ভাষা শিক্ষা : শুদ্ধ বানান ও সুন্দর উপস্থাপন কৌশল

মোহাম্মদ নূরুল্লাহ ।।

সুন্দর করে কে না বলতে চায়? কিন্তু সবাই কি সুন্দর করে বলতে পারে? সুন্দর করে বলতে হলে চাই সুন্দর সুন্দর শব্দ প্রয়োগ। সমৃদ্ধ শব্দ ভান্ডার। আর এর জন্য চাই নিয়মিত অনুশীলন। বাংলা ভাষার লিখিত শব্দের উচ্চারণের কোন অসুবিধা নেই বলে মনে হয়। কিন্তু উচ্চারণ বিষয়টি নিয়ে যারা কাজ করেন অথবা যারা এই বিষয়টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত তারা জানেন পৃথিবীর আরো পাঁচটি ভাষার মতো বাংলা ভাষাতেও শব্দের লিখিতরূপ আর উচ্চারিত রূপে বেশ পার্থক্য রয়েছে। শুধু লেখ্য ও কথ্য রীতির মধ্যেই নয়, বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে উচ্চারণগত বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান। লেখার বেলায় যেমন চলিত রীতি সমগ্র বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে গ্রহণযোগ্য, তেমনি প্রমিত উচ্চারণরীতিও সবার মেনে চলা দরকার। শব্দের প্রার্থিত ও পরিমিত উচ্চারণের সঙ্গে পরিচিতি থাকলে উচ্চারণের আর্দশরূপ রক্ষা করা সম্ভব। বানানের সঙ্গে উচ্চারণের পার্থক্য আছে বলে উচ্চারণ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। যথার্থ অনুশীলনের মাধ্যমেই সঠিক উচ্চারণ আয়ত্ত করা সম্ভব। বাংলা বর্ণমালার সঠিক উচ্চারণ আমাদের প্রত্যেকরই জানা প্রয়োজন।
শুদ্ধ করে বলতে হলে চাই- শুদ্ধ উচ্চারণ। আর শুদ্ধ উচ্চারণই একটা জাতিকে সভ্য জাতিতে পরিণত করে। সুন্দর কথায় রয়েছে অনেক ফযিলত। সুন্দর করে বলতে পারলে সমাজের মধ্যে বিদগ্ধ বাগ্মী হিসেবে পরিচিতি লাভ পাওয়া যায় । যিনি সুন্দর করে বলেন, তিনি হয়ে ওঠেন অনন্য সাধারণ। সুন্দর বলার ব্যাপারে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন, আল্লাহ্‌র নবী হযরত মুহাম্মদ (স:) এবং যুগে যুগে বিভিন্ন মনীষীগণ প্রেরণা যুগিয়েছেন। এ ব্যাপারে কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরছি:

১. একটি ভালো কথা একটি গাছের মতো, মাটিতে যার বদ্ধমূল শিকড়, আকাশে যার বিস্তৃত শাখা, সব সময় সে দিয়ে যায় ফল আর ফল। – (আল কুরআন ১৪:২৫)
২. মানুষের সাথে ভালো কথা বলো, সুন্দর কথা বলো। (আল কুরআন ২:৮৩)
৩. তাদের সাথে দয়া, সহানুভূতি ও নম্রভাবে কথা বলো (আল কুরআন ১৭:২৮)
৪. আপনার একটি সুন্দর কথা, একটি ভালো কথা ঐ গাছটির মতোই কল্যাণময়। আপনার একটি সুন্দর কথা ঐ গাছটির মতোই হতে পারে শান্তির বাহক, কল্যাণের কাসিদা, আনন্দের দূত আর অফুরন্ত সুফলদায়ক।
৫. শ্রেষ্ঠ মনীষীরা সুভাষী, তাঁরা সুন্দর কথা বলেন, সুন্দর করে বলেন। তাঁদের সুবচনে, সদালাপে, সুকথার শ্রুতিমাধুর্যে শ্রোতারা সদা সম্মোহিত।
৬. মানুষের যতো সেরা গুণ আছে, তন্মধ্যে অন্যতম হলো সুন্দর করে কথা বলার গুণ।
৭. পৃথিবীতে যতো আদর্শই প্রচারিত হয়েছে তা হয়েছে সুন্দর কথা দিয়ে, সুবচন দিয়ে। সুন্দর কথার হাত পা আছে। জীবন আছে। সুন্দর কথায় শর্করার শক্তি আছে। ভিটামিনে মৃত সঞ্জীবনী আছে। আমিষের পুষ্টি গুণ আছে। সুন্দর কথায় রোগজীবাণু ধ্বংসের ঔষধ আছে, এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা আছে।
এ ছাড়া সুন্দর কথায়-
১। মানুষের মনোকষ্ট দূর হয়।
২। হতাশা, নিরাশা, দুশ্চন্তিা দূর হয়।
৩। মন খুশি হয়, সন্তুষ্ট হয় এবং তৃপ্ত হয়।
৪। মন সচেতন হয়, বিবেক জাগ্রত হয়।
৫। আবেগ, উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়।
৬। রাগ নিভে যায় ও গোস্বা দমে যায়।
৭। শত্রুতা কেটে যায় ও জিঘাংসা দূর হয়।
৮। বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ও শত্রুবন্ধু হয়ে যায়।
৯। সুসম্পর্ক সৃষ্টি হয় ও সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে।
১০। প্রভাব ও আকর্ষণ সৃষ্টি হয়।
১১। ভক্তি, শ্রদ্ধা ও বিনয়ভাব সৃষ্টি হয়।
১২। স্নেহ ও ভালোবাসার সৃষ্টি হয়।
১৩। ঐক্য ও একতার বন্ধন গড়ে ওঠে।
১৪। রাগারাগি ও হানাহানি মিটে যায়।
১৫। শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
এসব ব্যতীত সুন্দর কথার মাধ্যমে মানুষের মনোবল বৃদ্ধি করা যায়। সুন্দর কথায় মানুষ রোগব্যাধি থেকে মুক্তি পায়। মুমূর্ষু রোগীও বাঁচার প্রেরণা পায়। ভীরু বা কাপুরুষরা সাহসী হয়ে ওঠে। অশীতিপর বৃদ্ধ টগবগে যুবকের মতো শৌর্যবীর্যে বলীয়ান হয়ে ওঠে।

বানান ভুল প্রতিকারের উপায়:
১। শ্রুতিলিপি লিখন;
২। অভিধান পাঠ;
৩। ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ;
৪। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবকের সচেতনতা বৃদ্ধি;
৫। বানান রীতি অনুসরণ;
৬। গণমাধ্যম, সাইনবোর্ড, ব্যানার লিখনে সচেতনতা;
৭। বানান লিখনে স্বেচ্ছাচারিতা পরিহার;
৮। লিখনে দ্রুতগতি পরিহার;
৯। কথোপকথনে আঞ্চলিকতা পরিহার;
১০। পুস্তকাদির মুদ্রণ ত্রুটি নিয়ন্ত্রণ;
১১। পর্যাপ্ত ব্যাকরণ জ্ঞান অর্জন;
১২। লিখনে মানসিক চাপ পরিহার ও
১৩। যুক্তব্যঞ্জন যথাসম্ভব বিযুক্ত লিখন।
প্রকৃতপক্ষে বাংলা বানান শুদ্ধ লিখনে নিয়মিত অনুশীলনের কোন বিকল্প নেই।
এ পর্যায়ে আমরা নিয়মিত বানান অনুশীলনের কয়েকটি দিক নিয়ে আলোকপাত করছি:

বানান অনুশীলনের নিয়মাবলি:
১। শ্রুতিিলপি লিখন;
২। হাতের লেখার বাড়ির কাজ প্রদান ও পরীক্ষণ;
৩। বাংলা অভিধান ব্যবহার;
৪। শব্দ-গঠন খেলা;
৫। যুক্তব্যঞ্জন গঠন শিখন;
৬। বানান-রীতি অনুশীলন;
৭। শুদ্ধ বানান লিখন প্রতিযোগিতা;
৮। বর্ণের প্রকৃত গঠন লিখন অনুশীলন;
৯।শব্দ থেকে বর্ণ-জ্ঞান (শব্দক্রম);
১০। পাঠ্যপুস্তক থেকে বানান অনুশীলন;
১১। মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ; ( দেখা-বলা -শোনা -লেখা )
১২। শুদ্ধ উচ্চারণ উপস্থাপন ও
১৩। সঠিক ব্যাকরণ জ্ঞান অর্জন।
বানান অনুশীলন ও শুদ্ধ উচ্চারণরীতি বিষয়ে আলোচনার পর সুন্দর উপস্থাপন কীভাবে করতে হয় তার কিছু কৌশল নিয়েএ পর্যায়ে আলোচনার প্রয়াস পাব। সুন্দর করে বলতে হলে চাই নিয়মিত অনুশীলন। সুন্দর উপস্থাপন কৌশলের জন্যে রয়েছে অগণিত কৌশল। তন্মধ্য থেকে নিম্নে কিছু কৌশল উপস্থাপন করছি:
১. সোজা কথা বলুন;
২. সহজ করে কথা বলুন;
৩. সুন্দর করে কথা বলুন;
৪. হাসি মুখে কথা বলুন;
৫. কোমল ভাষায় কথা বলুন;
৬. সুন্দর শব্দ চয়ন করে কথা বলুন;
৭. মাতৃভাষাকে ভালোভাবে জানুন;
৮. শব্দ ভান্ডারে সমৃদ্ধ হোন;
৯. কথার মাঝে সুন্দর শব্দ প্রয়োগ করুন;
১০. হিতকথা, কল্যাণের কথা বা উপকারের কথা বলুন;
১১. স্পষ্টভাবে, জড়তামুক্ত কথা বলুন;
১২. অশুদ্ধ ভাষা ও শব্দ পরিহার করুন ;
১৩. আঞ্চলিকতা পরিহার করুন;
১৪. কৃতিত্ব ও অবদানের প্রশংসা করুন;
১৫. উপকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন;
১৬. উপদেশ দিন, পরামর্শ দিন;
১৭. পরামর্শ নিন, পরামর্শ দানের জন্যে কৃতজ্ঞতা জানান;
১৮. সদালাপী ও মিষ্টভাষী হোন;
১৯. বিতর্ক পরিহার করুন, যুক্তিসঙ্গত কথা বলুন;
২০. বলুন কম, শুনুন বেশি;
২১. অর্থবহ কথা বলুন, অর্থহীন বাজে কথা বর্জন করুন;
২২. কথার মাঝে বৈধ রসিকতা করুন;
২৩. রুক্ষ, কর্কশ ও কড়া কথা পরিহার করুন;
২৪. গালি দেবেন না, অশ্লীল কথা বলবেন না;
২৫. পুরুষ হয়ে মেয়েলি কথা বর্জন করুন;
২৬. মেয়ে হয়ে পুরুষালি কথা পরিহার করুন এবং সর্বোপরি
২৭. ভাষার পবিত্রতা রক্ষা করুন।
সুন্দর কথা এমনি এমনি বলা যায় না। সুন্দর কথা বলার জন্যে চাই সুন্দর মন। অসুন্দর মন থেকে সুন্দর কথা বেরোয় না। কারণ কথা তো মনোভাবেরই প্রকাশ।

তথ্যসূত্র:
১. পবিত্র কুরআন মাজিদ
২. বাংলা বানানের নিয়ম: মাহবুবুল হক
৩. এফএসএসএপি বাংলা ম্যানুয়াল
৪. বাংলা উচ্চারণের অভিধান: নরেণ বিশ্বাস
৫. বাংলাদেশের আঞ্চলিক অভিধান: ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্
৬. অধ্যাাপক মো. আনোয়ারুল বারী, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ফরিদপুর কর্তৃক প্রণীত ওএইচপি শীট।

৯ comments

  1. প্রিয় লেখক, আপনার লেখাটি পড়ে চমতকৃত হলাম। এটি একটি সুন্দর লেখা। কথ্য ভাষাকে প্রমিত করার জন্য আমাদের সমাজের শিক্ষিতজনকে এগিয়ে আসতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *