প্রবীণের চোখে সোনালী অতীত: একটি গরুর দাম ছিলো মাত্র ৫ টাকা

আহমেদ বায়েজীদ ।।
সকাল ৮টা। গ্রামের রাস্তায় তখন অল্প অল্প লোক চলাচল শুরু হয়েছে। সারা দিনের ব্যস্ততার প্রস্তুতি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে শুরু করেছেন ছাত্র, শ্রমিক, দোকানদার, অটোচালকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। রাস্তার পাশ ঘেঁষে বাজার থেকে ফিরছেন একজন বয়স্ক লোক। পরনে সাদা পাঞ্জাবি, আর লুঙ্গি। মাথায় সাদা টুপি, মুখভর্তি সাদা দাড়ি। এক হাতে বৃদ্ধ বয়সের সম্বল লাঠি, আরেক হাতে ছোট পলিব্যাগে কিছু পান।
বয়সের ভারে কিছুটা নিচু হয়ে হাঁটছেন লোকটি। সালাম বিনিময়ের পর কোথা থেকে ফিরছেন প্রশ্ন করলে জানান, বাজারে গিয়েছিলেন। সকালবেলা একটু হাঁটাহাটি করলে শরীরটা সতেজ লাগে। তাই রোজ সকালে বাড়ির কাছেই কামারখালী বাজার থেকে ঘুরে আসা রুটিন তার।
যার কথা বলছি, তার নাম আজাহার শিকদার। বয়স ৯৫ পার হয়েছে। তার দেয়া তথ্য মতে, আগামী বৈশাখে সেটা ৯৬ হবে। আজাহার শিকদারের বাড়ি বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার দাড়িয়াল গ্রামে। আশপাশের কয়েক গ্রামেও তার সমবয়সী কেউ নেউ। অনেক আগেই তারা দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছেন। বয়স আজহার শিকদারকে কিছুটা দুর্বল করলেও কাবু করতে পারেনি। যে কারণে এখনো নিজে বাজারে গিয়ে সদাইপাতি আনা থেকে শুরু করে ছোটখাট চাষাবাদ নিজেই করেন তিনি।
প্রায় শতবর্ষী এই নাগরিকের স্মৃতিতে বৃটিশ শাসনের দিনগুলো এখনো তাজা। ১৯৪৭ এর দেশভাগ, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাংলা ১৩৪৮ সনের প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড়সহ অনেক ইতিহাসের সাক্ষী তিনি। এ যেন এক চলন্ত ইতিহাস। সেসব প্রসঙ্গ তুলতেই ফিরে গেলেন স্মৃতির পাতায়। খুঁজে ফিরলেন হারানো দিনগুলো। তার ভাষায়, ‘আমার ছোটবেলায় ভালো চাউলের সের আছিল ৭ থেকে ৮ পয়সা। আউশ চাউল ছিলো ৩ পয়সা। একদিন চাইরডা ইলিশ মাছ কিনছি ১২ আনায়, মাছ চাইরডা আনতে আমার খুব কষ্ট হইছে। এত ওজন আছিল!’
আজাহার শিকদার জানান, ছোটবেলায় রুপার টাকায় লেনদেন করেছেন তিনি। এক পয়সা, আধা পয়সা ও সিকি পয়সার প্রচলন ছিলো তখন। এই দিয়ে বেচাকেনা করেছেন। এক পয়সায় তখন নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছু পাওয়া যেতো। ৫ থেকে ৭ টাকায় মিলতো বড় সাইজের গরু।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে বললে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন এই বৃদ্ধ। বলেন, ‘দেকলাম উত্তর দিক গোনে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আইয়া গ্রাম ভইরা গেছে। শুনছি- সৈদালি খার বাড়ি, বারইনগর (বারুজীবীপাড়া) পোড়াইয়া আইছে। এইয়া দেইখা আমরা ৬০-৭০ জন পুরুষ ওযু কইরা টুপি মাথায় দিয়া বাইর হইছি। শুনছি পাক বাহিনী খালি মানুষ মারে। মেয়ে-ছেলেদের মারার আগে মারলে আমাদের মারুক।’
এভাবেই পাকবাহিনীর হাত থেকে নারীদের ইজ্জত ও জীবন রক্ষায় গ্রামবাসীদের সঙ্গে নিয়ে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত পাক সেনারা তার মহল্লায় তাণ্ডব চালায়নি। পাশের গ্রামে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরেই বেশি তাণ্ডব চালিয়েছে বলে শুনেছেন। তাই আশপাশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি পরিবারকেও আশ্রয় দিয়েছিলেন বলে জানান আজহার শিকদার।
সুখ দুঃখের এতসব মিশ্র অনুভূতি নিয়েই প্রতিদিন জীবন পার করছেন এই প্রবীণ। জানালেন, বয়সের কারণে কিছুটা দুর্বল হলেও কোন অসুখ বাসা বাধেনি তার শরীরে। তাই খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা সব কিছুই করতে পারেন স্বাভাবিকভাবে। গত রবি শস্যের মৌসুমে নিজেই মুগ ডাল চাষ করে বেশ ভালো ফলন পেয়েছেন বলে জানালেন।
এখনো প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে জামাতে আদায়ের চেষ্টা করেন আজাহার শিকদার। গত রমজানে মহল্লার মসজিদে ১০ দিন ইতিকাফ করেছেন। ৯-১০ বছর ধরেই এলাকাবাসীর হয়ে এই ইবাদতটি তিনি করে চলছেন নিরবিচ্ছিন্নভাবে। মহল্লায় কোন পুরুষ মারা গেলে স্বেচ্ছায় লাশ গোসল করানোর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। অন্যান্য সামাজিক কর্মকাণ্ডেও নিজের সাধ্যমত অংশ নেয়ার চেষ্টা করেন।
ছেলেরা সব বড় হয়েছে। তাদের আলাদা সংসার হয়েছে। তাই স্ত্রীকে নিয়েই আজাহার শিকদারের সংসার এখন। সুযোগ পেলে বাজারে চলে যান। লোকজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ, আলাপ হলে মনটা ভালো লাগে বলে জানান। সবার কাছে দোয়া চান, জীবনের বাকি সময়টুকু যেন সুস্থতার সাথেই বাঁচতে পারেন আর ঈমান নিয়ে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে পারেন। এই দুটোই এখন এই বৃদ্ধের চাওয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *