্লেখ্য ওই সময় বরিশাল জেলার উল্লেখযোগ্য অংশে সুন্দরবন বিস্তৃত ছিলো।
১৯৫০
এ বছরের বন্যা ভয়াবহ না হলেও অল্পবিস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিভিন্ন পেশার মানুষ।
১৯৫৭
ঝড়ে পটুয়াখালী জেলায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
১৯৫৮
১৬-১৯ মে ঘূর্ণিঝড়ের সাথে তীব্র স্রোত মেঘনা নদীর পূর্ব পশ্চিম মোহনার পূর্ব বরিশাল ও নোয়াখালীর ওপর আঘাত হানে। ক্ষয়ক্ষতি: ৮৭০ অধিবাসী, ১৪,৫০০ গবাদি পশু এবং খেতের ফসল বিনষ্ট হয়।
১৯৬০
৯-১০ অক্টোবর তীব্র ঘূর্ণিঝড় পূর্ব মেঘনা নদীর মোহনার নিকটবর্তী বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, নোয়াখালী ও পটুয়াখালীর ওপর দিয়ে বয়ে যায়। ঝড়ো হাওয়ার তীব্রতা ছিলো ২০১ কিমি/ঘণ্টা পর্যন্ত। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিলো ৩.০৫ মিটার। চর জব্বার, চর আমিনা, চর ভাটিয়া, রামগাতি, হাতিয়া ও নোয়াখালী ব্যপকভাবে বিধ্বস্ত হয়। ক্ষয়ক্ষতি: ৩ হাজার অধিবাসী মারা যায়, এছাড়া অন্যান্য প্রতিক্রিয়া হিসাবে ৬২ হাজার ৭২৫ টি বাড়ি, ৯৪০০ একর জমির ফসল বিনষ্ট হয়। এর কদিন পরেই ৩০-৩১ অক্টোবর ঘণ্টায় ২১০ কিমি গতির তীব্র ঝড়ো বাতাসসহ প্রবল ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, পটুয়াখালী এবং পূর্ব মেঘনা মোহনায়। ঝড়ের জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ৪.৫-৬.১ মিটারে পৌঁছে। ক্ষয়ক্ষতি: অনুমানিক ১০ হাজার অধিবাসী, ২৭ হাজার ৭৯৩ গবাদি পশু, ৫৬৮ হাজার ১৬১টি বাড়ি বিনষ্ট হয়। হাতিয়া সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। এছাড়া দুইটি সমুদ্রগামী জাহাজ তীরের উপর উঠে আসে এবং ৫-৭টি বড় নৌকা কর্ণফুলী নদীতে ডুবে যায়।
১৯৬১
ঘূর্ণিঝড়ে অগুনতি মানুষ নিহত হয়। পটুয়াখালী জেলার সকল বন্দর, গঞ্জ, হাটবাজার, বাড়িঘর ডুবে যায়।
১৯৬৫
৯-১২ মে’র ঝড়ে মৃতের মিছিলে শরিক হয় ১৯ হাজার ২৭৯ জন বনি আদম। এ ঝড় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়ে ১১ মে মধ্যরাতে আঘাত হানে বারিশাল ও বাকেরগঞ্জে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিলো ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার। জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা ৩.৭ মিটার। এতে বরিশাল, নোয়াখালী, খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, ঢাকা এবং চট্টগ্রাম অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই বছরের ১৪-১৫ ডিসেম্বর তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে কক্সবাজার ও পটুয়াখালীর নিকটবর্তী উপকূলীয় অঞ্চলে, ঝড়ের প্রভাবে জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায় ৪.৭-৬.১ মিটার। কক্সবাজারে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ২১০ কিমি/ঘণ্টা। ক্ষয়ক্ষতি: ৮৭৩ জন অধিবাসী ও ৪০ হাজার লবণের বেড় বিনষ্ট হয়।
১৯৬৬
১ অক্টোবর তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বাকেরগঞ্জ, সন্দ্বীপ, খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লায়। ঝড়ের প্রভাবে জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায় ৪.৭-৯.১ মিটার। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিলো ১৪৬ কিমি/ঘণ্টা। ক্ষয়ক্ষতি: ১৫ লাখ অধিবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ৬৫ গবাদি পশু মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
১৯৬৭
এ বছরে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়েরর বর্ণনা পাওয়া যায়।
১৯৭০
৭-১৩ নভেম্বর ভোলা সাইক্লোন। ভোলা ঘূর্ণিঝড় পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চল, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, চর বোরহানুদ্দিনের উত্তর পাশ, চর তাজুমুদ্দিন, চট্টগ্রাম, মাইজদি ও হরিণঘাটার দক্ষিণ পাশ সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মৃত্যুর সংখ্যা ৫ লাখ। ক্ষতির মধ্যে আনুমানিক ২০ হাজার জেলে নৌকা, শস্য ও সম্পদ। গবাদিপশু মৃত্যু প্রায় ১০ লাখ, বাড়িঘর ৪ লাখ এবং ৩ হাজার ৫০০ শিক্ষাকেন্দ্র বিধ্বস্ত হয়। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিলো ২২২ কিমি/ঘণ্টা এবং ঝড়ের প্রভাবে জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায় ১০.৬ মিটার। এটি সিম্পসন স্কেলে তৃতীয় মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিলো।
১৯৭৩
৬-৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের নিকটবর্তী উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়টির সাথে তীব্র স্রোত আঘাত হানে। বরগুনা, পটুয়াখালী ও তার নিকটবর্তী এলাকা সমূহ প্রবল জলোচ্ছ্বাসে নিমজ্জিত হয়।
১৯৭৪
জুলাই-আগস্ট মাসে দেশ মারাত্মক বন্যায় আক্রান্ত হয়। পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, বন্যায় পটুয়াখালী জেলায় ১৭ বর্গমাইল এলাকা প্লাবিত হয় এবং প্রায় ১৩ হাজার বাড়িঘর কমবেশি বিনষ্ট হয়।
১৯৭৫
৯-১২ মে একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ভোলা, কক্সবাজার ও খুলনাকে বিধ্বস্ত করে দেয়। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিলো ৯৬.৫ – ১১২.৬ কিমি/ঘণ্টা।
১৯৭৭
৯-১২ মে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে পটুয়াখালী, বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা, নোয়াখালী ও সমুদ্রমুখী দ্বীপসমূহে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিলো ১১২.৬৩ কিমি/ঘণ্টা।
১৯৮৩
৫-৯ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রাম, কুতুবদিয়া নিকটবর্তী বরিশাল, পটুয়াখালী, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, উখিয়া, মইপং, সোনাদিয়া ও নোয়াখালীর ওপর আঘাত হানে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিলো ১৩৬ কিমি/ঘণ্টা, জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা ১.৫২ মিটারে পৌছায়। ক্ষয়ক্ষতি: ৩০০ জন জেলের এবং ৫০টি জেলে নৌকা নিখোঁজ ও দুই হাজার বসতবাড়ি ধ্বংস হয়।
১৯৮৬
৮-৯ নভেম্বর তীব্র ঘূর্ণিঝড় বরিশাল, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালীর নিকটবর্তী উপকূলীয় অঞ্চল ও চরসমূহে আঘাত হানে। চট্টগ্রামে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিলো ১১০ কিমি/ঘণ্টা, খুলনা ৯০ কিমি/ঘণ্টা। ক্ষয়ক্ষতি: ১৪ জন অধিবাসী, ৯৭২ কিমি জমির ধান বিনষ্ট হয়। বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার বিদ্যালয়, মসজিদ, গুদামঘর, হসপিটাল, বসতবাড়ি এবং স্থাপনাসমূহ বিধ্বস্তের আওতায় থেকে যায়।
১৯৮৮
আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বন্যায় ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। ২৪-৩০ নভেম্বর তীব্র ঘূর্ণিঝড়টি যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় প্রচন্ড আঘাত হানে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিলো ১৬২ কিমি/ঘণ্টা। একই সাথে ছিলো জলোচ্ছ্বাসের আঘাত যা মংলা বন্দরে পরিমাপ করা হয় ৪.৫ মিটার। মৃতের সংখ্যা ১২ সহস্রাধিক। সুন্দরবনের অসংখ্য বন্যপ্রাণী, ১৫ হাজার হরিণ, ৯টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার, ৬৫ হাজার গবাদিপশু মারা যায়। বিনষ্ট হওয়া ফসলের মুল্য আনুমানিক ৯.৪১ বিলিয়ন টাকা। ভারতের ফারাক্কা আগ্রাসনেই এসব পানি বন্যার সৃষ্টি হয়।
১৯৯১
২৯ এপ্রিল শেষ রাতের দিকে আঘাত হানে। ঝড়টি জন্ম নেয় ভারত মহাসাগরে এবং ২০ দিন পর ঘূর্ণিঝড়ের আকার নিয়ে বঙ্গোপসাগর উপকূলে পৌঁছে। পটুয়াখালীতে এর গতিবেগ ছিলো ১৮০ কিমি/ঘণ্টা। তবে চট্টগ্রামে ছিলো অনেক বেশি। ঘূর্ণিঝড়টিতে সম্পদের ক্ষতি হয় ৬০ বিলিয়ন টাকা। এর মাত্র দুই মাস পর ৩১ মে-২ জুন ঝড়-তুফান আঘাত হানে পটুয়াখালী, বরিশাল, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রামের নিকটবর্তী উপকূলীয় দ্বীপ ও চরসমূহে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিলো ১১০ কিমি/ঘণ্টা এবং জোয়ারের উচ্চতা ১.৯ মিটার।
১৯৯৭
১৬-১৯ মে ঘূর্ণিঝড়, বাংলাদেশ আঘাত হানে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী এবং ভোলা জেলার নিকটবর্তী দ্বীপ ও চর সমূহে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিলো ২২৫ কিমি/ঘণ্টা এবং ঝড়ের কারণে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা দাঁড়ায় ৩.০৫ মিটার। পরবর্তীতে ২৫-২৭ সেপ্টেম্বর তীব্র ঝড় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী ও ভোলার নিকটবর্তী উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিলো ১৫০ কিমি/ঘণ্টা এবং ঝড়ের কারণে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিলো ১.৮৩-৩.০৫ মিটার।
১৯৯৮
১৯-২২ নভেম্বর ৯০ কিমি/ঘণ্টা বেগে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়টির জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিলো ১.২২-২.৪৪ মিটার। বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, খুলনার ওপর দিয়ে বয়ে যায়। ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাঁধের অশুভ প্রতিক্রিয়ায় একই বছর দেশের সিংহভাগ এলাকা প্লাবিত হয়।
চলতি শতকের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়-তুফান, দুর্বিপাক ও প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিবার্তা সম্পর্কে মানুষমাত্রই ওয়াকিবহাল। সিডর, বুলবুল, মহাসেন, আইলা, আম্ফান প্রভৃতি জাতিকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। সামুদ্রিক সাইক্লোন সিডরের ভয়াবহতা নাগরিকরা স্মরণ করবে বহু শতাব্দী। একালের সব দুর্যোগকে টপকে গেছে মরণঘাতী সিডর। সিডরসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক আগ্রাসনে সুন্দরবন ঢাল হয়ে আমাদের রক্ষা করে আসছে যুগের পর যুগ। জীবন ও দেশরক্ষাকারী সেই সুন্দরবন ধ্বংসে চলছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ নানাবিধ আয়োজন।
তথ্যসূত্র:
১. এ. এফ. এম আব্দুল জলীল: সুন্দরবনের ইতিহাস
২. সিরাজ উদদীন আহ্মেদ: বরিশাল বিভাগের ইতিহাস
৩. আজিজুল হক বান্না: বরিশালে ইসলাম
৪. বৃন্দাবনচন্দ্র পূততুণ্ড: চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাস
৫. রোহিনীকুমার সেন: বাকলা
৬. সিকদার আবুল বাশার: ঝালকাঠি জেলার ইতিহাস
৭. খোসালচন্দ্র রায়: বাকরগঞ্জের ইতিহাস
৮. হেনরি বেভারেজ: দি ডিস্ট্রিক্ট অব বাকেরগঞ্জ
৯. মেজর জেনারেল এম এ লতিফ: বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার বাখরগঞ্জ
১০. মেজর জেনারেল এম এ লতিফ: বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার পটুয়াখালী
১১.সিকদার আবুল বাশার: পটুয়াখালী জেলার ইতিহাস
১২. উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট ও বিভিন্ন খবরের কাগজ।