কবি ফররুখ আহমদের বেতার জীবন

তালুকদার নূর-উজ-জামান ।।

ফররুখ আহমদকে আমরা কবি হিসেবেই বেশি চিনি ও জানি । কিন্তু একটিমাত্র পেশাগত জীবন নিয়েই একজন কবি সারাজীবন সন্তুষ্ট থেকে কালাতিপাত করে যাওয়ার ঘটনা বিরল বটে। অন্তত কবিদের জন্য এ ঘটনা নেহায়েত কমই আছে। সে বিবেচনায় কবি ফররুখ আহমদের ব্যক্তিগত পেশাজীবন একটি ভিন্ন মাত্রায় অভিষিক্ত। হ্যাঁ, কবি ছিলেন বেতারের একজন নিয়মিত শিল্পী। প্রযোজনা, উপস্থাপনা, আবৃত্তি এমনকি গান লেখা, সুর করা থেকে শুরু করে বেতারের জন্য প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার- তার সবগুলো অঙ্গনেই তাঁর সূচারু পদচারণা ছিল আপাদমস্তক একজন আদর্শিক পেশার মানুষের মত।

গত শতকের চল্লিশের দশকের কবি হয়েও ফররুখ আহমদ ছিলেন সকলের ব্যতিক্রম। শুধু পেটের দায়ে চাকুরী করলেও পেশাকে তিনি তার সবটুকুই উজার করে দিতেন। আবার কবি স্বত্তার বিকাশেও তার মনোযোগ ছিল সদা আত্মিক। বিশ্বাসী কবির জীবন চরিত এমনটাই হওয়ার দাবি রাখে বলেই আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় ‘কবি ফররুখ আহমদের বেতার জীবন।’
১৯১৮ এ জন্ম নিয়ে ১৯৪২-৪৩ এ পড়ালেখার পাঠ চুকান কবি ফররুখ আহমদ। ১৯৪৩ এ প্রথম চাকরী নেন কলকাতার আইজি প্রিজন অফিসে। ১৯৪৪ এ সিভিল সাপ্লাইয়ে, ১৯৪৫ এ মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় সম্পাদনা বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৪৬ এ জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরী করেন। ১৯৪৭ এ মোহাম্মদী পত্রিকার চাকরী ছেড়ে দিয়ে বেকারত্বের তকমাও গায়ে মাখেন। ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পরে সপরিবারে চলে আসেন গ্রামের বাড়ি যশোর, এক পর্যায়ে আসেন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায়। ওঠেন বন্ধুবর কবি বেনজীর আহমদ এর বাসায়। বেকারত্বের ঘানি টেনে টেনে যখন দিশেহারা তখন আরেক বন্ধুবর কবি সৈয়দ আলী আহসান এর সহযোগিতার প্রথমে পাকিস্তান বেতারে অনিয়মিত এবং পরবর্তীতে নিয়মিত শিল্পী হিসেবে শুরু করেন পেশাজীবন। জীবনের শেষতক ছিলেন এ পেশায়। যদিও চড়াই উৎরাই যারপরনাই গিয়েছে তার উপর দিয়ে অনেক।
এতদিনে তার কাব্য খ্যাতি আকাশ ছোঁয়া। জীবনের বাঁক পরিক্রমায় প্রথমে বাম আদর্শ এবং পরবর্তীতে ইসলামী আদর্শের মৌলিকত্বে বিশ্বাসী কবির জীবন নদী বহমান হতে থাকে কালোত্তীর্ণের দিকে।
বেতারের প্রয়োজনে কবি রচনা করতে শুরু করেন আধুনিক, দেশাত্ববোধক, হামদ-না’ত সহ নানা গানের কথাকলি। রচনা করতে থাকেন নাটিকা, গীতিকাব্য, গীতিনাট্য, গীতিনকশা, গদ্য নাটিকা এসবও।
পরিচালনা, প্রযোজনাতো চলছেই। আবৃত্তিকার হিসেবেও খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন এসময়ে। বাঙ্গালী ভাষা সাহিত্যের একেবারে শিকড় বা নাভিমূল হলো প্রাচীন পুথিঁ সাহিত্য। ফররুখ আহমদ পুথিঁ পাঠের বিষয়টাকে আড়ম্বরপূর্ণতার চুড়ান্ত উচ্চতায় নিয়ে যান। রচনাও করতে থাকেন পুথিঁর নানান শ্লোক।
পঞ্চাশের দশকে এসে একটি কালজয়ী এবং ওই সময়ের জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জধর্মী শিক্ষামুলক অনুষ্ঠান ‘কিশোর মজলিশ’ পরিচালনা শুরু করেন। দেশ বিভাগোত্তর একটি উত্তাল সময়ে মুসলিম শিশুদের নিয়ে বেতারের মত একটি অজনপ্রিয় মাধ্যমে এরকম অনুষ্ঠান পরিচালনা করা ছিল তখন খুবই দৃরূহ ও কষ্টসাধ্য। কিন্তু ফররুখ আহমদ অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে নিজে ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে শিশুদের সংগ্রহ করে করে অদম্য আগ্রহে অনুষ্ঠানটি আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছিলেন কষ্টেসৃষ্টে।
এরই মধ্যে বাঁধে বিপত্তি। ১৯৫১ সালে ১৫ জন কর্মীসহ ছাঁটাই হন কবি ফররুখ আহমদ। ১৭ দিন ব্যাপী ধর্মঘটের পরে পূনর্বহাল হন স্বপদে।
‘কিশোর মজলিশ’ নামক এই অনুষ্ঠানটিই মূলত ফররুখ আহমদকে শিশুদের কবি হিসেবে সর্বোচ্চ অভিধায় অভিষিক্ত করে দেয়। ছোটবেলায় মায়ের মুখ থেকে শেখা কিছু ছড়ার স্মৃতি যদি আমরা আওরাই তাহলে ‘বৃষ্টির ছড়া’ টি প্রথমেই কানে বাজবে-
‘বৃষ্টি এলো কাশবনে, জাগলো সাড়া ঘাসবনে
বকের সাড়ি কোথা রে, লুকিয়ে গেল বাশবনে
নদীর নামটি কেয়া যে, ডাকলো দূরে দেয়া যে,
আবার-
ঝুমকো জবা কানের দুল, উঠলো ফুটে বনের ফুল।
সবুজ পাতা ঘোমটা খোলে, ঝুমকো জবা হাওয়ায় দোলে
সেই দুলুনির তালে তালে, মন উড়ে যায় ডালে ডালে।
ইত্যাদি আরও কত ছড়া।
পাকিস্তানিদের অনিয়ম অনাচার ও শোষণ জুলুমের বিরুদ্ধে ফররুখ আহমদ ছিলেন সদা জাগ্রত। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের একেবারে গোড়ার দিক থেকেই কবি তার অবস্থান সুস্পষ্ট করেন। বাংলা ছিল তার প্রাণের প্রতিটি ধমনীতে পরিবাহিত। তাইতো আগাগোড়া মুসলিম রেনেসাঁর কবি তকমায় অভিহিত হয়েও শুধু মুসলিম হয়ে পাকিস্তানের জুলুমকে তিনি কখনই ভালোভাবে নেননি বরং প্রতিবাদে ছিলেন সর্বদাই সোচ্চার। পাকিস্তান সরকারের দেয়া প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরষ্কার তিনি সচেতনভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তার পেশাগত জীবনে তিনি কোনো পদোন্নতি তো পানইনি, বরং দুই দুই বার তাকে অধস্তন করা হয়েছে।
শতভাগ সততার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে কবি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন আপোষহীন, প্রতিবাদী, সত্য ও বিশ্বাসের ধারক বাহক হিসেবে। আর্থিক টানাপোড়েনকে তোয়াক্কা না করে নৈতিকতার লৌহপিঞ্জর গায়ে চড়িয়ে চলেছেন মাথা উচু করে। তাইতো সুযোগ সন্ধানী ভোলপাল্টানো সুবিধাবাজদের মত তিনি স্বার্থের লেবাস পরেরননি কখনো।
তাইতো ফররুখ আহমদ সাহিত্যপদকে ভূষিত কবি মুসা আল হাফিজ এবিষয়ে চমৎকার বলেছেন ‘তার প্রথম এবং প্রধান পরিচয় তিনি কবি। তার কবিতা কেবল কবিতাই। যেমনটি কোলরিজের কবিতা, পার্সি বি শেলির কবিতা। সে কবিতার অন্তর্দেশে ইসলামী ভাবাদর্শ আছে, ঐতিহ্য আছে, জাগরণের স্বনন আছে। তার কবিতার পর্যালোচনায় সেটা উল্লেখ হতে পারে, অবশ্যই। কিন্তু মুসলিম জাগরণের কবি ইত্যাদি অভিধায় ফররুখকে একঘরে করার চেষ্টাকে আমি সাহিত্যিক সততার মধ্যে ধরিনা।’

আর্থিক অনটনের নিদারুণ কষ্টে পতিত হয়েও তিনি নৈতিকতার ঝান্ডা উচ্চকিত করে জীবন অতিবাহিত করছিলেন আপন লয়ে। জীবনের শেষ লগ্নে এসে স্বাধীনতা উত্তর ভোল পাল্টানো পিশাচদের কুটচালে চাকুরীচ্যুত হন। বঙ্গবন্ধু পরে জানতে পেরে নরাধমদের দুকথা শুনিয়ে দিয়ে দ্রুত কবিকে তার সপদে পূনর্বহাল করতে নির্দেশ প্রদান করেন।
সেই দু:সময়ের স্মৃতি ও কবির প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকে কথা সাহিত্যিক আহমদ ছফা লেখেন- ‘ফররুখ আহমদের অপরাধ শেষ পর্যন্ত এই দাঁড়ায় যে, তিনি অন্যান্য বিশ্বাসঘাতকদের মত শ্লোগান বদল করতে পারেননি। সৎ কবিরা অনেক সময় সস্তা বুলিতে গা ঢেলে দিতে পারেন না। সেটাই তাদের একমাত্র অপরাধ। কবি ফররুখ আহমদও এই একই অপরাধে অপরাধী।’
তাদের যদি বিবেক থাকতো, যদি সাহিত্যে এবং সাহিত্যিকদের প্রতি প্রেম থাকতো কবি ফররুখ আহমদের মেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যেত না। কবিকে বৃদ্ধ বয়সে উপোস করতে হত না। আমরা ফররুখ আহমদকে বাঁচাবার জন্য, তার পরিবারকে বাঁচাবার জন্য ‘ফররুখ আহমদ সাহায্য তহবিল’ গঠন করার জন্য কবির অনুরাগীজন এবং দেশপ্রেমিক, সংস্কৃতিপ্রেমিক জনগণের কাছে আবেদন রাখছি।–গণকণ্ঠ, ১৬ জুন- ১৯৭৩

পূর্ব পাকিস্তান বা ঢাকা বেতারের কর্মজীবন ছিল কবির নানান ঘটনায় ঋদ্ধ। সুখ্যাতি যেমন ছিল সেখানে আবার দূর্নামের তকমাও ছিল।
আদর্শিক কাব্য চেতনায় অনুরণিত কবি ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর হিজরি সনের আরবী মাস রমজানের সম্মানিত লাইলাতুল ক্বদর তথা ২৭ রমজান কবি তার স্রষ্টার উদ্দেশ্যে ইহলোক ত্যাগ করেন।
মানবিক কবি সত্তার মিশেলে, আত্মিক বিশ্বাস ও বাহ্যিক কর্মযজ্ঞের সমন্বয়ে একজন আপাদমস্তক আদর্শিক মানুষ ছিলেন কবি ফররুখ আহমদ। চরিত্রের চিত্রায়ণে শতভাগ চরিত্রবান ছিলেন কবি। নিন্দুকদের অসত্য প্রচারের প্রকরণে তাকে বিভাজিত করা হয়তো সহজ সাধ্য বটে, কিন্তু সত্যায়নের পরশ পাথরে তিনি আজীবন কালোত্তীর্ন কবি।

তালুকদার নূর-উজ-জামান 
ব্যাংকার ও লেখক
০১৭৬৬৬৬৬৫

তথ্যসূত্র: মুক্তবুলি ম্যাগাজিন ৩৩ তম সংখ্যা (মে-জুন ২০২৪)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *