কৃষকের ঈদ : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

মির্জা মুহাম্মদ নূরুন্নবী নূর ।।
মুসলমানদের প্রধান আনন্দ ও খুশির উৎসব হচ্ছে ঈদের দিন। ঈদের বাঁকা চাঁদের সরু হাসিতে মেতে ওঠে দুনিয়ার সকল মুমিনেরা। আনন্দ উচ্ছ্বাস আর এককাতারে মিশে যাওয়ার মহেন্দ্রক্ষণ হচ্ছে ঈদের মিলনমেলা। ধনী-দরিদ্র, ফকির মিসকিনসহ মাজলুম অসহায় টোকাইয়েরাও নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদ আনন্দে শামিল হয়। পাড়া-গাঁয়ে ঢেউ খেলা আনন্দে দলবেঁধে ঈদগাহে সমবেত হয় শিশুকিশোর, যুবা বয়োবৃদ্ধসহ সব শ্রেণি পেশার মুসলমানেরা। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অতীতের সকল দুঃখ-কষ্ট, জ্বালা যন্ত্রনা, হিংসা-বিদ্বেষ ও মনোমালিন্যের ইস্পাত কঠিন দেয়াল ভেঙে একাকার হয়ে যান হৃদ্যতার এক অনাবিল সুখ আনন্দের মহামিলনে।
ঈদ যেমন আনন্দের বারতা নিয়ে আসে ঠিক তেমনই একবুক কষ্টের কারণ হিসেবেও আবির্ভূত হয় কারো কারো জন্যে। ঈদের শিক্ষা আমাদের জীবনে এক বিরাট ভূমিকা রাখে। আমরা জানি হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদিনায় পৌঁছে দেখতে পান যে, সেখানকার অধিবাসীরা বছরে দুটি দিনে (নায়মূক ও মিহিরজান) খেলাধুলা ও আনন্দ-উৎসব করে থাকে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জিজ্ঞাসা করেন, এই দুইদিন কিসের? তারা বলেন, জাহিলিয়াতের যুগে আমরা এই দুইদিন খেলাধুলা ও আনন্দ উৎসব করতাম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের এই দুইদিনের বিনিময়ে অন্য দুটি উত্তম দিন দান করেছেন এবং তা হলো কুরবানী ও রোযার ঈদের দিন। (সুনানে আবু দাউদ, তিরমিযী ও নাসায়ী শরীফ)।
ঈদ মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলেও তা বাঙালির হাজার বছরের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে রয়েছে এক নিবিড় সম্পর্ক। মিশে আছে হৃদয়ের গহীনে। ফলে আমাদের শিল্পসাহিত্য অঙ্গনকেও ঈদ থেকে আলাদা করা যায় না কিছুতেই। ঈদ এলেই ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া নানা আয়োজনে মাতিয়ে রাখা সবাইকে। ঈদ এখন সার্বজনীন উৎসবে পরিনত হয়েছে। ঈদ আর শুধু ধর্মীয় উৎসবই নয় এটা সামাজিক উৎসবেও রূপ নিয়েছে সর্বত্রই। এই দিনে দুঃখ কষ্ট ভুলে গিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে সবাই। এই আনন্দে শামিল হয় মিডিয়া জগতও। তারা ঈদকে সামনে রেখে বিভিন্ন ধরনের আয়োজন করে থাকে। প্রচার করে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।
প্রিন্ট মিডিয়াও শামিল হয় এই আনন্দে। তারা প্রকাশ করে ঈদ ম্যাগাজিন। বিশেষ ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করে সাহিত্যপ্রিয় সবাইকে সম্পৃক্ত করে ঈদ আনন্দে। সৃজনশীল লেখক-লেখিকারাও সম্পৃক্ত হয় এই আয়োজনে। ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও উপন্যাসসহ সাহিত্যের কোনো কিছুই বাদ পড়ে না আয়োজন থেকে।
“ঈদ নিয়ে লিখেননি এমন কোনো মুসলিম কবি-সাহিত্যিক বা লেখক হয়ত মিলবে না। এক্ষেত্রে বাংলাভাষী কবি-সাহিত্যিকরাও বহু এগিয়ে। ঈদ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে লিখালেখি হয়েছে বিপুল পরিমাণ। হিন্দু ও মুসলিম কবি-সাহিত্যিকরা কতো ভাবে ঈদকে উপস্থাপন করেছেন তাদের লেখনীর ভাষায়।
১৯০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে মাসিক ‘নবনূর’ পত্রিকার ঈদসংখ্যায় সৈয়দ এমদাদ আলীর ‘ঈদ’ কবিতা প্রকাশিত হয়। ঈদ নিয়ে যা ছিলো মুসলিম বাংলার প্রথম কবিতা। কবিতাটির প্রথম দুটি স্তবক হলো:
“কুহেলি তিমির সরায়ে দূরে
তরুণ অরুণ উঠিছে ধীরে
রাঙিয়া প্রতি তরুর শিরে
আজ কি হর্ষ ভরে।
আজি প্রভাতের মৃদুল বায়
রঙে নাচিয়া যেন কয়ে যায়
মুসলিম জাহান আজি একতায়
দেখ কত বল ধরে?”
নবনূরের পৌষ ১৩১১ সংখ্যায় কায়কোবাদ লিখেছেন ঈদ শীর্ষক কবিতা, ফাল্গুন ১৩১১ সংখ্যায় ঐতিহাসিক রামপ্রাণ গুপ্ত লিখেন ‘ঈদজ্জোহা’ প্রবন্ধ। এছাড়া নবনূরের পৌষ ১৩১২ সংখ্যায় ঈদ সম্পর্কিত তিনটি লিখা প্রকাশিত হয়। সৈয়দ এমদাদ আলীর ‘ঈদ’ কবিতা, জীবেন্দু কুমার দত্তের ‘ঈদ সম্মিলন’ কবিতা, এবং বেগম রোকেয়ার ‘ঈদ সম্মিলন’ গদ্যপ্রবন্ধ। মুসলিম জাগরণের কামনা করে, ‘ঈদ আবাহন’ নামে দুটি কবিতা লিখেছেন কায়কোবাদ। একটি তার ‘অশ্রুমালা’ কাব্যগ্রন্থে অন্যটি ‘অমিয়ধারা’ কাব্যগ্রন্থে। মান্দাকিনী-ধারা কাব্যগ্রন্থে ঈদ নিয়ে ছোটদের কবিতাও লিখেছেন তিনি।
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী তার সম্পাদিত ‘মাসিক আল এসলাম’ পত্রিকার ভাদ্র ১৩২৩ সংখ্যায় কোরবানির যুক্তি দেখিয়ে লিখেছেন ‘ঈদুল আজহা’ প্রবন্ধ। ( তথ্যসূত্র: আদনান আহমেদ, বাংলা কবিতায় ঈদ: স্বরূপ ও ঐতিহ্য। ৩১ আগস্ট/২০১৭, অনলাইন সংস্করণ)।”
ঈদ নিয়ে সবচেয়ে বেশি লিখেছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার অসংখ্য গান কবিতা, ছড়া, নাটক ও প্রবন্ধ থেকে শুধুমাত্র ‘কৃষকের ঈদ’ নিয়ে যৎসামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।
ঈদ আনন্দ যেহেতু মুসলমানদের জন্য সেহেতু তারা ঈমানদার হবেন এটাই স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক। কেবলমাত্র মুমিনেরাই সত্যিকারের ঈদ আনন্দ উপভোগ করেন। হোক সে ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা, বেকার-চাকুরিজীবী বা যে কেউ। পাড়া গাঁয়ের দরিদ্র কৃষকও এই আনন্দ থেকে দূরে থাকেন না। কিন্তু সমাজ সংস্কৃতিতে যখন অমানবিক, অসংগতি আর বেইনফাফির দৃশ্যপট চোখে পড়ে তখন সচেতন একজন কবি নিরব থাকতে পারেন না। তার কলমে ঝলসে ওঠে প্রতিবাদের বারুদ সমেত কথামালা। কাব্যবাণের তীব্র চোট। আমরা কবি কাজী নজরুল ইসলামের কৃষকের ঈদ কবিতায় এমনই কিছু প্রতিবাদের ভাষা দেখি। কবি লিখেন-
ঈমান! ঈমান! বল রাতদিন, ঈমান কি এত সোজা?
ঈমানদার হইয়া কি কেহ বহে শয়তানি বোঝা?
শোনো মিথ্যুক! এই দুনিয়ায় পুর্ণ যার ঈমান,
শক্তিধর সে টলাইতে পারে ইঙ্গিতে আসমান।
যারা শয়তানী বোঝা বহন করে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে ঈদগাহে যায় কবি তাদেরকে সতর্ক করেছেন। ঘৃণার বাণ ছুঁড়ে দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে। কবি মিথ্যুক বলে তাদেরকে শাসিয়েছেন। মুমিন পরিচয় বহন করেও ঈদের আনন্দে শামিল হওয়া এসব মুমিনেরা কিভাবে ধিক্কার পাওয়ার যোগ্য তার উপমা টেনে কবি লিখেছেন-
থালা, ঘটি, বাটি বাঁধা দিয়ে হের চলিয়াছে ঈদগাহে,
তীর খাওয়া বুক, ঋণে- বাঁধা- শির, লুটাতে খোদার রাহে।
জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমুর্ষ সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?
কবি কৃষকদের পক্ষ নিয়ে যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন আজও তার জবাব মেলেনি। দুনিয়ার সব দরিদ্র কৃষকের দিকে নজর রাখলে দেখা যায় কী করুণ দশা তাদের। এক শ্রেণির বুর্জোয়া ধনকুবেরা রক্তচোষার মতো করেই অশিক্ষিত দরিদ্র অসহায় কৃষকের হাড্ডিসার হাড়-হাড্ডি খুবলে খুবলে খাচ্ছে। আমরা আগেও চুপ ছিলাম আজও আছি। জানিনা আরও কতদিন এভাবে থাকবো।
দরিদ্র কৃষক যখন ইফতারের সময় ভালো কোন খাবার পায়নি, একমুঠো রুচিকর আহারের জন্য হাহাকারের সাগরে সাঁতরে বেড়ায় এমন দৃশ্য কবির চোখ এড়িয়ে যায় না। যদিও কৃষকদের হৃদয়ের আকুতি দুমড়েমুচড়ে ছানি ফেলে দেয় চেতনার ধ্বজাধারী ফেরিওয়ালাদের চক্ষুলজ্জাকে। কবি আফসোস করে কালের মুয়াজ্জিনকে সম্বোধন করে আজান থেমে যাওয়ার কষ্ট তুলে ধরেন কবিতার ছন্দে ছন্দে। কবির মুয়াজ্জিন আজ চুপচাপ, নিরব, নিথর যেন! কবি আকুতি প্রকাশ করেন এভাবে-
রোজা এফতার করেছে কৃষক অশ্রু- সলিলে হায়,
বেলাল! তোমার কন্ঠে বুঝি গো আজান থামিয়া যায়।
বেলালের আজান থেমে গেছে। ইমামের তেজোদিপ্ত সেই হুংকারও নেই। নেকড়েদের চেঁচামেচিতে ইমামেরা এখন নিরব, নিশ্চুপ! মাথা উচুঁ করে আর সত্যের কথা, হকের বাণী উচ্চারণ করতে পারেন না তারা। কেউ কেউ হয়তো জেনেবুঝেই এড়িয়ে যান। কালো আঁধারে নিভে গেছে ইমামের সাহসী উচ্চারণ! এভাবে যতদিন নিরব থাকব ততদিনই জুলুমের শিকার হতে হবে আমাদেরকে। লাশের কফিনেও হয়তো আগুন জ্বলবে কোন একদিন।
ঈদের দিনে দরিদ্র কৃষকের শিশু ইন্তেকাল করেছেন। অভাবের সংসার তার। এখন কী করবেন তিনি! অসহায় মানুষটির আকুতি এভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন কবি-
আসমান- জোড়া কাল কাফনের আবরণ যেন টুটে।
এক ফালি চাঁদ ফুটে আছে, মৃত শিশুর অধর পুটে।
আমরা নিজেদের স্বাবলম্বী ভাবলেও এমন দৃশ্যও চোখে পড়ে সহসাই। তবুও আমরা নিরব, আমার নিশ্চুপ! কত আধমরা আমরা! শুধু আফসোস হয়! করুণা হয়! ঘৃণা জাগে!
তবুও হররোজ শুনি বিশ্বের সবাই এখন স্বাবলম্বী! আমাদের নাকি অভাব নেই। দুনিয়ার কর্তাব্যক্তিরা অভাবের কথা শিকার না করলেও এখনও অনেকেই দারিদ্র্য সীমার নিচে দিনাতিপাত করছেন। অফিস পাড়ায় বা গাঁও গেরামে এখনও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য হাত পেতে টাকা আদায় করতে দেখা যায় প্রতিনিয়তই। এমনও খবর আসে প্রয়োজনীয় দুধভাত না খেতে পাওয়ার অভাবে পুষ্টিহীনতায় ধুঁকে ধুঁকে জীবন যাচ্ছে হাজারও পথশিশুর। দারিদ্রতার কষাঘাতে এখনও নির্মমতার শিকার অনেকেই। এমন কোটি কোটি জনতার জন্য কি ঈদ আনন্দ বয়ে আনে? নাকি হতাশা বয়ে আনে? দরিদ্র কৃষকদের এমনও কেউ কেউ আছেন যাদের জন্য ঈদগাহ যেন জানাজার মাঠ সমেত, ঈদের তাকবীর যেন তাদের জন্য হাহাকারের ধ্বনি! এমন দৃশ্য দেখে মনে হয় এজিদের প্রেতাত্মারা এখনও ক্ষমতার মসনদের টুঁটি চিপে ধরে আছে। এখন আর ইমাম হাসান হোসাইনের খোৎবা উচ্চারিত হয় না মক্কা মদিনাসহ দুনিয়ার কোন মসজিদের ইমামের কণ্ঠে! কবির আর্তনাদ এখানেই। এখনও কবির আকুতি লক্ষ করা যায় সবখানেই। কবি কী চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের ভাবনায়। কবির ভাষায় শুনুন-
কৃষকের ঈদ! ঈদগাহে চলে জানাজা পড়িতে তার,
যত তকবির শোনে, বুকে তার তত উঠে হাহাকার।
মরিয়াছে খোকা, কন্যা মরিছে, মৃত্যু- বন্যা আসে
এজিদের সেনা ঘুরিছে মক্কা- মসজিদে আশেপাশে।
কোথায় ইমাম? কোন সে খোৎবা পড়িবে আজিকে ঈদে?
চারিদিকে তব মুর্দার লাশ, তারি মাঝে চোখে বিঁধে!
তবুও ঈদের দিন বলে কথা! ধণীরা জরির পোশাক পড়ে ঈদগাহে এসেছেন। ইমাম নেতার পোশাকে শামিল হয়েছে ইমামতির জন্য। খোৎবাও দেবেন তিনি। কোরান, হাদিস আর ফিকহের আলোচনাও করবেন। ফতোয়াও দেবেন ঠিকঠাক মতোই। কিন্তু সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে যে ইমাম কথা বলবেন না তা ভেবে কবি সন্দেহে জড়িয়ে পড়েন। কবি বিশ্বাস করেন না ইমামকেও। ইমামের সাহসিকতার দুর্বলতা খুঁজে পান কবি। সমকালীন কতেক তেলবাজ ইমামকে উদ্দেশ্য করে কবি লেখেন-
জরির পোশাকে শরীর ঢাকিয়া ধণীরা এসেছে সেথা,
এই ঈদগাহে তুমি ইমাম, তুমি কি এদেরই নেতা?
নিঙ্গাড়ি’ কোরান হাদিস ও ফেকাহ, এই মৃতদের মুখে
অমৃত কখনো দিয়াছ কি তুমি? হাত দিয়ে বল বুকে।
সত্যিই তো ইমামেরা এখন আর সমাজ সংস্কার নিয়ে কথা বলেন না। রাস্ট্র নিয়েও তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। এজন্যেই কবি আরও কঠিন হয়েছেন নিজের চিন্তায়। সাহসিকতার ভাবনায়।
ইমামের সন্দিহান আচরণে ক্ষুব্ধ কবি। যে ইমাম নিজেই স্বাধীন নন, তিনি কিভাবে আরেকজনের স্বাধীনতার জন্য খোৎবা দেবেন? যে ইমামের শক্তি সাহস কিছুই নাই তার পদভারে কিভাবে আবে জমজমের সৃষ্টি হবে? যে ইমাম আল্লাহ তায়ালার দেয়া শক্তি নিজের বুকে ধারণ করতে পারেন না সেই শক্তিহীন ইমামের আনুগত্য করি আমরা, শুনি তার খোৎবা, বক্তব্য, আলোচনা, নসিহত! কবি এখানে বিস্ময় বোধ করেন! কবির সমকালীন প্রেক্ষাপট আর আমাদের বর্তমান অবস্থান একই। কবির এই আফসোস এখন আমাদেরও। কবির আকুতি-
নিজে যে স্বাধীন হইলনা সে স্বাধীনতা দেবে কাকে?
মধু দেবে সে কি মানুষে, যাহার মধু নাই মৌচাকে?
কোথা সে শক্তি- সিদ্ধ ইমাম, প্রতি পদাঘাতে যার
আবে- জমজম শক্তি- উৎস বাহিরায় অনিবার?
আপনি শক্তি লভেনি যে জন, হায় সে শক্তি-হীন
হয়েছে ইমাম, তাহারি খোৎবা শুনিতেছি নিশিদিন।
কবির আফসোসের সাথে আমরাও অনুতপ্ত! আমাদেরও কষ্ট হয় খুব। ইমাম কবে আসবেন! কবে স্বাধীন হব আমরা! যিনি দরিদ্র অসহায়দের জন্য তাগিদ দেবেন। যার নেতৃত্বে দুনিয়ায় সুখময় ঈদের আনন্দঘন পরিবেশ বিরাজ করবে প্রতিটি ঘরে ঘরে। ঈদের চাঁদের হাসির মতোই আলোকিত হবে দুনিয়া। দুনিয়ার সকল অসহায় দরিদ্র মাজলুমেরা পাবেন শান্তির ঠিকানা। নিজের অধিকার। জান্নাতের নীড়! কবির আকুতি কী আবেগপ্রবণ!
অসহায় মাজলুম মানুষের আর্তনাদের কথা অনেক আগেই জানিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। সমকালীন পৃথিবীতে নির্যাতিত মাজলুম মানবতা কিভাবে গুমরে কেঁদে মরছেন সেটিও জানিয়ে দিয়েছেন বহু আগেই। কুরআন পড়ুন, কুরআন বুঝুন আর খুঁজুন সমকালকে। পড়ুন কুরআনের ভাষায়-
“আর তোমাদের কি হল যে, তোমরা আল্লাহর রাহে লড়াই করছ না দুর্বল সেই পুরুষ, নারী ও শিশুদের পক্ষে, যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদিগকে এই জনপদ থেকে নিষ্কৃতি দান কর; এখানকার অধিবাসীরা যে অত্যাচারী! আর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য পক্ষালম্বনকারী নির্ধারণ করে দাও এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী নির্ধারণ করে দাও”। (সূরাহ আন নিসা, আয়াত নং-৭৫)।
আল্লাহ তায়ালার এই আবেগপ্রবণ আলোচনার সাথে আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও সুর মিলিয়েছেন। তিনিও আবেগীয় ভাষায় বাস্তবতার বহিপ্রকাশ ঘটিয়েছেন! কবির কণ্ঠে বরিয়ে এসেছে এভাবেই-
দীন কাঙ্গালের ঘরে ঘরে আজ দেবে যে নব তাগিদ
কোথা সে মহা- সাধক আনিবে যে পুন ঈদ?
ছিনিয়া আনিবে আসমান থেকে ঈদের চাঁদের হাসি,
ফুরাবে না কভু যে হাসি জীবনে, কখনো হবে না বাসি।
আমরা আর বসে থাকতে চাইনা। বিশ্ব মানবতার মুক্তির জন্য দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে সামনে। মঞ্জিলপানে। লক্ষ্যপানে। এখন দিন গুণবার দিন শেষ। যদিও কবি দিন গুণছেন তার আগমনের। যার শাসন রাজ্যে রোজা রেখে দিন শেষে আনন্দে ইফতার করা যাবে। ইফতারের খুশি লুটিয়ে নেয়া যাবে। রোজা শেষে ঈদ আনন্দে মেশার সুযোগ হবে। ঈদের ময়দানে, একসাথে এক আল্লাহর রাহে নিজেদের বিলিয়ে দেয়া যাবে। আমরাও সেই স্বপ্নীল সুন্দর সময় ও দিনক্ষণের আশায় বুক বাধি। আশা রাখি। স্বপ্ন দেখি। কবির ভাষায় বলতে হয়-
সমাধির মাঝে গুণিতেছি দিন, আসিবেন তিনি কবে?
রোজা এফতার করিব সকলে, সেই দিন ঈদ হবে।
আবারও খুশির ঈদ নেমে আসুক দুনিয়ায়। সবার হৃদয়ে হৃদয়ে বেজে উঠুক ঈদ আনন্দের বীণ সঙ্গীত! ব্যক্তি থেকে পরিবার! পরিবার থেকে সমাজ। সমাজ থেকে রাস্ট্র হয়ে গোটা বিশ্বে বিরাজ করুক ঈদের আনন্দঘন পরিবেশ। কবির কৃষকেরা আর না কাঁদুক। স্বপ্নীল সুন্দর বসুন্ধরা হোক ঈদময় গদ্যমাঠ।

আরো পড়ুন

ক্ষোভ

নীলা আহমেদ ।। বুকের গভীরে রক্তের ক্ষত সাঁতরাবো আর রক্তসিন্ধু কতো? রক্ত ঝরাতে পারিনাতো একা, …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *