কবি আল মাহমুদ : একটি নাম, একটি ইতিহাস

তাজরিয়ান আলম আয়াজ ।।

কোনো এক ভোর বেলা, রাত্রি শেষে শুভ শুক্রবারে
মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;
অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে
ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।
~ আল মাহমুদ

বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তিতুল্য কবি আল মাহমুদ ধুলোমাটির এই পৃথিবীর সমস্ত মায়া ছিন্ন করে বিদায় নিয়েছেন। লম্বা সময় ধরে অসুস্থ এই কবিকে নিয়ে সাহিত্যপ্রেমীদের সকল দুশ্চিন্তার অবসান ঘটেছে ফাল্গুনের তৃতীয় রাতে। ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ তারিখে হারিয়ে গেছেন এই মহান কবি চিরতরে। আল্লাহ্‌ কবির সুপ্ত ইচ্ছে পূরণ করেছেন; শুক্রবার রাত ১১টা ৫ মিনিটে বিদায় নিয়েছেন কবি আল মাহমুদ। ইচ্ছে পূরণ হলো হয়তো! এটা কি তবে সৌভাগ্যের মৃত্যু? কে জানে!

জন্ম ও শৈশব

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে সক্রিয় থেকে যিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাকভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন; তিনি কবি আল মাহমুদ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবিও তিনি। তাঁর প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। একাধারে একজন কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশু-সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক তিনি।
১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই প্রবল বর্ষণের এক রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামের এক ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কবি। তাঁর বাবার নাম মীর আবদুর রব এবং মায়ের নাম রওশন আরা মীর। বেড়ে উঠেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার সাধনা হাই স্কুল এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাই স্কুলের পড়াশোনা করেন। মূলত এই সময় থেকেই তাঁর লেখালেখিতে হাতেখড়ি।
বিচিত্র কবি-জীবনের সূত্রপাত
বৈচিত্র‍্যময় তাঁর জীবন। কখনো সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন, কখনো প্রুফ রিডার ছিলেন, কখনো কবিতা লিখে গেছেন নিরন্তর। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, স্বাধীনতার পর আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে জেল খেটেছেন, এরপর নিয়োগ পেয়েছেন শিল্পকলা একাডেমিতে। এক জীবনের বহু জীবনের স্বাদ নিতে পেরেছেন কবি।
মাত্র ১৮ বছর বয়স ১৯৫৪ সালে সংবাদপত্রে লেখালেখির সূত্র ধরে কবি ঢাকা আসেন। তখন থেকেই তাঁর কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। আজীবন আত্মপ্রত্যয়ী কবি ঢাকায় আসার পর কাব্য সাধনা করে একের পর এক সাফল্য লাভ করতে থাকেন। কবি নিজেই বর্ণনা করেছেন সে অভিজ্ঞতা। দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত ইমরান মাহফুজ’র নেয়া এক সাক্ষাৎকারে গ্রাম থেকে শহরে আসা নিয়ে কবি বলেন- “আমি ঢাকায় এসেছিলাম খদ্দরের পিরহান গায়ে, পরনে খদ্দরের পায়জামা, পায়ে রাবারের স্যান্ডেল, বগলের নিচে গোলাপফুল আঁকা ভাঙা সুটকেস নিয়ে। এসেছিলাম অবশ্যই কবি হতে। আজ অনেক বছর শহরে আছি। আমার সুটকেসের ভেতর আমি নিয়ে এসেছিলাম বাংলাদেশের সবগুলো নদী, পাখি, পতঙ্গ, নৌকা, নর-নারীসহ বহমান আস্ত এক বাংলাদেশ। যেমন, জাদুকররা তাঁদের দ্রষ্টব্য দেখান। আমার ভাঙা সুটকেস থেকে জাতিকে দেখিয়েছি। আমার দ্রষ্টব্য দেখে বাংলার মানুষ কখনো কখনো হাততালি দিয়েছেন, আবার কখনো অশ্রুসিক্ত হয়েছেন। আমি এখনো এই শহরেই আছি। আমি যখন এসেছিলাম তখন আমার বন্ধুদের বগলের নিচে থাকতো সিলেক্টেড পয়েমস জাতীয় ইউরোপের নানা ভাষার নানা কাব্যগ্রন্থ। আমি যেমন আমার ভাঙা সুটকেস থেকে আমার জিনিস বের করে দেখিয়েছি তারাও তাঁদের বগলের নিচের পুঁজি থেকে নানা ভেলকি দেখিয়েছেন। এখনো আমি এই শহরেই আছি। আমার সেসব বন্ধুদের সৌভাগ্য হয়নি। এই মহানগরীতে তাঁদের নাম তরুণরা উচ্চারণ করেন না।”
কবি হওয়ার আজন্ম লালিত স্বপ্ন পূরণ করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি ছন্দ-অন্ত্যমিলের এই রাজাকে।

পরিচিত হয়ে উঠলেন কবি

ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকা এবং কলকাতার ‘নতুন সাহিত্য’, ‘চতুষ্কোণ’; বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত বিখ্যাত ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তাঁর নাম সুপরিচিত হয়ে ওঠে; তাকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে সাংবাদিকতা জগতে পদচারণা শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী ‘কাফেলা’ পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দিলে তিনি সেখানে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন।

১৯৬৩ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘লোক-লোকান্তর’ সর্বপ্রথম তাকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। এরপর ‘কালের কলস’, ‘সোনালি কাবিন’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে উঠো’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, যুদ্ধের পরে ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। মূলত এই সময় তিনি গল্প লেখার দিকে মনোযোগী হন। স্বাধীনতা পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এক বছরের জন্য একবার জেল খাটেন। পরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক পদে নিয়োগ দেন। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর তিনি পরিচালক হন। পরিচালক হিসেবে ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

স্বকীয়তা

আধুনিক বাংলা কবিতায় আল মাহমুদ অনন্য এক জগৎ তৈরি করেন। সেই জগৎ যন্ত্রণাদগ্ধ শহরজীবন নিয়ে নয় – স্নিগ্ধ-শ্যামল, প্রশান্ত গ্রামীণ জীবন নিয়ে। গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতির চিরায়ত রূপ নিজস্ব কাব্যভাষা ও সংগঠনে শিল্পিত করে তোলেন কবি আল মাহমুদ।
তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার শহরমুখী প্রবণতার মধ্যেই ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদী নির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তার কবিতায় অবলম্বন করেন। নারী ও প্রেমের বিষয়টি তার কবিতায় ব্যাপকভাবে এসেছে। বলা যায়, আল মাহমুদ ছিলেন যৌবন ও প্রেমের কবি।
আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ তার অনন্য কীর্তি।

কবি তাঁর কবিতায় যে মৌলিকত্ব, ক্ষমতা ও শক্তির সাথে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের লোকসত্ত্বাকে ধারন করেছেন, তা আর কোনো কবির পক্ষেই সম্ভব হয় নি। আধুনিক বাংলা সাহিত্য কলকাত্তাইয়া বাংলা ভাষার ধার করে আনা ছাঁচ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন পূর্ববঙ্গীয় যে চেহারা ধারণ করেছে, তার পেছনে আল মাহমুদের অবদান তুলনারহিত। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট লেখক, সমালোচক শিবনারায়ণ রায় বলেছিলেন, “বাংলা কবিতায় নতুন সম্ভাবনা এনেছেন আল মাহমুদ, পশ্চিম বাংলার কবিরা যা পারেনি তিনি সেই অসাধ্য সাধন করেছেন।”
বাংলা কবিতার রাজধানীকে কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করার কৃতিত্ব এককভাবে যদি আল মাহমুদকে দেয়া হয়, তাতে কোনো ভুল হবে না।

ইসলামি ভাবধারা

অথচ ঘুমের মধ্যে কারা যেনো, মানুষ না জ্বীন
আমার কবিতা পড়ে বলে ওঠে আমিন, আমিন।”
~ আল মাহমুদ
১৯৯০-এর দশক থেকে তাঁর কবিতায় বিশ্বস্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস উৎকীর্ণ হতে থাকে; এজন্য তিনি তথাকথিত প্রগতিশীলদের সমালোচনার মুখোমুখি হন। ১৯৯৩ সালে বের হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘কবি ও কোলাহল’। ইসলামি আদর্শের প্রতিফলন ঘটতে থাকে তাঁর লেখায়। ফলে এক শ্রেণির প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবী মহল তাঁর সমালোচনায় মেতে ওঠে। ইসলামি রাজনীতির দিকেও কবি কিছুটা ঝুঁকে পড়েন। ফলে তাঁর প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে সেদিকে কবির ভ্রূক্ষেপ ছিল না। তিনি আপন জগতে সমানতালে চালিয়ে যেতে থাকেন তাঁর সৃষ্টিযজ্ঞ। কবি অবজ্ঞাভরে বলেছিলেন, “দাড়ি রাখলে আর ধর্মভীরু হলেই যদি কেউ মৌলবাদী হয়; তবে অবশ্যই আমি মৌলবাদী!”

অবহেলিত কিংবদন্তি

কবি আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে যে অবদান রেখে গেছেন, তাকে একটিমাত্র লেখায় বর্ণনা করা একেবারেই অসম্ভব। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের জাতীয় আত্মপরিচয় গড়ে তোলার একেবারে নেপথ্যের কয়েকজন মানুষের কথা যদি বলতে হয়, তবে তাদের ভেতর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আল মাহমুদের নাম রাখতেই হবে। হুমায়ূন আহমেদ যদি আধুনিক বাংলা গদ্যসাহিত্যের রাজা হয়ে থাকেন, তবে আল মাহমুদ নিঃসন্দেহে কবিতার জগতে একচ্ছত্র সম্রাট।
তবে তারপরেও এই কবি যেন কিছুটা অবহেলিত! কবির প্রাপ্য সম্মানের অনেকটাই হয়তো তিনি পান নি; অন্তত – কবির ধারণা এমনই।
তাঁর প্রবন্ধ সংকলন ‘সাহসের সমাচার’ গ্রন্থে তিনি বারবার এই কথাটাই বলেছেন।
“তোমরা আমাকে বোঝোনি। আমি বলি না বুঝবে না, বুঝবে। তবে তখন আমি আর থাকবো না। তবে এটা মনে রেখো, বাংলা সাহিত্যে যারা কিছু করতে চাও, আমাকে তোমার পাঠ করতেই হবে। এটা আমার আত্মবিশ্বাস।”
এক সাক্ষাৎকারে কবি অভিমান করে বলেছিলেন, “আমার কাঁধে বিরাট সংসার। আমার রোজগার দিয়ে ছেলেমেয়েদের বড় করতে হয়েছে। ভালো কোনো চাকরি আমাকে কেউ দেয়নি। প্রচুর শ্রম দিতে হয়েছে। নানা ধরনের গদ্য লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু করতে পারলাম না। বন্ধুদের, কবিদের দেওয়া মানসিক চাপ উপেক্ষা করে সমাজে জায়গা করে নিতে হয়েছে আমাকে। কেউ কোনো স্পেস আমাকে দিতে চায়নি। অনেক ধাক্কা খেয়েছি, মুক্তিযুদ্ধ করেছি, জেলও খেটেছি। আমাকে বলো, একজন কবি আর কী কী করতে পারে? আমাকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়নি। এখন কোনো কিছুতেই আমার আর আফসোস নেই।”
সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা – স্বাধীনতা পদক তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। তবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন কবি।

মৃত্যু

দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন কবি। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়েছে প্রায় এক দশক হতে চলেছিলো। জীবন প্রদীপের যেটুকু আলো নিভু নিভু করে জ্বলছিলো, সেটিও দপ করে নিভে গেল ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৯ (বয়স ৮২) শুক্রবার রাতে। হাজারো ভক্তকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন এই মহান কবি।

শেষ কথা
কবিদের কি আসলেই মৃত্যু হয়? সেটা কীভাবে সম্ভব? তাদের কথামালা তাদের অমর করে রাখার গুরুভার তুলে নেয় কাঁধের ওপর!
কবি আল মাহমুদ। একটি নাম, একটি ইতিহাস! আল মাহমুদ বেঁচে থাকবেন তাঁর কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে! সোনালি কাবিন, লোক-লোকান্তর, বখতিয়ারের ঘোড়া, কালের কলস, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, পাখির কাছে ফুলের কাছে, কাবিলের বোনের মাধ্যমে তিনি শ্বাস-প্রশ্বাস নিবেন অনন্তকাল।
আমি চলে গেলে এ পারে আঁধারে কেউ থাকবেনা আর;
সব ভেসে গেছে এবার তবে কি ভাসাবো অন্ধকার?
আলো-আঁধারির এই খেলা তবে আমাকে নিয়েই শেষ
আমার শরীর কাঁপছে যেমন কাঁপছে বাংলাদেশ।”
~ আল মাহমুদ
আল মাহমুদ কখনোই মৃত্যু বরণ করবেন না। তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্ত কাল। যতদিন বাংলা থাকবে। বাংলায় কথা বলার মানুষ থাকবে।
আমাদের মাঝে চিরজীবন বেঁচে থাকবেন কবি। আমাদের প্রিয় কবি আল মাহমুদ।

রেফারেন্স:
https://m.poemhunter.com/al-mahmud/
http://www.dailynayadiganta.com/diganta-shahitto/330539/-কবি-আল-মাহমুদ
https://www.thedailystar.net/news-detail-45124
https://www.ekushey-tv.com/আল-মাহমুদের-কবিতায়-নারী-ও-প্রেম/21018

টেনমিনিট স্কুল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *