শাহরিয়ার মাসুম ।।
মানুষের পুরো জীবনটাই কর্মক্ষেত্র। আর কর্মক্ষেত্র মানেই নানাবিধ চাপের সমাহার। তাই চাপে পিষ্ট না হয়ে মোকাবেলা করতে পারাটাই সফলতা। তবে চাপ সামাল দেয়া অতটা সহজ কাজও নয়। একটা সামাল দিতে গেলে জন্ম নেয় আরেক কিসিমের চাপ। সেটা সামাল দিতে না দিতেই আবার নতুন চাপের মুখোমুখি। তো এই চাপময় জীবনে সবচেয়ে মজাদার হলো গরুর চাপ। সালাদ সহযোগে ঝাল ঝাল চাপ নিমিষেই সাবাড় করে দেয়া যায়। সঙ্গে পরোটা হলে তো জমে ক্ষীর। কানাবগির ছা’য়ের মতো গাপুস গুপুস কয়েক প্লেট সাবাড় করে তৃপ্তির হাসি নিয়ে ঘুমুতে যাওয়া ডালভাত। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে এই ডালভাত টেনে নিয়ে আসে উচ্চ রক্তচাপ।
উচ্চতর সেই চাপ সামাল দিতে ধরনা ধরতে হয় তেঁতুল শরবতের। তেঁতুল খেতে খেতে উচ্চ রক্তচাপ রূপান্তরিত হয়ে নিম্নচাপের দিকে ধাবিত হয়। তখন আপনাকে ইহজগতের মায়া থেকে খানিকটা ছুটি নিয়ে ইল্যুশন জগতে প্রবেশ করতে হবে। সেই জগতের বাহন যদি হয় কমোড, তাহলে আপনি কিছুটা অবকাশ পাবেন চাপ সামলানোর পাশাপাশি ইহজগত নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হওয়ার। আর কমোড ব্যাতিত অন্য কিছু হলে, চাপ ট্রান্সফার হয়ে পায়ে চলে আসবে। পায়ের চাপ সইতে না পারার দরুণ তীব্র প্রতিবাদের মুখে তড়িঘড়ি কাজ সমাধা করে কট্টাস করে দরজা খুলে শান্তিময় তৃপ্তির হাসি দিতে পারবেন ঠিকই।
কিন্তু সামনে জলজ্যান্ত বউয়ের মূর্তি দেখে সেটা আর সম্ভব হবে না। বাজারের লম্বা ফর্দ হাতে ধরিয়ে দিয়ে পাটায় পুতা পেষার মতো করে দাঁতে দাঁত পিষে বলবেন, ‘রাতে দেরি করে ফিরেছেন নবাব, বাজার টাজার কিচ্ছু হয়নি। এখন ঝটপট এই জিনিসগুলো না আনলে, ইঁদুরের মাটি খেতে হবে।’
ব্যাস, খেয়ে গেলেন কেস। নিম্নচাপ ও উর্ধ্বচাপের মধ্যবর্তী লেভেলের এই চাপ কোন সালাদ দিয়ে সাবাড় করবেন, সেটা ভাবতে ভাবতে বাজারের দিকে হাঁটতে থাকুন। তবে খেয়াল রাখবেন, ঝাল যেন বেশি হয় সালাদে। মিষ্টি সালাদে চাপ হজম হবে না। যাইহোক, ঝাল কিংবা মিষ্টি সালাদে চাপ হজম করে বাজারে প্রবেশ করেই দেখলেন মূল্যতালিকার উর্ধ্বচাপ। আর পকেটে বিরাজমান মাস শেষের লঘুচাপ। এই উর্ধ্বচাপ ও লঘুচাপের বিপরীতমূখী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট নতুন চাপ মোকাবেলায় ধার করতে হবে সালাদ। ধারের সালাদে চাপ সামাল দিয়ে চারটা ডালভাত নাকেমুখে চালান করে কোনোমতে ধরলেন সকালের বাস। ‘অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে’ সেই টেনশনে ঠিক কতজনের চাপ হজম করে বাসে উঠতে পেরেছেন, তা এখন আর আপনার স্মৃতিতেও সংরক্ষিত নেই।
বাসের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে সামনে থেকে পেছনে ঠাণ্ডা মাথার খুনির মতো সবগুলো সিট গুনে গুনে দেখলেন, ঠিকই আছে। একটা সিটও কম নেই। সমস্যা একটাই, খালি নেই কোনোটা। পেঁয়াজ ও রোশনের মিশ্রিত পারফিউমের গন্ধ আসছে নাকে। উৎস খুঁজতে গিয়ে সাময়িক একটা স্নায়বিক চাপে পড়ে গেলেন। চোখ দুটো কয়েকবার অর্ধচন্দ্রাকারে ঘুরিয়ে আনার পর আবিস্কার করলেন, আপনার নাকখানা বাসের হ্যান্ডেল ধরা এক ভদ্রলোকের ঠিক বগলের কাছে। মগজের নেভিগেশন দপ্তরে সিগন্যাল পাঠিয়ে নাকখানা ঘুরিয়ে পারফিউম থেকে আপাত মুক্তি ঘটলেও, ঠোঁটের ওপর তুষারপাতের উপস্থিতি টের পেয়ে আবার ভড়কে গেলেন। তাকিয়ে দেখলেন, ষাট ছুঁই ছুঁই এক ভদ্রলোকের ‘মোটিভেশনাল’ ঠোঁটের ফাঁক গলে এই তুষারপাত হচ্ছে। দেশকে রসাতল থেকে উদ্ধারে ডেল কার্নেগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া প্রবীণ নাগরিকের ‘তুষার’ উপহারে আপনার মনে অস্বস্তিকর যে সাময়িক চাপ তৈরি হয়েছে, সেটা প্যাসকেলে মাপা যাবে না। তারচেয়েও বড় চাপ অনুভব করলেন, ব্যাটার কোনো মোটিভেশনের সঙ্গেই একমত হতে না পারার কষ্টে। একদিকে পেঁয়াজপট্টি, রোশনপট্টি, অন্যদিকে তুষারপাত। মুখখানা ঘোরানোর চান্সও খুঁজে পাচ্ছেন না। এটা সত্যিকার অর্থেই একটা বড় ধরনের স্নায়বিক চাপ। কী আর করবেন! মনকে সান্ত্বনা দিতে থাকুন, কয়েকটা মিনিট গেলেই ব্যাটার মুখ শুকিয়ে রাজস্থান কিংবা সাহারা হয়ে যাবে। তখন সেই মরুতে উট চরিয়ে লু হাওয়ার স্বাদ নিতে নিতে পরাবাস্তবতায় হারিয়ে যাবেন।
বাস থেকে নেমে কিছুটা চাপমুক্ত হয়ে অফিসে ঢুকে দেখলেন ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা মিনিটের কাঁটাকে চাপ প্রয়োগ করছে। ‘আরে ব্যাটা, এই গরমের মধ্যে আমি পাঁচবার ঘুরে এলাম, আর তুই এখনো পাঁচ ছুঁতে পারছিস না। সমস্যাটা কী?’ চাপমুক্ত মাথা হওয়ায় আপনি কাঁটাদ্বয়ের কথোপকথনে বুঝে গেলেন, এখন দশটা বেজে পাঁচ মিনিট। কাচের দেয়াল ভেদ করে এক জোড়া কটমটানো চোখ আপনাকে পর্যবেক্ষণ করছে সিসি ক্যামেরার মতো। এবার আপনি অনেকটাই চাপ অনুভব করলেন। এই চাপ খাওয়ার সালাদ আপনার সংগ্রহে নেই। তারচেয়ে বরং প্যাসকেলে মেপে ডায়রির এক কোনায় লিখে রাখতে পারেন। আর যদি দেখেন কাচের দেয়ালের প্রোকোষ্ঠ থেকে কোনো নিমন্ত্রণ আসছে না, তাহলে ধরে নেবেন এটা নিম্নচাপের পূর্বাভাস। দিনের যে কোনো সময়ে বায়ুশূণ্য অবস্থা তৈরি হবে এবং সেখান থেকে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে আপনার মনাঞ্চলে হালকা ও মাঝারি ধরনের বর্ষণ হবে।
আসন্ন নিম্নচাপের প্রভাব থেকে বাঁচতে আপনি কী করবেন? আপনি যেটা করবেন–মস্তিস্কের সকল বন্দরকে দুই নাম্বার বিপদ সংকেত দেখিয়ে দেবেন। তাতে আপনার পরবর্তী কাজকর্মে ভুলভ্রান্তি কম হবে। নিম্নচাপের প্রভাব থেকে বেঁচেও যেতে পারেন। কিন্তু রেডিও না থাকার কারণে কোনো এক বন্দরে বিপদ সংকেত পৌঁছাবে না। সেই বন্দর থেকে ভুল তো হবেই, সেই ভুল নিয়ে ফিডব্যাক গানও গাইবে, ‘মাঝি তোর রেডিও নাই বইলা জানতেও পারলি না আইতাছে ভাইঙ্গা কত্ত বড় ঢেউ।’
তো সেই ভুলের কারণে কাচের প্রোকোষ্ঠে ভরা মজলিসে যেটা শুনলেন সেটা আপনার কান বিশ্বাস করতে না পারলেও আপনি ঠিকই বিশ্বাস করেছেন। ‘গুড ফর নাথিং।’ না, না, না। মোটেও চাপ নেবেন না। এই শব্দটা শোনার পর আপনার মস্তিস্কে যত প্যাসকেলের চাপই তৈরি হোক না কেন, তা কপ কপ করে খেয়ে ফেলার সালাদ বাজারে আছে। ম্যানেজমেন্টের ভাষায় একটা কথা কিন্তু আছে। ‘না বলতে শিখুন।’ তো সেই না বলতে পারাকে যদি বলি ‘না থিং’, তাহলে ধরে নেবেন আপনি আসলে ‘গুড ফর না থিং’। তদুপরি, বকা হলেও এর ভেতরে গুড শব্দটা কিন্তু আছে। প্রকৃতপক্ষে আপনার বস আপনাকে গুডই বলেছেন।
দামের ঘোড়ার উর্ধ্বমুখি টগবগানো দেখে ২০১৫ সালে বাংলাদেশে আঘাত হেনেছিল ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’। মানে হলো, ‘হে মহান দামের ঘোড়া! আপনি অনেক বেড়েছেন, এবার একটু কোমেন।’ ঘুর্ণিঝড় যে নামেই আসুক, এক দিন বা দুদিন অথবা কয়েক ঘণ্টা তাণ্ডব চালিয়ে বিদায় নিয়ে যায়। এরপর দু চার বছর আর খবর থাকে না। কিন্তু এখানে হয়তো আপনি বলবেন, ‘গুড ফর নাথিং’ ঝড়ের পরপরই আঘাত হেনেছে ‘অপদার্থ’। টেনশন নিয়েন না ব্রাদার। এটা চিকেন চাপের চেয়েও মজাদার। সালাদ ছাড়াই খেয়ে ফেলবেন। কীভাবে? বলছি–আপনি কি নিজেকে পদার্থ মনে করেন? খেয়াল করে দেখুন–আপনি আসলে কতটা জায়গা দখল করেন। অফিসে এই কাজ সেই কাজে দৌড়ের ওপর থাকেন। বাসায় গিয়েও খুব একটা সুবিধা করতে পারেন না। জায়গা যেহেতু দখল করার সুযোগ পান না, তাহলে আপনি পদার্থ হতে যাবেন কেন? আর পদার্থ মানেই কেমন একটা জড় জড় ভাব। তাছাড়া আপনি যদি পদার্থ হতেনই, তাহলে ফিজিক্সে হিউম্যান বডি নিয়া একটা হলেও চ্যাপ্টার থাকত। পদার্থ নন বলেই আপনার স্থান হয়েছে বায়োলজিতে। তো আপনার বস তো ঠিকই বলেছেন ‘অপদার্থ’। সুতরাং এটাকে সালাদ ছাড়াই পাকস্থলিতে চালান করে দিন।
আবার বস যদি হোন বাংলার ছাত্র, তাহলে আপনাকে বলে বসতে পারেন, ‘আমড়া কাঠের ঢেঁকি। আমড়া হোক আর মান্দারই হোক, কাঠ কোনো বিষয় না। মূল বিষয় হলো ঢেঁকি তো! ঢেঁকির কাজ হলো স্বর্গে গিয়েও ধান ভানা। তার মানে আপনার দাম মোটেও কম নয়। আপনি ধান ভানতে পারেন বলেই বস আপনাকে ঢেঁকির শ্রেণিতে রেখেছেন।
বুদ্ধির এতো বড় ফ্লাশ লাইট জ্বালানোর পরও যারা বলছেন, ‘ভাই, চাপে আছি।’ তাদের জন্য কথা হলো– কী আর করবেন? চাপ নিয়েই সংসার করতে হবে। পানিতে ডুব দেবেন! যত নিচে যাবেন তত চাপ। গ্যাসের চাপ কম হলে তো রান্নাই হবে না। কলিংবেলে আলতো চাপ না দিলে বউ দরজাও খুলবে না। মোবাইলেও সেই একই ব্যাপার। কোনো কোনো বাটন দীর্ঘক্ষণ চেপে না রাখলে কাজই হয় না। যাকে বলে লং প্রেস।
সুতরাং চাপ খেয়ে ফেলাই উত্তম কাজ। তবে সাবধান, নিজের ভাগেরটা অন্যকে দেবেন না। কারণ তিনি তো আপনাকেও ভালোবাসেন। ফেরত দেবেন সেই চাপ আপনাকেই । খুব ভালোবেসে। সালাদে কাজ না হলে মসলা তৈরি করুন। খেতে শিখুন।