শফিকুল ইসলাম ||
কথায় আছে, করো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ। সহজ কথায় যখন কারো খুব খারাপ সময় যাচ্ছে ঠিকই একই সময় অন্য কেউ খুব ভালো সময় পার করছে । বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস যেমন কেড়ে নিয়েছে হাজার হাজার চাকুরি, হাজারো স্বপ্ন, ঠিক একই সময় ঘুরে দাঁড়াবার সুযোগ পেয়েছেন অনেকেই। হয়েছেন সফল উদ্যোক্তা। তেমনই এক ব্যতিক্রমী গল্পের নায়িকা তরুণ উদ্যোক্তা সিমা।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় স্কুল শিক্ষার্থীদের বৃক্ষরোপণে উদ্ভুদ্ধ করে ঘরের আঙিনা থেকে কংক্রিটের চার দেয়ালের মাঝেও সবুজায়নের এক বিপ্লবের নাম ইনডোর প্লান্ট শপ।
দশটি প্লাস্টিকের বোতলের বিনিময়ে স্কুল শিক্ষার্থীদের একটি গাছ উপহার দেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান সিমা। গত বছরের শুরুর দিকে বরিশালের বেলস পার্ক,আমতলা লেক পাড়,দপদপিয়া ব্রীজের নীচের বস্তিগুলো, কর্ণকাঠীর ভোলা রোডের পাশে স্কুল শিক্ষার্থীদের প্লাস্টিকের বোতলের বিনিময়ে গাছ উপহার দিয়েছেন তিনি।
৩ শত নানান রকমের প্লান্টার বা পাত্রের কালেকশন নিয়ে রঙ, তুলি, মাটির পাত্র, পাটের সুতা,বাঁশের ঝুড়ি ইত্যাদির মাধ্যমে নিজের মত করে শৈল্পিক রূপ দিতেন সিমা।
করোনাকালে পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস বাবার বেতন বন্ধ হলে সেই শৈল্পিক হাতই হাল ধরেছে পরিবারের। গড়ে তুলেছেন ইনডোর প্লান্ট শপ নামে এক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। পেয়েছেন সাফল্য। বরিশালে এই কাজ সর্বপ্রথম (Indoor Plant Shop) ইনডোর প্লান্ট শপ থেকে শুরু হলেও এখন তার দেখাদেখি অনেকেই শুরু করছেন।ছোটবেলা থেকেই গাছের প্রতি ভালোবাসা সীমার। বড় বোন রীমা তার অনুপ্রেরণা। রীমার বাগান করার উৎসাহ উদ্দীপনা একটু একটু করে নিজের মধ্যেও বীজ বুনতে শুরু করেন সীমা। ২০১৬ সালে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরেই কাজের শুরু। কনক্রিটের বাসায় ছোট ছোট পটারিতে,বাশের ঝুড়িতে,প্লাস্টিকের ছোট পাত্রে প্রচুর গাছ রাখতেন। পরিবেশ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখার পাশাপাশী একজন সফল উদ্যোক্তা কিভাবে হওয়া যায় পরিকল্পনা তার। সময়ের সাথে সাথে শখও বাড়লো আর গাছের সংখ্যাও। নিজেই গড়লেন বাগান।
প্রথমে ঢাকা এবং যশোর থেকে কুরিয়ারের মাধ্যমে গাছ সংগ্রহ করে তারপর সেগুলো থেকে নিজেই চারা করেন। বরিশালের স্বরূপকাঠি,কাশিপুর,ব্যাপটিস্ট মিশনের নার্সারীগুলোও তার সংগ্রহশালা, তবে অনলাইন থেকে বীজ সংগ্রহ বা বিনিময় করা হয় বেশিরভাগ সময়। ঢাকার দোয়েল চত্বর,পান্থপথ, বরিশালের বাউফল,উজিরপুর থেকে পটারি, বাঁশের ঝুড়ি সংগ্রহ করে সেগুলোতে ছোট ছোট গাছ যেগুলো একদম ঘরের কম আলোতে, কম যত্নে বেড়ে ওঠে সেগুলো সেট করেন।
নিজের কোন নার্সারী না থাকলেও গ্রামের বাড়ি বানারিপাড়ার চাখারে গড়েছেন ছোট্ট একটি বাগান। পড়াশোনা,ক্লাস, পরীক্ষা, টিউশনের ফাঁকে ফাঁকে কাজ করতেন নিয়মিত। পরীক্ষা, ক্লাস,টিউশনের চাপে ছেড়ে দিয়েছিলেন সব কাজ। সিমা বলেন, ” মার্চ মাসে করোনায় বন্ধ হয়ে যায় আমার ক্লাস, টিউশন সহ সব ধরনের আয়ের উৎস।আমার বাবা ডিপিডিসি একজন কনট্রাকটর।কোভিডের কারনে তার সকল কাজ পাওনা বিল আটকে যায়। হঠাৎ করেই সব অন্ধকার হয়ে আসে।
বাবার কাজ না থাকায় পারিবারিক জমা থেকে এক মাসের মত আমরা বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে সকল খরচ বহন করতে পেরেছিলাম।পরিবারে হতাশার ছাপ শুরু হয়ে যায়।আমি নিজেও হতাশার বাইরে ছিলাম না। হতাশা থেকে বের হতে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে শুরু করলাম সেই বাগান করার শখটাকে জাগ্রত করে। মাঝে মাঝে সোশাল মিডিয়ায় প্রিয় গাছগুলোর ছবি দিতাম।খেয়াল করলাম আমার ছবিগুলোতে মানুষের আগ্রহ। আর বসে থাকিনি, পুরানো কাজকে নতুনভাবে সাজিয়ে আবারো একবার শুরু করলাম। আমার কাছে অনেক রকমের প্লান্টার বা পাত্রের কালেকশন ছিল।আর নিজের ৩ শত এর বেশি গাছ ছিল।রঙ,তুলি,মাটির পাত্র,পাটের সুতা,বাশের ঝুড়ি সব নিয়ে কাজ করেছি রাত-দিন।গাছ লাগানো,রোদ-বৃষ্টিতে দেয়া,ছবি তোলা,লোগো বসানো,আপলোড করা,কাস্টোমারদের হাজার প্রশ্নের উত্তর দেয়া সব করেছি একা হাতেই আর মাথার উপর বট গাছের মত ছাঁয়া হয়ে মা সাহায্য করেছে।
আমার হাতে কাদা মাখানো আর মা ভাত দদখায়িয়ে দিতো, এটা ওটা দরকারি জিনিস কাছে এনে দিতো। কখনো দেরিতে ঘুম থেকে উঠলে আগেই গাছগুলো তে পানি দেয়া।অর্থাৎ মা’কে ছাড়া আমি একচুলও আগাতে পারতাম না।”
পরিবারের অন্য সদস্যরা বলেছিলেন এই করোনায় জীবন নিয়ে টানাটানি মানুষ এসব কিনবে না। কিন্তু সিমার মা আশা জুগিয়েছিলেন তাকে। কাজ শুরু করার ১ সপ্তাহেরর মধ্যে প্রায় ৩ হাজার টাকা বিক্রি হয়। আশার আলো দেখলেন সিমা। দিনরাত পরিশ্রম করতে শুরু করলেন মন প্রান দিয়ে। এরপর আর কাজ থামাতে হয়নি। পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি বরং প্রতিদিন ডেলিভারি পাঠিয়ে হাপিয়ে উঠতেন।
তবে কাস্টোমার স্যাটিসফেকশনের ব্যপারটা সবসময় মাথায় ছিল তার। তাই শহর জুড়ে পরিচিতি বেড়েছে অনেক। খরচ বাদ দিয়ে যা আয় হত তাতে পরিবারের খরচ মিটিয়ে বেশকিছু নিজের থেকে যায়। তা দিয়ে আবার নতুন করে বিনিয়োগ করেন।
করোনাকালীন সময়ে বিক্রি না কমে অবিশ্বাস্যভাবে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বিক্রি বাড়ে দ্বিগুণ। ডেলিভারি সিস্টেমও খুবই সহজ। ফেসবুক পেইজে নির্দিষ্ট গাছের ছবিসহ নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর ইনবক্স করতে হয়।শহরের বাইরের অর্ডারের ক্ষেত্রে প্রিপেইড সিস্টেম অর্থাৎ আগে বিকাশ করতে হয়। এবং শহরের ভেতর ক্যাশ অন ডেলিভারি সিস্টেমে গাছ পৌঁছে দেয়া হয়।এছাড়া নির্দিষ্ট পিক আপ পয়েন্ট থেকে অনেকেই গাছ সংগ্রহ করে থাকে কোন ডেলিভারি চার্জ ছাড়াই। স্কুল শিক্ষার্থীদের মাঝে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্লাস্টিকের বোতলের বিনিময়ে একটি গাছ উপহার দিয়ে সবুজ বিপ্লবের শুরু হলেও এরজন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা পাননি। তবে স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা নাছোড়বান্দা। যারা কোন প্লাস্টিকের বোতল দিতে পারেনি তারা কথা দিয়েছে এবছর সবাই বেশি করে বোতল জমিয়ে গাছ নিবেই-নিবে। সিমা নিজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান থেকেও সংগ্রহ করেছেন অসংখ্য অব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতল।
ক্যাম্পাসে ছেলেদের কটুক্তির স্বীকার হলে থেমে যায়নি সিমার বোতল সংগ্রহের কাজ। অনেক বন্ধুরাও বাড়িয়েছে সহায়তার হাত। যে বোতল গুলো সংগ্রহ করা হয় সেগুলোই রঙ করে বিভিন্ন কার্টুন শেইপ দিয়ে কেটে ত গাছ লাগিয়ে বাচ্চাদের উপহার দেনন তিনি। যাতে বাচ্চাদের মাঝে গাছ লাগানোর আগ্রহ বাড়ে আর সাথে সাথে দূষন না করে রিসাইকেলিং এর ব্যপারে সচেতনতা তৈরি হয়।
নদী ভাঙন রোধে নিজ গ্রামের নদীরে পাড়ে স্ব উদ্যোগে বাবার সহায়তায় লাগিয়েছেন শতাধিক গাছ। এছাড়া বিনামূল্যে পরিচিতজনদের অনেকের বাড়ির আঙিনা সাজিয়েছি নানান জাতের দৃষ্টিনন্দন বৃক্ষরোপন করে। করোনাকালে অনুষ্ঠিত
জাগো ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত “সবুজ বাচাও কর্মসূচীতে অংশগ্রহণের পাশাপাশী অনলাইনে বৃক্ষরোপন সংক্রান্ত অসংখ্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছেন নিয়মিত। সরব হচ্ছে অনলাইন ক্যাম্পেইনে।
করোনাকালে হতাশার কালো মেঘ কাটিয়ে পরিবারের কাছে আশার আলো নিয়ে ফিরেছেন ইসরাত জাহান সিমা। নারী হয়েও বিপদে শক্ত হাতে হাল ধরেছেন পরিবারের। হয়েছেন সফল উদ্যোক্তা। প্লাস্টিকের দূষণ রোধ ও পরিবেশ বান্ধব সমাজ বিনির্মাণে ব্যতিক্রমী এই সবুজের অভিযান চালিয়ে নিতে চান বহুদূরে।