আলতাফ পারভেজ ||
এক.
১১ জানুয়ারি দেশে-বিদেশে নানান কারণে কুখ্যাত এক দিন। সমকালীন বিশ্বে এই দিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গুয়ানতানামো কারাগার প্রতিষ্ঠার ঘটনা। আজ ২০ বছর হয়ে গেল এই কারাগারের।
দুই.
গুয়ানতানামো কারাগারের কথা উঠলেই অনেক সময় এ প্রশ্ন ওঠে, কিউবার মাটিতে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে এ কারাগারের মালিক হলো? বিশেষ করে, যখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সব সময় এইমর্মে উদ্বৃত করা হয় : ‘কিউবার গুয়ানতানামো কারাগার’।
বাস্তবে জায়গাটি কিউবার হলেও কারাগারটি যুক্তরাষ্ট্রের।
তিন.
১৮৯৮ সাল পর্যন্ত কিউবা ছিল স্প্যানিশ কলোনি। পরে স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধের মধ্যদিয়ে কিউবা স্বাধীন হয়। স্বাধীনতায় সহায়তার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার তৎকালীন সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে ৪৫ বর্গমাইল আয়তনের এই এলাকাটি নিয়ে নেয়।
শর্ত ছিল ‘দুপক্ষ চাইলে’ এই লীজ বাতিল হবে, আর তা যতদিন না হচ্ছে কিউবা বছরে ২ হাজার স্বর্ণমুদ্রা পাবে। ১৯০৩ সালে ওই চুক্তি হয়। ১৯৩৪ সালে এ নিয়ে আরেক দফা চুক্তি হয় এবং তখন ভাড়া হিসেবে নির্ধারিত হয় বছরে ৪ হাজার ৮৫ ডলার। যুক্তরাষ্ট্র এখানে মূলত একটি নৌ-ঘাঁটি স্থাপন করে। এই ঘাটিকে তারা আদর করে গিতমো (gitmo) বলে।
চার.
উপরোক্ত লীজের পটভূমি হিসেবে এও মনে রাখা দরকার, গত শতাব্দির প্রথম দিককার কিউবা যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল সরকারগুলোই শাসন করতো এবং এই লীজচুক্তি তাদের উপর একতরফা চাপিয়ে দেয়া হয়। ফিদেল কাস্ট্রোদের বিপ্লবের পর এ পরিস্থিতি পাল্টে যায়। যদিও প্রচুর কিউবান গুয়ানতানামো বে থেকে কাজ করতো–কিন্তু ফিদেল প্রতিনিয়ত এই অঞ্চল কিউবার অধীনে নিয়ে আসার ব্যাপারে সোচ্চার ছিলেন।
১৯৬৪ সালে কিউবার সরকার অত্র অঞ্চলে পানি ও বিদ্যুত সরবরাহও বন্ধ করে দেয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই তার নৌ ঘাঁটি সরায়নি। বরং বছর বছর সে সুইস ব্যাংকের মাধ্যমে ৪ হাজার ৮৫ ডলারের একটি চেক কিউবার উদ্দেশে প্রেরণ করেছে।
পাঁচ.
নিচের ছবিতে সুইস ব্যাংকের যে চেক রয়েছে তা ফিদেলরা কখনো ক্যাশ করেনি। বিশ্ব ইতিহাসে বিপ্লবী জিদের এক অনন্য দৃষ্টান্ত কিউবার এই ঘটনা। মাত্র একটি চেক শুধু ভুল করে একবার ক্যাশ করা হয়ে গিয়েছিল। বাকিগুলো কাস্ট্রোর ড্রয়ারেই পড়েছিল।
সেদেশের সরকার কখনো স্বীকারও করে না যে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে এই এলাকা ভাড়া দিয়েছে। তারা এটাকে জবর দখল মনে করে এবং ফিদেল এও বলতেন, তাঁর ড্রয়ারে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের চেকগুলো হলো ঐ দেশের জবরদখল সংস্কৃতির চিরস্থায়ী বৈশ্বিক প্রমাণ। যা আগামী প্রজন্মের জন্য তিনি রেখে যাচ্ছেন।
ছয়.
গুয়ানতানামো নেভাল বেসের ভেতরেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর কুখ্যাত গুয়ানতানামো কারাগার। ২০ বছর আগে ২০০২ সালের ১১ জানুয়ারি এই কারাগারের যাত্রা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে, বিশেষ করে আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া ‘সন্ত্রাসী’ তকমা লাগানোদের এই কারাগারে রাখা হলেও শুরুতে তাদের পরিচয় প্রকাশ করতো না যুক্তরাষ্ট্র। পরে বার্তা সংস্থা এপি’র সংগে এক আইনীযুদ্ধে হেরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার জানায় এখানে ৭৭৯ জন মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে।
২০১১-এ জুলিয়ান আসাঞ্জদের উইকিলিকস এই ৭৭৯ জনের নামে থাকা ৭৭৯টি সিক্রেট ফাইলই প্রকাশ করে দেয় সাইবার ওয়ার্ল্ডে। এখন বন্দি সংখ্যা কমতে কমতে এক শত জনের নিচে চলে এসেছে। তবে বিশ্বের নির্যাতন-ইতিহাসে গুয়াননাতামো অধ্যায় সর্বকালের অতীতকে ম্লান করে দিয়েছে ইতোমধ্যে।
সাত.
দেশে বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন অনেক কারাগার থাকলেও গুয়ানতানামোতে এই বন্দিদের নেয়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ছিল এখানকার বন্দিরা যাতে আইনগত কোন সুযোগ সুবিধা, বিশেষ করে বন্দিদের জন্য নির্ধারিত জেনেভা কনভেনশনের কোন সুবিধা দাবি করতে না পারে।
ঠিক এখানেই কিউবার সরকারের ক্ষোভ ও হতাশা। তারা মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র তার ইতিহাসের জঘন্যতম অত্যাচারকর্ম সারছে তার ভূমিতে। কিন্তু একতরফাভাবে কিউবা চুক্তিটি বাতিল করে নিজ ভূমি দখলও করে নিতে পারছে না প্রয়োজনীয় শক্তি-সামর্থ্যের অভাবে।
আট.
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০০৯-এ এসে ঘোষণা দিয়েছিলেন পরের বছরই তিনি গুয়ানতানামো কারাগার বন্ধ করে দেবেন এবং এমন ইংগিতও দিয়েছিলেন আলোচ্য ভূমি কিউবাকে ফেরত দেয়া হবে। ওবামা কথা রাখেননি।
তিনি ক্ষমতায় আসার পর বিশ্ববাসীকে তিনটি বড় স্বপ্ন দেখিয়ে নোবেল শান্তি পুরস্কারও নিয়েছিলেন। তাঁর বড় ‘স্বপ্ন’-এর একটা ছিল এই কারাগার বন্ধ করার বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্টও একইরকম অঙ্গীকার করেছেন। অথচ তাঁর আমলেই এই কারাগারের দুই দশক পূর্তি হচ্ছে। কবে এটা বন্ধ হবে তার কোন ইঙ্গিত নেই আজো।
কিউবার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধও জারি আছে এখনও। উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্রের গুয়ানতানামো অধ্যায়ের তথ্যাদি ফাঁসের কারণে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে হাত করে প্রতিশোধ নিতে চাইছে বাইডেন প্রশাসন।
নয়.
কুখ্যাত এই কারাগারের দুই দশক পূর্তি উপলক্ষে আজ বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন স্থানে এটি বন্ধের দাবিতে মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়েছে; লেখালেখি হচ্ছে।
লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার হলো সবচেয়ে কম প্রতিবাদ হচ্ছে মুসলমান-প্রধান দেশগুলোতে। অথচ এই কারাগারের বন্দিদের সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিল ওসব দেশের নাগরিক।
আলতাফ পারভেজ।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক