প্রাচীন বাঙালি দার্শনিক, ধর্মীয় পীর, মুনি ঋষিরা একদা বাঙালিকে ব্যবসা করার উপদেশ দিতেন। চাকুরিপ্রিয় বাঙালিরা খানিকটা ঝুঁকি নিয়েই ব্যবসায় নামুক এবং দেশ ধনসম্পদে পরিপূর্ণ হোক- এমনটা চেয়েছিলেন তারা।এমন সব কারণে বাঙালিরা ঝুঁকতে থাকে ব্যবসায়ের দিকে। তবে বাঙালি যে দক্ষ ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে পারে, ইতিহাস তার প্রমাণ দেয়। পেরিপ্লাসের লেখা থেকে শুরু করে মার্কো পোলোর বর্ণনাতেও বাংলার বাণিজ্য বা বহির্বিশ্বে গঙ্গাবন্দরের বাণিজ্যের কথা বেশ ফলাও করে লেখা আছে।
কাপড় থেকে শুরু করে চিনি, গুড়, লবণ, নারকেল, পান, সুপুরি তখন বিদেশে রপ্তানি হতে থাকে। জাহাজ-ভর্তি পণ্যসামগ্রী পাড়ি দিত বিদেশে। তেমনি ভর্তি-জাহাজ ধনসম্পদ দেশের মাটিতে এসে পৌঁছত।
তাম্রলিপ্ত বন্দরের যে জগৎজোড়া খ্যাতি ছিল – তা তো জানা কথাই। এই খ্যাতি পরিচয় মেলে বাংলার প্রাচীন মুদ্রাতে। খ্যাতি ও অখ্যাতি দুটোরই।
খ্রিষ্টীয় শতকের বেশ কিছু বছর আগ থেকেই বাংলায় মুদ্রার প্রচলন। মহাস্থান শিলালিপিতে মিলেছিল গণ্ডক ও কাকনিক নামের দুটি মুদ্রার কথা। পেরিপ্লাসের গ্রন্থে মেলে, গঙ্গাবন্দরে প্রচলিত ক্যালটিস নামের মুদ্রার কথা। অনুমান করা হয়, তখনকার সেই মুদ্রা ছিল সোনার। এমনিতে বাংলায় স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন বেশ ভালোই ছিল। রাজশাহী, ময়মনসিংহ, তমলুক, ঢাকায় প্রাচীন স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গিয়েছিল। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে কালীঘাটে ২০০ স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গিয়েছিল। এ ছাড়াও যশোরে, হুগলিতেও স্বর্ণমুদ্রার হদিশ মিলেছিল। স্বর্ণের এই প্রাচুর্য দেশের সমৃদ্ধিকেই প্রকাশ করে।
কুষাণ যুগের মুদ্রাও বাংলাতে পাওয়া গিয়েছে। যা প্রমাণ করে,সর্বভারতীয়ক্ষেত্রেও বাংলার বাণিজ্যের একটা বিস্তৃতি ছিল।
তবে, অদ্ভুত ব্যাপার এটাই যে রুপা খুবই অপ্রতুল ছিল বাংলায়। রুপার মুদ্রা প্রায় নিখোঁজই ছিল বললেই চলে। বিশেষ করে গুপ্ত যুগে যেন রুপার মুদ্রা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। গুপ্ত আমলের শেষে বাংলায় অরাজকতা দেখা দেয়। মাৎসন্যায় বাংলার অর্থনীতিকে বেশ গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাতে দেশের সমৃদ্ধি ব্যাহত হয়েছিল। এরপর পাল আমলে দেশে সুশাসন ফেরে। তার সঙ্গে ফেরে রুপার মুদ্রাও। পাল আমল থেকে বাংলায় আর কোনো স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায় না। তার জায়গা নেয় রুপা ও তামার মুদ্রা। শ্রীবিগ্রহের নামে রুপোর মুদ্রার হদিশ মিলেছে নানাস্থানেই।
অনেকেই মনে করেন, গুপ্ত আমল থেকে বাংলার বাণিজ্যের অধপতন। বিশ্ববাণিজ্যে ততদিনে অন্যের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এরপর দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, প্রতিবেশী রাজ্যর আক্রমণের ভয়, মাৎস্যন্যায় – সব মিলিয়ে বাংলার বাণিজ্যকে কোণঠাসা করেছিল।
পাল আমলে তাও রুপো ও তামার মুদ্রা দেখা গেলেও, সেন আমলে সেসব উঠে গিয়ে বাজার দখল করে কড়ি। কড়ি আগেও ছিল। তবে তার একচ্ছত্র আধিপত্য এই সেনবংশ থেকে শুরু করে ব্রিটিশ আমলের গোড়া অবধি বহাল ছিল। বহির্দেশ বা অন্তর্দেশ- সমস্ত বাণিজ্যর ক্ষেত্রেই উর্ধ্বতম, নিম্নতম মুদ্রা বলতে ছিল কড়ি।
চর্যাপদে কড়ির ব্যবহার সম্পর্কে লেখা আছে। মিনহাজউদ্দিনের লেখাতেও মেলে যে, বাংলাতে কোথাও রুপোর মুদ্রা পাওয়া যায়নি। এমনকি রাজাও যখন কাউকে কিছু দান করতেন, তা কড়িই হতো। লক্ষ্মণসেনের নিম্নতম দান ছিল এক লাখ কড়ি। খুব আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, পালযুগে তাও ধাতব মুদ্রার একটা প্রচলন ছিল। কিন্তু সেনযুগে তা পুরোপুরি অবলুপ্ত৷ এমনকি সেন রাজারাও তা শুরু করার কোনো চেষ্টা করেনি। ত্রয়োদশ বা পঞ্চদশ শতকেও কড়িই বিনিময় হতো। ১৭৫০ সালেও কলকাতা শহরের কর আদায় করা হতো কড়ির মাধ্যমে। বেচাকেনা- সবকিছুরই মধ্যমণি কড়ি।
কালে-দিনে অবশ্য কড়িরও সৌভাগ্য ফুরোয়। খেলার উপকরণ হয়ে ওঠে কড়ি। মুদ্রার ইতিহাস দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ইতিহাসই বটে। যেভাবে বা যেমনভাবে বহির্বিশ্বে বাংলার বাণিজ্যিক আধিপত্য কমেছে, তেমনভাবেই বদল এসেছিল মুদ্রায়। তাম্রলিপ্ত বন্দরের খ্যাতি কমে এসেছিল। তার অন্যতম কারণ ছিল অবশ্য, নদীর মুখে পলির আস্তরণ। বহির্বাণিজ্য তাতে প্রতিহত হয়। এর ফলাফলে, মূলত অষ্টম শতাব্দী থেকে বঙ্গীয়সমাজ ক্রমশ কৃষিনির্ভর হয়ে পড়েছিল। সমাজে বা রাষ্ট্রে ব্যবসায়ী, বনিকদের প্রতিপত্তি কমে আসে। কুলিক, ব্যাপারীরা পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে যে গুরুত্ব পেত, অষ্টম শতাব্দী থেকে তা আর হারিয়ে গেছে।
তবে অধপতন ছিল সাময়িক, বাণিজ্যে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিল বাংলা। এখন স্বর্ণমুদ্রা, রুপা, কড়ি সবই হারিয়ে গেছে। পয়সারাও ক্ষমতা হারিয়েছে। হয়ত চকচকে সাদা মুদ্রা বা লাল মুদ্রাও হারিয়ে যাবে নোটের ভিড়ে।
সূত্রঃ ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস – আদি পর্ব
লেখকঃ নীহাররঞ্জন রায়
প্রকাশনীঃ দে’জ পাবলিশিং