আবদুল হাই শিকদার ।।
এক.
৩১ মে ২০২১ নয়া দিগন্তে আবু সালেহ আকনের রিপোর্ট ‘কবি ফররুখ আহমদের বাড়িতে লাল নিশান’ আমার মতো দেশের লক্ষ কোটি মানুষকে বিরক্ত, বিক্ষুব্ধ ও হতাশ করেছে। আর এই উটকো যন্ত্রণার জোগানদাতা বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এই রকম জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়কে আড়াল থেকে উদ্ধার করে জনদরবারে উপস্থাপনের জন্য নয়া দিগন্ত ও সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারকে ধন্যবাদ জানাই। তারা না থাকলে এত বড় একটা বড় অন্যায় সম্পর্কে কেউ জানতেই পারত না।
বাংলাদেশ রেলওয়ে ফরিদপুর-মাগুরা রেল সড়ক নির্মাণের নাম করে কবি ফররুখ আহমদের বাড়িটি ধ্বংস করার জন্য অধিগ্রহণের লাল নিশান উড়িয়েছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক, দুর্ভাগ্যজনক এবং অবাঞ্ছিত।
ফররুখ আহমদ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন ও জীবনানন্দ দাশের সাথেই উচ্চারিত হয় এই কবির নাম।
তার ‘সাত সাগরের মাঝি’ শুধু বাংলা নয় বিশ্বসাহিত্যেরও অনন্য সম্পদ। এই মহান কবির সাহিত্যকর্মের মতোই তার স্মৃতিজড়িত স্থান ও স্থাপনাগুলোও আমাদের জাতীয় গৌরবগাথার
অবিচ্ছেদ্য অংশ। যা আমাদের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃৃতির সম্পদ।
দেশ ও জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যতের স্বার্থেই এগুলো সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা ছিল কর্তব্য। কিন্তু আফসোস, সেই প্রয়োজনীয় কর্তব্য পালনে এগিয়ে আসেনি কোনো সরকারই। উল্টো এখন যা অবশিষ্ট আছে, সেগুলোও বিনাশ করার জন্য প্রয়াস চালাচ্ছে কোনো কোনো মহল। যা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। বিষয়টি এক দিকে পুরো জাতির জন্য অশনি সঙ্কেত, অন্য দিকে ঐতিহ্য নাশের মাধ্যমে জাতির অন্তরজগতকে দেউলিয়া করারও একটা অপচেষ্টা।
জেনে হোক, না জেনে হোক বাংলাদেশ রেলওয়ে এই রকম ভুলের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছে, যা রীতিমতো বিস্ময়কর।
দুই.
মানুষের ইহজাগতিক ভূগোলে রেলওয়েকে সংযুক্ত করেছিলেন জর্জ স্টিফেনসন। তারই প্রচেষ্টায় প্রথম রেলওয়ে চালু হয় ১৮২৫ এর ২৭ সেপ্টেম্বর। আর বাংলাদেশের জীবনের সঙ্গে রেলওয়ে জড়িয়ে যায়, মহাবিদ্রোহের পাঁচ বছর পরে ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর।
‘এলেন দেখলেন জয় করলেন’ বলে যে কথাটি চালু আছে, রেলওয়ের ক্ষেত্রে তা সর্বাংশে সত্য। যোগাযোগের উন্নয়নের পাশাপাশি দ্রুত জায়গা করে নেয় আমাদের আবেগ ও সৃষ্টিশীলতার ভুবনে।
ষাটোর্ধ্ব যারা তাদের প্রায় সবারই প্রিয় ছড়া ছিল :
আইকম বাইকম
তাড়াতাড়ি
যদু মাস্টার
শ্বশুর বাড়ি
রেলগাড়ি ঝমাঝম
পা পিছলে আলুর দম।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রেলওয়েকে নিয়ে এলেন ভিন্ন মাত্রায় :
‘এ প্রাণ রাতের রেলগাড়ি
দিল পাড়ি
কামরায় গাড়ি ভরা ঘুম
রজনী নিঝুম।’
রেলগাড়ি অন্যরকম রোমান্টিকতায় ভাসাল কাজী নজরুল ইসলামকে। ঢাকার সেই বিলুপ্ত ফুলবাড়ী স্টেশন থেকে জয়দেবপুরে যাওয়ার পথে ট্রেনের জানালায় দেখা দিলো চাঁদ। নজরুল লিখলেন :
‘কোদালে মেঘের মউজ উঠেছে গগনের নীল গাঙে,
হাবুডুবু খায় তারা-বুদ্বুদ, জোছনা সোনায় রাঙে।
তৃতীয়া চাঁদের সাম্পানে চড়ি চলিছে আকাশ-প্রিয়া,
আকাশ দরিয়া উতলা হ’লো গো পুতলায় বুকে নিয়া।
আমাদের কথাসাহিত্যেও অমর হয়ে আছে রেলগাড়ি। বিভূতিভূষণের অপু-দুর্গার প্রথম ট্রেন দর্শন তো অসাধারণ এক স্মৃতি। শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘তাহমিনা’ কিংবা হুমায়ূন আহমদের
‘মোহনগঞ্জ জংশন’ তো আমাদের অন্তরের ভেতরে ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছে।
আর কত কথাই না গল্প, কবিতা, গানে, উপন্যাসে বিধৃত করেছে রেলগাড়ি। এমন কি যে ফররুখ আহমদের নীড় নষ্টের অপ-আয়োজন, সেই কবি ফররুখ আহমদ তার হরফের ছড়ায় রেলগাড়ি
নিয়ে এঁকেছেন চমৎকার চিত্র :
এ চলেছে এঞ্জিনে
এলাচ দানা লং কিনে
থামার কথা নাই যে
একটানা যায় তাই সে।
তিন.
দার্শনিক ফারাবি বলে গেছেন, ‘ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর জ্ঞান মূর্খতায় রূপান্তরিত হয়’। কারণটা ব্যাখ্যা করেছেন আমাদের পরিচিত লুই কান, ‘ঐতিহ্য হলো মানুষের মনের প্রত্যাশারই আরেক রূপ, আকাক্সক্ষার ফসল।’ এজন্যই ম্যাকস ফুলার মনে করেন, একমাত্র মূর্খরাই ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে গৌরব বোধ করে।
আমরা কোন পথে যাবো? জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তবায়নের পথে? সাহিত্য সংস্কৃতির খোলা আকাশের নিচে? নাকি ডুব দেবো অজ্ঞতার, মূর্খতার পচা পাগাড়ে? যে পাগাড়ে হরহামেশাই নানা পথ ও প্রক্রিয়ায় আমাদের ডুবিয়ে দিয়ে, সম্বিতহারা করতে আগ্রাসনবাদ সদা তৎপর। আমরা মনের রাজ্যে অতি হীন, দরিদ্র হওয়ার পথ কি বেছে নেবো?
যদি সুস্থ, স্বাভাবিক ও সৌন্দর্যের অন্বেষণ আমাদের আত্মার অবলম্বন হয়, তাহলে কবি ফররুখ আহমদের স্মৃতি রক্ষার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। অকৃতজ্ঞ না হয়ে এগিয়ে আসতে হবে রেলওয়েকেও। কারণ তার সাহিত্যকর্ম, তার স্মৃতি আমাদের দৃষ্টান্ত, আইকন, উদাহরণ, অমিয় সম্পদ। বেছে নিতে হবে বিশ্বসাহিত্য, বিশ্ব ঐতিহ্যের হাইওয়ে। এগোতে হবে সেই পথে যে পথে এগিয়ে গেছে সভ্য পৃথিবী।
আমার বেশ কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতি আছে এই সম্পর্কে। ইংল্যান্ড শেকসপিয়রের সম্মানে স্ট্রাটফোর্ড গ্রামটিকে আজ শেকসপিয়র সিটিতে পরিণত করেছে। পথে নেমে দেখি, বহরে বহরে ট্যুরিস্ট কোচ যাচ্ছে আপন অ্যাভনের তীরে স্ট্রাটফোর্ডে। লন্ডন ছাড়ার পর পরই একজন পর্যটক বুঝতে পারবেন, চমৎকৃত হতে থাকবেন শেকসপিয়রের জন্য।
শুধু শেকসপিয়র নয়, শেলি, কিটস, বায়রন সবার বেলাতেই এই সংরক্ষণ প্রযোজ্য হয়েছে। গ্লাসগো থেকে ফেরার পথে গেলাম লেক ডিস্ট্রিক্টে। প্রশান্ত, সুন্দর লেকের কিনারে কিনারে সুশোভন পাহাড়। তারই এক উপত্যকায় ওয়ার্ডসওয়ার্থের সাদামাটা বাড়ি ‘ডাভ কটেজ’ আজ দর্শনীয় স্থান।
ফ্রান্সের মতো অতি শিল্প সচেতন দেশ কয়টা আছে জগতে?
আয়ারল্যান্ডে গিয়ে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। ওয়াটারফোর্ড থেকে ডব্লিউ বি ইয়েটসের স্লাইগো শহর প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। স্লাইগো আজ আইরিশদের সাহিত্যতীর্থ। মনে রাখতে হবে, এই ইয়েটসের সার্টিফিকেট নিয়েই নোবেল জয় করেছিলেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ।
ডাবলিন যেন লেখকদের বেহেশত। সেখানে আছে জেমস জয়েস স্টোর। বার্নার্ড শ, অস্কার ওয়াইল্ড, ব্রাম স্টোকার, আইনস্টাইন, হ্যারল্ড পিন্টার- কতজনের কথা বলব। লেখক, কবি, মনীষীদের প্রতিটি স্মৃতি তারা সযত্নে ধরে রেখেছে।
আমাদের বাড়ির কাছে ইরানের দিকে চোখ ফেরালে যে কারো মনে হবে, ইরান যেন পৃথিবীর মডেল। আমি ২০০৫ এ যখন ‘আন্তর্জাতিক নজরুল সম্মেলনে’ অংশ নেয়ার জন্য ইরানের দাওয়াত পাই, ইরান দূতাবাসকে বললাম, আমি বিটিভির জন্য হাফিজ ও শেখ সাদীর ওপর দু’টি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করব। একজন ক্যামেরাম্যান সাথে নিতে চাই। তারা সানন্দে সম্মতি দিলো। অনুষ্ঠানাদি শেষে চললাম সিরাজে। সিরাজ এয়ারপোর্টের বাইরে এসেই জুড়িয়ে গেল হৃদয়। পুরো সিরাজনগরী সাজানো হয়েছে হাফিজের কবিতায় উল্লেখিত বৃক্ষ আর ফুল দিয়ে। শহরের যে অংশে হাফিজের মাজার, সে এলাকার নামই এখন হাফিজিয়া, হাফিজ এভিনিউ। প্রায় ১০০ একর জমির ওপর তিন স্তরে সাজানো মাজার। গোলাপ, নারগিস আর কত বাহারি ফুল। নারঙ্গী বৃক্ষের সারি। ভেতরে রয়েছে এমন সব স্থাপনা যা হাজার বছর আগে হাফিজের সময়ে বিদ্যমান ছিল। সেই হাজার বছর আগের সরাইখানা, স্যুভেনির শপ, জাদুঘর।
শেখ সাদীর মাজার রয়েছে শহরের অন্যপ্রান্তে বাবা কুহি পর্বতের পাদদেশে। অনবদ্য তার উপস্থাপনা। জায়গাটার নামও সাদীয়া।
ঝাঁকে ঝাঁকে ট্যুরিস্ট আসছে যাচ্ছে। একই রকম অবস্থা ফেরদৌসির তুস এবং ওমর খৈয়ামের নিশাপুরে। অন্যদের বেলাও একই ব্যবস্থা। সংরক্ষণ ও উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ইরান যে কতটা দরদি ও সচেতন তা যারা চোখে দেখেননি, তারা বুঝবেন না।
পশ্চিম বাংলায় তো রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড। কিন্তু তারা শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশংকর এমন কি নজরুলের কথাও ভোলেননি।
চীনকে পশ্চিমারা উঠতে বসতে গাল দেয়। কিন্তু কেউ কি ভেবে দেখেছেন চীন তার শিল্প, সাহিত্য, ঐতিহ্য সংরক্ষণে কতটা আন্তরিক?
রাশিয়ায় পতন ঘটেছে সাম্যবাদের। কিন্তু ইয়েলেৎসিন কিংবা পুতিনের সরকার তো টলস্টয়, চেখভ, তুর্গেনিভের সাথে মায়াকোভস্কি, ম্যাকসিম গোর্কিকেও নিয়েছে বুকের মধ্যে। কোথাও কোনো অসম্মান নেই সেখানে।
পাকিস্তানে ইকবালের কবর সারাক্ষণ রাষ্ট্রীয়ভাবে অনার গার্ড দিয়ে হেফাজত করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইকবাল এয়ারপোর্ট, জাদুঘর, বিশ্ববিদ্যালয় আরো কত কি! কিন্তু তারা তো সিন্ধি ভাষার মরমি কবি শাহ আবদুল লতিফ ভিটাই, পাঞ্জাবি সাধক কবি ওয়ারিশ শাহ, পশতু কবি রহমান বাবা কিংবা বেলুচ কবি জাম দুররাকসহ কারোর কথাই ভোলেননি।
দল মতের ঊর্ধ্বে উঠে সারা বিশ্বের সভ্য জাতিগুলো ঘোষণা করেছে :
তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে
কেহ নহে নহে দূর,
আমার শোণিতে রয়েছে ধ্বনিত
তারই বিচিত্র সুর।
আমরা ছাড়া জাতি হিসেবে কেউই কোনো কিছু হারাতে দেয় না। কারণ হারাতে দেয়া উচিত নয়। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমানকে যাচাই-বাছাই করে নির্মাণ করতে হয় ভবিষ্যতের পথ।
এই পথই আমাদেরকে করবে পরিমার্জিত, আত্মমর্যাদাবান, সমৃদ্ধ ও সুসংস্কৃত।
চার.
দেশের অনেক কিছু নষ্ট হয়ে গেছে। বহু কিছু চলে গেছে নষ্টদের অধিকারে। তবুও সব শেষ হয়ে যায়নি। আমাদের ধারণা, রেলওয়ের মতো ঐতিহ্যবান প্রতিষ্ঠানেও নিশ্চয়ই দায়িত্বশীল লোকজন আছেন। যারা নিজ দেশ, দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ভালোবাসেন। সেই সব মানুষদের বলব, আপনাদের মধ্যে নিশ্চয়ই শুভ বুদ্ধি আছে। আছে কাণ্ডজ্ঞান। আপনাদের সেই কল্যাণের কাছে আহ্বান করব, ফররুখের বাড়ি ধ্বংসের এই সর্বনাশা পথ পরিহার করুন।
আমরা রেলপথ তৈরির বিরোধী নই। কবির জন্মভিটাকে বিপদমুক্ত করে ভিন্ন স্থান দিয়ে নিয়ে যান রেলসড়ক। কেউ কিছু মনে করবে না। বরং পুরো জাতি আশ্বস্ত হবে। আর অজস্র দোয়া বর্ষিত হবে আপনাদের ওপর।
কবি আবদুল হাই শিকদার, সাবেক সভাপতি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং সাবেক নির্বাহী পরিচালক, নজরুল ইনস্টিটিউট।
তথ্যসূত্র: দৈনিক নয়া দিগন্ত, ০৫ জুন ২০২১
জাতীয় সংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা এবং উন্নয়ন দু’টো একসাথে চলুক।