টি.এম. জালাল উদ্দীন
মানুষ আহত হয় শারীরিক ও মানসিক ভাবেই। বাচ্চারা ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখেও কেঁদে ওঠে। ও বয়সে আমিও অনেক স্বপ্ন দেখে হেসেছি কেঁদেছি। সামনে রসগোল্লার প্লেট দেখে আনন্দে হেসে উঠেছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে আবার কেঁদে ফেলেছি। সে গেল ছোট বেলার কথা। আমি এখনও অনেক কিছু দেখে হাসি, কাঁদি ও মর্মাহত হই। কোনটা বলি আর কোনটা বলতে পারি না। এ নিয়ে আমাকে বন্ধু বান্ধবদের অনেক ঠাট্টা-বিদ্রোপ শুনতে হয়।
সেদিন এক রিক্সাওয়ালাকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজে যাবার কথা বললে সে হা’করে তাকিয়ে রইলো। সে নাকি এমন নাম কখনো শোনেনি। অবশেষে বলল, স্যার আমরা অত প্যাঁচ-গোছের কথা বুঝি না। বলবেন, সাগরদী মেডিকেলে যাব। আমি একটু হেসে রিকশায় উঠে তাকে শের-ই-বাংলা সম্পর্কে অনেক কথা বললাম। বললাম, কসাই মসজিদটি আসলে কোন কসাই তৈরি করে নাই। ওটি শের-ই-বাংলার বাবা তার স্ত্রী সায়েদ উন্নিসার স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মাণ করেন—–। আমি একা একাই বকবক করে যাচ্ছি। বেচারার এদিকে কোন লক্ষ্য নেই। আমি উলোবনে মুক্তা ছড়ানো বাদ দিয়ে চুপ করে রইলাম। ভাবলাম এদেরকে আর কী বলব। শিক্ষিতরাই তো কিছু জানেনা। জানতেও চায় না।
আমি সেদিন বাংলার অক্সফোর্ড বি এম কলেজের তিনজন ছাত্রের কাছে বরিশালের দুজন বিখ্যাত ব্যক্তির নাম জানতে চাইলাম। উত্তরে অনেক ভেবে একজন হানিফ সংকেত ও মোশাররফ করিমের নাম বলল। আর একজন দুজন এমপি’র নাম বলল। অন্যজন কোন উত্তর না দিয়ে হেসে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
শের-ই-বাংলা’র স্মৃতির উদ্দেশে আমি একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখছি। আমার এ স্বপ্ন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আমার এক বন্ধু বলল, তোমার যত উদ্ভট পরিকল্পনা। শের-এ-বাংলার জন্য তার ছেলে, নাতী আত্মীয়-স্বজন কেউ কখনো কিছু ভাবেননি। ভাবছেন না। তোমার যত ফাও চিন্তা। যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া-পড়শীর ঘুম নাই। আমি তাকে বললাম, তোমার কথা ফেলে দেবার মত নয়। অবশ্যই যুক্তি আছে, কিন্তু ভক্তি নেই। আমার ভক্তি নেই একটি মাত্র প্রশ্নে যে আমি কে? আমি কি রত্নগর্ভা এ বরিশাল মায়ের সন্তান নই? বরিশালের এ মহান নেতাকে ভুলে গেলে আমার মানবিক ও সামাজিক মূল্য কতটুকু থাকবে?
শের-ই-বাংলা ও অশ্বিনী কুমারকে বাদ দিয়ে বরিশালের অনেক কৃতিসন্তানের স্মরণসভা হয়। দু’একটি সভায় আমি যোগদান করেছিলাম। সুস্বাদু বিরিয়ানির সুঘ্রাণে সেখানকার বাতাস ভারী হয়ে ছিল। গুণমুগ্ধ শ্রোতাদের হাত-তালিতে সভাকক্ষ যখন মুখরিত, তখন আমার বুকের মধ্যটায় কেন জানি একটি মোচড় অনুভব করছিলাম। আমি যেন তখন সভাকক্ষের কার্নিশে কার্নিশে শের-ই-বাংলা ও অশ্বিনী কুমারের আত্মার গুঞ্জন শুনতে পেলাম। আমি কিন্তু কাউকেই ছোট করে দেখছি না। সকলেই আমার শ্রদ্ধার পাত্র। তবে জ্যেষ্ঠকে জ্যেষ্ঠত্বের স্থানে দেখতে পেলেই আমি খুশী হব। আমার শরীরে শের-ই-বাংলার রক্ত প্রবাহিত নয় ঠিকই। তাই বলে কি আমি তার কেউ নই? তার প্রতি আমার কি কোন মানবিক ও সামাজিক দায়িত্ব নেই? ‘অন্যরা কেন কিছু করছেন না’ এই বলে কি আমি আমার দায়িত্ব থেকে রেহাই পেয়ে যাব? আমি এক বিত্তহীন, সম্বলহীন অসুস্থ বৃদ্ধ। কোন অবদান না রাখতে পারলেও গুণীজনদেরকে যে আমি ভালবাসি, তাদের স্মরণ করার জন্য যে আপনাদের দ্বারস্থ হতে পেরেছি এতটুকুই আমার শান্ত¡না। অনেকের মূল্যবাণ সময় নষ্ট করে তাদেরকে বিরক্ত করে যাচ্ছি। এটিও আমার দ্বায়িত্বের মধ্যেই পড়ে বলে আমি মনে করি। আমাদের হাদিসে আছে ‘সত্য’, লোকের নিকট অপ্রিয় হলেও তা প্রচার করো।
যদি কেউ এমন প্রশ্ন করেন যে বরিশালে এত বড় বড় ধনাঢ্য ভাগ্যবাণ পরিবার থাকতে এ দুই নেতার এহেন পরিণতি কেন? স্মৃতির অতল গর্ভে কেন হারিয়ে যাচ্ছেন তারা? এর উত্তর আমরা কি দেব একটু ভাবি। এ ভাবনার মধ্যেই আমরা আমাদেরকে সঠিকভাবে মূল্যায়ণ করতে পারবো। আমরা কোথায় ছিলাম আর আজ কোথায়ইবা আছি!
আজ শের-ই-বাংলা নেই। সেই মহাপ্রাণ অশ্বিনী কুমারও নেই। তাদের সে আদর্শও নেই। সে আদর্শ আজ মৃত। তা দিয়ে যে রাতারাতি কোটিপতি হওয়া যায় না। আদর্শ না থাকলেও আছে তাদের সেই বরিশাল। যে বরিশালকে ভালবেসে মুগ্ধ কন্ঠে এক বিদেশী বলেছিলেন ‘বিদেশে যদি আমার মরণ হয়, তবে যেন তা বরিশালেই হয়।’ মনের অজ্ঞাতে আমিও সেই বিদেশীর পদাঙ্ক অনুস্মরণ করছি। সন্তানদের ঢাকায় রেখে এখানে পড়ে আছি একা। ওরা কবে আসবে, কাঁদবে, জানাজা পড়ে আবার চলে যাবে।
আমি শুইয়ে থাকবো এই মাতৃকোলে বরিশালের মাটিতে। আমার মায়ের ভেজা-আঁচলের গন্ধে ভরা, ষড়-ঋতুর রঙ্গশালা, সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা, রূপ-লাবণ্যে মাধুর্যময়ী এ বঙ্গমাতা বরিশাল। বিদ্রোহী কবির ‘প্রাচ্যের ভেনিস’ জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলার মুখ’ সুফিয়া কামালের ‘পূণ্যে বিশাল’ বরিশাল। মহাত্মা গান্ধীর ‘সদা জাগ্রত বরিশাল’। কবি দ্বিজেন্দ্রলালের ‘আদর্শ নমস্য শিক্ষক’ বরিশাল। ‘বাংলার শস্যভান্ডার’, ‘এগ্রিকালচারাল ম্যানচেস্টার’ বরিশাল। বাউল-ভাটিয়ালী, জারী-সারি আর পিঠা-মিঠার দেশ বরিশাল।
হে বরিশাল, আমি তোমাকে ভালবাসি। তবে আত্মবিস্মৃত বিত্তহীন সেই সব মহাপুরুষদের দেশে আমি হানিফ সংকেতদের মতও কোন অবদান রাখতে পারলামনা। তাই আমার হারাবার মতও কিছু নেই। আমার মন খুব শক্ত হয়ে গেছে। স্বপ্নে রসগোল্লা দেখলেও আমি এখন আর কাঁদব না। তবুও কেন জানি মনখুলে হাসতে পারি না। আজও কার্নিশে কার্নিশে শুনি সেই আত্মার গুঞ্জন। ফিস ফিস শব্দ। ##
টি.এম. জালাল উদ্দীন
নোঙর
রোড নং ৭, লেন ১৩ (চন্দ্রদ্বীপ স্মরণি)
রুপাতলী হাউজিং এস্টেট, বরিশাল
মোবাইল: ০১৭১১-১১৯৪৩৩
খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী লেখা।
বাংলার ঘরে ঘরে এ মনীষীর বার্তা পৌঁছে দেয়া আমাদের কর্তব্য বলে আমি মনে করি।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এক লড়াকু সৈনিক শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক।
সর্বোপরি অসংখ্য ধন্যবাদ সম্মানিত লেখককে।