করোনা পরিস্থিতি: জাগ্রত হোক মানবতা

জহুরুল ইসলাম জহির

অনেক সময় সন্তান বাবা মাকে আগলে না রাখলেও পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে বাবা মা নিজের জীবনের বিনিময় হলেও সন্তানকে বুকে আগলে রেখেছে। এটাই চিরাচরিতভাবে শুনেছি ও দেখেছি। এরও যে, বিপরীত চিত্র আছে তা বৈশ্বিক মহামারি করোনা না আসলে হয়তো অজানা থেকে যেত।

আলেমদের কাছ থেকে জেনেছি, কেয়ামতের দিন কেউ কাউকে চিনবে না। না বাবা-মা সন্তানকে, না সন্তান-বাবা মাকে, না স্বামী প্রিয়তমা স্ত্রীকে, না স্ত্রী প্রিয় স্বামীকে। প্রত্যেকেই ইয়া নাফসী-ইয়া নাফসী করবে। সেই চিত্র কেয়ামাতের আগেই মহান আল্লাহ তায়ালাতা ইহজগতের মানুষকে দেখিয়েছে বিশ্বব্যাপি দাবড়িয়ে বেড়ানো মহামারি করেনার পদার্পনে। করোনা কি অভিশাপ না অর্শিবাদ? ইউটিউবের বদৌলতে মিশরের একটি টিভি চ্যানেলের একটি ভিডিও দেখেছি। ভিডিওটির নিচে বাংলায় লেখাগুলো পড়ছিলাম। তাতে দেখা গেছে মিশরের একটি মসজিদে খুৎবার বয়ানে ইমাম সাহেব করোনাকে স্বাগত জানিয়ে বলছেন, করোনা- আলহামদুলিল্লাহ- করোনা আমাদের পাপাচার থেকে বিরত রেখেছে, আলহামদুলিল্লাহ- করোনা বিশ্বের বন্ধ মসজিদগুলোকে খুলে দিয়েছে, আলহামদুলিলাহ- করোনা আযান নিষিদ্ধ রাস্ট্রে আযান চালু হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ- করোনা নামাজ বন্ধ মসজিদে নামাজ পড়ার অনুমতি পেয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ- করোনা পৃথিবীর নিজেকে শক্তিধর ঘোষণাকারী মানুষকে হিংসা বিদ্বেষ ভুলে ভীত সন্ত্রস্থ ও নতজানু করেছে, আলহামদুলিল্লাহ- করোনা ক্ষমতাধর- অহংকারী রাষ্ট্র নায়করা আল্লাহর কাছে নিজের অসহায়ত্ব কথা জানিয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ- কারোনা বিশ্বের অসহায় মজলুম শোষিত নিপীড়িত মানুষের কথা শুনেছে। আলহামদুলিল্লাহ- করোনা স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকারকারী আত্মঅহংকারী মানুষকে স্রষ্টার অস্তিত্বকে স্বীকার করতে বাধ্য করেছে, আলহামদুলিল্লাহ- করোনা আমাদের তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে আসার সুযোগ দিয়েছে। ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অনেক কিছু একের পর এক বলছিলেন।

হ্যাঁ, আমি মিসরের ওই ইমামের বয়ানের সঙ্গে একমত পোষণ করছি। করোনা পৃথিবীর মহাক্ষমতাধর স্বেচ্ছাচারী মানুষের প্রতি প্রকৃতির এক নির্মম প্রতিশোধ। হাদিসে বর্নিত আছে, প্রজা যখন পথভ্রষ্ট হয়- শ্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, তখন আল্লাহতায়ালা প্রজার ওপর জালিম শাসক চাপিয়ে দেন। জালিম শাসক যখন জুলুম-অত্যাচারের সীমা লংঘন করে আত্মঅহংকারী হয়ে অপ্রতিরোধ্য স্বেচ্ছাচারীতায় লিপ্ত হন, আল্লাহ তখন মহামারি দিয়ে পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন । বর্নিত হাদিসের আলোকে বিশ্বের দুই একটি রাষ্ট্রের সামান্য কিছু উদাহরণ তুলে ধরছিঃ

বৈশ্বিক মহামারি করোনার উৎপত্তিস্থল চীন। চীনের শিংজিয়ানে উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর সমাজতান্ত্রিক বৌদ্ধীষ্ট শাসকের নির্মম, নিষ্ঠুর অমানবিক অত্যাচারের চিত্র কারোরই অজানা নয়, সিরিয়ায় বিশ্বব্যাপি আলোচিত ও শিহরণ জাগানো শিশুর কথা আমাদের প্রত্যেকের নিশ্চয় মনে আছে। আমি আল্লাহকে সব বলে দিবো । ইসরাইল, ফিলিস্তান, কাস্মীর, ভারত, আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে মুসলিম নিধনের চিত্র সবারই জানা । গোটা পৃথিবী যখন জালিম শাসকের অপ্রতিরোধ্য ছোবলে ক্ষত বিক্ষত। ছিন্নভিন্ন মানবতা। তখন ভারসাম্যহীন পৃথিবীতে ভারসাম্য সৃষ্টি ও সাম্যতা আনয়নে করোনা অল্লাহর প্রেরিত মহামারি নয়তো? কারণ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকে বিশ্বের প্রভু হয়ে উঠার জন্য অসম প্রতিযোগিতায় নেমেছে আমেরিকা, চীন, কোরিয়া, রাশিয়া, জার্মানি ও জাপানসহ ক্ষমতাধর রাষ্টগুলো। তারা মেধাবীদেরকে নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরীর কাজে নিয়োজিত করেছে। বিশ্ব জয়ে বিভোর ক্ষমতাধর রাষ্ট্র নায়কদের শিক্ষা দিতেই হয়তো করোনা আল্লাহর প্রেরিত ভাইরাস।

করোনা হয়তো একথাই জানিয়ে দিতে এসেছে, তোমরা অদৃশ্য সামান্য একটি ভাইরাস সামাল দিতে পার না, কি নিয়ে এত অহংকার- গর্ব কর? তাই আর দেখতে চাইনা- বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের বিশ্ব মোড়ল হওয়ার অশুভ প্রতিযোগিতার হত্যাযজ্ঞ, আর দেখতে চাইনা- মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে মানুষের প্রতি নির্মম নির্যাতন, আর দেখতে চাইনা- ধর্মীয় গোড়ামির ধূয়া তুলে মুসলিম নিধন। অনতিবিলম্বে বন্ধ করা হোক, ইসরাইল, ফিলিস্তান, সিরিয়া, কাস্মীর ও চীনের উইঘুরসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে মুসলিম নিধন ও নির্যাতন।

বন্ধুরা আমি আমার লেখার মূল বিষয়বস্তুতে ফিরে যাচ্ছি। যেই প্রিয় মানুষগুলোকে এক নজর দেখার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতাম, যেই প্রিয় মানুষগুলোর সান্নিধ্য লাভের আশার দিন গুনতাম আজ প্রাণ ভয়ে নিজে বেঁচে থাকার আশায় সেই মানুষগুলোর সঙ্গে কি নির্মম-বিভৎস আচরণই না আমরা করছি। শুধুমাত্র করোনা আতঙ্কে গহিন বনে সন্তান মাকে ফেলে যাচ্ছে, এক স্বজন রাস্তায় ফেলে যাচ্ছে আরেক স্বজনকে, বাবা মা সন্তানকে ঘরে উঠতে না দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে, স্বামীকে ফেলে বাবার বাড়ি চলে যাচ্ছে স্ত্রী, ঘরে লাশ ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে পরিবারের লোকজন। হয়তো করোনা নয়! অন্যভাবে অসুস্থ্য হযে রাস্তায় পরে কাতরাচ্ছে মানুষ। আর আমরা দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছি এবং মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করছি। হৃদয় বিদারক এসব ঘটনাগুলো কিন্তু সামান্য কয়েকদিনে আমাদের আশপাশের ঘটনারই বর্ননা। মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে শুধু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে আমরা এতটা মরিয়া? ভুলে গেছি সকল সম্পর্ক? ভুলে গেছি সকল মমতা- স্নেহ-ভালবাসা? ভুলে গেছি জীবনের সেই স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা? ভুলে গেছি সকল মানবিকতা? আর দেখতে চাইনা-করোনার ভয়ে প্রিয়জনের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ, আর দেখতে চাইনা করোনা ভয়ে কোন সন্তান মাকে বনে ফেলে যাক, আর দেখতে চাইনা-করোনা ভয়ে কোন বাবা মা সন্তানকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, আর দেখতে চাইনা-করোনা ভয়ে কোন ভাই স্বজনকে রাস্তায় ফেলে যাক। বন্ধ করা হোক এ নির্মম ও নিষ্ঠুর আচরণ।

প্রিয় পাঠক ও বন্ধুরা, মৃত্যুর দিন, তারিখ, সময়, স্থান ও ক্ষণ পূর্ব নির্ধারিত। তাহলে এত ভয় কেন? এর মানে এই নয় যে, আমি আপনাকে করোনার রোগীর সঙ্গে মোলাকাত বা আলিঙ্গন করতে বলছি। এর অর্থ এই নয় যে, আমি আপনাকে করোনা সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে অবাধে মিশতে বলছি। আমি বলতে চাচ্ছি, বিজ্ঞ চিকিৎসকের নির্দেশনা ও সরকারি নীতিমালার মধ্যে থেকেই আমরা করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে মানবিক আচরনটুকু করতে পারি। করোনা নিশ্চিত না হয়ে শুধু ধারনা বা আতঙ্ক থেকে আমরা আমাদের মানবতাবোধ মানসিকতাকে জলাঞ্জলি না দেই।

এ কথাগুলো বলার একটিই কারণ। করোনাকে ভয় নয়, সাহসের সঙ্গে জয় করতে হবে। সতর্ক থেকে সচেতনভাবে স্বজনদের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে হবে। ভালবাসা স্নেহ মমতা দিয়ে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে সহযোগিতা করতে হবে। চিকিৎসা নীতিমালা অনুসরণ করে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরিচর্যা দিয়ে সুস্থ্য করে তুলতে হবে। অটুট রাখতে হবে পারিবারিক, সামাজিক ও হৃদয়ের বন্ধন। সর্বোপরি আমি যে কথাটি বলতে চাই তা হল, বিপদে-আপদ, বালা মুসিবত অল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে পরীক্ষা ও সতর্কবার্তা। তাই যে কোন সংকটে আমাদের মহান প্রভূর শরনাপন্ন হতে হবে। দোয়া দরুদ ও নেক আমল করলে যেমন সওয়াব বা পুন্য লাভ হয়, তেমনি বিপদ-আপদ, আজাব-গজব থেকে রেহাই পাওয়া যায়। তোমরা তোমাদের পালন কর্তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো, নিশ্চয় তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল (সুরা নুহ আয়াত-১০)। হে আল্লাহ আমি আপনার সমীপে আমার সকল অপরাধ স্বীকার করছি। সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। যেহেতু আপনি ছাড়া আমার কেউ নেই। হে আল্লাহ তুমি করোনার গজব থেকে বিশ্ব মানবকে হেফাজাত কর। পবিত্র মাহে রমজানের উসিলায় সারা পৃথিবী থেকে করোনা তুলে নিয়ে আমাদের প্রতি দয়া কর। আমিন।

লেখকঃ জহুরুল ইসলাম জহির, সিনিয়র সাংবাদিক, প্রতিনিধি, প্রথম আলো।

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *